লক্ষণ-জাতক।


অনুবাদক : শ্রী ঈশানচন্দ্র ঘোষ

শাস্তা রাজগৃহের নিকটবর্ত্তী বেণুবনে অবস্থিতি-কালে দেবদত্ত সম্বন্ধে এই কথা বলিয়াছিলেন। দেবদত্ত প্রথমে বুদ্ধদেবের শিষ্য ছিলেন, পরে ঈর্ষ্যা-বশতঃ তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়াছিলেন তিনি যে বুদ্ধ অপেক্ষাও শুদ্ধাচারী, ইহা প্রতিপন্ন করিবার জন্য দেবদত্ত পাঁচটী নূতন নিয়ম প্রস্তাব করেন :—(১) ভিক্ষুগণ চিরজীবন বনে থাকিবেন ও (২) তরুতলে বাস করিবেন; (৩) আশ্রমের বাহিরে গিয়া যে ভিক্ষা পাইবেন, শুদ্ধ তদ্বারা জীবন ধারণ করিবেন, অর্থাৎ আশ্রমে বসিয়া থাকিয়া উপাসকগণের নিকট হইতে কোনরূপ উপঢৌকন গ্রহণ করিতে পারিবেন না; (৪) লোকালয়ের আবর্জ্জনা-স্তূপে যে সকল ছিন্ন বস্ত্র পাওয়া যাইবে, কেবল সেইগুলিই পরিধান করিবেন এবং (৫) কখনও মৎস্য মাংস খাইবেন না। বুদ্ধ এই সকল নিয়ম গ্রহণ করিতে অসম্মতি দেখাইলে দেবদত্ত সঙ্ঘত্যাগপূর্ব্বক পঞ্চশত ভিক্ষুসহ গয়শির (ব্রহ্মযোনি) পর্ব্বতে চলিয়া যান এবং সেখানে বুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া নূতন সম্প্রদায় স্থাপিত করেন। কিয়দ্দিন পরে শাস্তা জানিতে পারিলেন, ঐ পঞ্চশত শিষ্যের জ্ঞান এমন পরিপক্ব হইয়াছে যে, প্রকৃষ্ট উপদেশ পাইলেই তাঁহারা পুনর্ব্বার ত্রিরত্নের অর্থাৎ বুদ্ধশাসনের শরণ লইবেন। তখন তিনি সারীপুত্রকে বলিলেন, ‘তোমার যে পঞ্চশত শিষ্য দেবদত্তের সহিত বিপথে গিয়াছে, এখন তাহাদের সুমতি হইয়াছে। তুমি কতকগুলি ভিক্ষু সঙ্গে লইয়া ব্রহ্মযোনিতে যাও; তাহাদিগকে ধর্ম্মোপদেশ দাও, মার্গ-চতুষ্টয় ও তাহাদের ফল ব্যাখ্যা কর এবং তাহাদিগকে ফিরাইয়া আন।’

সারীপুত্র এই আদেশ মত কার্য্য করিলেন এবং পরদিন প্রত্যুষে ঐ পঞ্চশত ব্যক্তিকে বেণুবনে ফিরাইয়া আনিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া বেণুবনস্থ ভিক্ষুগণ জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, ‘আমাদের ধর্ম্মসেনাপতি সারীপুত্রের কি অদ্ভুত ক্ষমতা! তিনি দেবদত্তের সমস্ত শিষ্য লইয়া আসিয়াছেন।’

ইহা শুনিয়া শাস্তা কহিলেন, ‘সারীপুত্র পূর্ব্বজন্মেও এইরূপ অদ্ভুত কর্ম্ম করিয়াছিলেন। দেবদত্তও যে কেবল এই জন্মে গণ-পরিহীন হইল, তাহা নহে; পূর্ব্বজন্মেও সে এরূপ লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছিল।’ অনন্তর শাস্তা অতীত জন্মের সেই বৃত্তান্ত বলিতে আরম্ভ করিলেন।]

পুরাকালে মগধের অন্তঃপাতী রাজগৃহ নগরে এক রাজা ছিলেন। তাঁহার সময়ে বোধিসত্ত্ব মৃগযোনিতে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তিনি বড় হইলেন, তখন সহস্র মৃগে-পরিবৃত হইয়া বনে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার দুইটী পুত্র জন্মিল; তাহাদের বড়টীর নাম লক্ষণ এবং ছোটটীর নাম কালু। বোধিসত্ত্ব যখন বৃদ্ধ হইলেন, তখন তিনি প্রত্যেক পুত্রকে পঞ্চশত মৃগের রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিলেন।

মগধরাজ্যে ফসলের সময় মৃগদিগের বড় বিপদ হইত। ফসল খাইত বলিয়া তাহাদিগকে মারিবার জন্য লোকে কোথাও গর্ত্ত খুঁড়িত, কোথাও শূল পুতিত, কোথাও পাথরের যন্ত্র রাখিয়া দিত কোথাও জাল পাতিত। এইরূপে বহু মৃগ বিনষ্ট হইত।

একদিন বোধিসত্ত্ব দেখিলেন, ফসলের সময় আসিয়াছে। তিনি পুত্রদ্বয়কে ডাকাইয়া বলিলেন, ‘এখন মাঠে ফসল হইয়াছে। এ সময় প্রতি বৎসর অনেক মৃগ মারা যায়। আমরা বৃদ্ধ হইয়াছি, কাজেই বহুদর্শিতার গুণে কোন না কোন উপায়ে এখানে আত্মরক্ষা করিতে পারিব। কিন্তু তোমাদের অভিজ্ঞতা নাই; তোমরা আপন আপন অনুচর লইয়া পাহাড়ে যাও; যখন মাঠের ফসল উঠিয়া যাইবে, তখন ফিরিয়া আসিও। তাহারা ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া অনুচরগণ-সহ পর্ব্বতাভিমুখে যাত্রা করিল।

মৃগদিগের গমন-পথে যে সকল লোক বাস করিত, তাহারা জানিত, কোন সময়ে মৃগেরা পাহাড়ে উঠে, কোন সময়েই বা নামিয়া আইসে। তাহারা এই সকল সময়ে প্রতিচ্ছন্ন স্থানে থাকিয়া অনেক মৃগ মারিয়া ফেলিত।

কোন সময়ে চলিতে হয়, কোন সময়ে বিশ্রাম করিতে হয়, কালুর সে জ্ঞান ছিল না। সে অনুচরদিগকে লইয়া সকালে বিকালে, প্রত্যুষে ও সায়ংকালে, যখন ইচ্ছা লোকালয়ের নিকট দিয়াই চলিতে লাগিল, লোকেও কখনও প্রচ্ছন্ন থাকিয়া, কখনও বা তাহাদের সম্মুখে আসিয়া বহু মৃগ মারিতে আরম্ভ করিল। এইরূপ কালুর নির্ব্বুদ্ধিতায় অনেক মৃগ মারা গেল; সে যখন পাহাড়ে গিয়া পৌঁছিল, তখন তাহার অনুচরদিগের অতি অল্পই জীবিত রহিল।

লক্ষণ বুদ্ধিমান ও উপায়কুশল ছিল। সে লোকালয়ের ধার দিয়াও যাইত না; দিবাভাগে চলিত না, প্রত্যুষে বা সায়ংকালেও চলিত না। সে নিশীথ সময়ে পথ চলিত; কাজেই তাহার একটীমাত্র অনুচরও মারা গেল না; সে পঞ্চশত মৃগ লইয়া পাহাড়ে পৌঁছিল।

কালু ও লক্ষণ চারি মাস পাহাড়ে অতিবাহিত করিল। অনন্তর মাঠের ফসল উঠিয়া গেলে তাহারা পাহাড় হইতে নামিয়া আসিল। কিন্তু কালু এবারও পূর্ব্ববৎ নির্ব্বোধের মত চলিতে লাগিল; কাজেই তাহার অবশিষ্ট অনুচরেরাও নিহত হইল এবং সে একাকী প্রত্যাবর্ত্তন করিল। পক্ষান্তরে লক্ষণের একটী অনুচরেরও প্রাণবিয়োগ হইল না; তাহার যে পাঁচশ, সেই পাঁচশই রহিল। বোধিসত্ত্ব পুত্রদ্বয়কে ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া এই গাথা পাঠ করিলেন :

সদাচার, সুশীল, সদয়, বিচক্ষণ,

সংসারে সর্ব্বত্র হয় কল্যাণভাজন।

লক্ষণ ফিরিছে হের, জ্ঞাতিগণ সাথে

হয়নি বিনষ্ট কেহ পথে যাতায়াতে।

কালু কিন্তু অর্ব্বাচীন, অতি দুরাচার,

নাহিক একটী সঙ্গী জীবিত তাহার।

বোধিসত্ত্ব এই বলিয়া লক্ষণকে অভিনন্দন করিলেন। অনন্তর তিনি পরিণত বয়সে যথাকর্ম্ম লোকান্তরে প্রস্থান করিলেন।

সমবধান : তখন দেবদত্ত ছিল সেই কালু; তাহার শিষ্যগণ ছিল কালুর অনুচর; সারীপুত্র ছিল লক্ষণ; তাহার অনুচরগণ ছিল আমার শিষ্য; রাহুলের মাতা ছিলেন কালুর ও লক্ষণের গর্ভধারিণী আর আমি ছিলাম তাহাদের জনক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !