তৃতীয় অধ্যায়: ভয় এবং ব্যথা
জুয়া
বা বাজি ধরা- ৩৭
টাকা কামানো কঠিন, কিন্তু হারানো সহজ-
আর হারানোর সবচেয়ে সহজ পথটি হচ্ছে জুয়া। সকল জুয়াড়িই অবশেষে হেরো পার্টিতে পরিণত হয়।
তবুও লোকজন ভবিষ্যত জানতে পছন্দ করে, যাতে করে তারা জুয়া খেলে অথবা বাজি ধরে প্রচুর
টাকা কামাতে পারে। আমি দুটো গল্প বলব ভবিষ্যত অনুমান করাটা যে কত বিপদজনক তা দেখানোর
জন্য, এমনকি যদি সেরকম লক্ষণ দেখা যায়, তবুও।
এক বন্ধু কোন এক সকালে ঘুম থেকে জাগল
এক স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নটা এতই পরিষ্কার যে মনে হয়েছিল বাস্তব থেকেও বাস্তব। সে স্বপ্ন
দেখেছিল যে পাঁচজন দেবতা এসে তাকে পাঁচটি বড় বড় কলসিভরা ধনসম্পদ দিয়ে গেল। ঘুম ভেঙে
চোখ মেলে দেখল তার বেডরুমে কোন দেবতা নেই, আর আফসোস, কোন কলসিভরা ধনসম্পদও নেই। কিন্তু
স্বপ্নটি ছিল খুব অদ্ভূত।
সে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল যে তার স্ত্রী
তাকে পাঁচটি ডিম সেদ্ধ ও পাঁচ পিস পাউরুটি গরম করে দিয়েছে নাস্তার জন্য। সকালের খাবারের
কাগজে সে তারিখ দেখল ৫ই মে (পঞ্চম মাস)। অদ্ভূত কিছু একটা হচ্ছে, তাই না! পেছনের পাতায়
সে দেখল ঘোড়দৌড়ের খবর। সে অবাক হয়ে দেখল যে এসকটে (ASCOT-পাঁচ অক্ষর) যে ঘোড়দৌড়ের খেলা
হচ্ছে, সেখানে পঞ্চম দৌড়ের পঞ্চম ঘোড়ার নাম পঞ্চ দেবতা! স্বপ্নটা আসলে ছিল দৈববাণী!
সেই বিকেলে সে অফিস থেকে ছুটি নিল। ব্যাংক
একাউন্ট থেকে টাকা তুলল পাঁচ হাজার ডলার। ঘোড়দৌড়ের বাজির মাঠে গিয়ে সে পঞ্চম বাজিকরের
কাছে গিয়ে বাজি ধরল: পাঁচ নম্বর ঘোড়দৌড়ের পাঁচ নম্বর ঘোড়া পঞ্চ দেবতার ওপর পাঁচ হাজার
ডলার বাজি। স্বপ্ন তো আর মিথ্যা হতে পারে না। সৌভাগ্যের সংখ্যা পাঁচ তো আর মিথ্যা হতে
পারে না। স্বপ্নটা আসলেই মিথ্যা ছিল না। ঘোড়াটা এসেছিল পঞ্চম হয়ে।
দ্বিতীয় গল্পটা সিঙ্গাপুরে ঘটেছিল অনেক
বছর আগে। একজন অস্ট্রেলিয়ান লোক বিয়ে করেছিল সিঙ্গাপুরের এক সুন্দরী চাইনীজ মেয়েকে।
যখন তারা সিঙ্গাপুরে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বেড়াতে আসলো, লোকটার শালারা তখন বিকেলে
ঘোড়দৌড়ের মাঠে যাচ্ছিল। তারা তাকেও যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো। লোকটি রাজি হলো। ঘোড়দৌড়ে
যাওয়ার আগে তারা একটা বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে সৌভাগ্যের প্রার্থনা করবে বলে
মনস্থির করলো। কিন্তু ছোট্ট সেই বিহারে পৌঁছে দেখল যে সেটা যেন জঞ্জালের স্তুপ। তাই
তারা ঝাড়– ও বালতি হাতে নিয়ে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করলো পুরো বিহারটা।
তারপর তারা তাদের বাতি জ্বালিয়ে সৌভাগ্যের প্রার্থনা করলো এবং ঘোড়দৌড়ের মাঠে গেল। কিন্তু
তারা বাজিতে শোচনীয়ভাবে হারল।
সে রাতে অস্ট্রেলিয়ান লোকটা একটা ঘোড়ার
স্বপ্ন দেখল। জাগার পরে তার স্পষ্ট মনে পড়ল ঘোড়ার নামটা। খবরের কাগজে দেখল যে সেদিন
বিকেলের ঘোড়দৌড়ে আসলেই সেই ঘোড়ার নাম আছে। সে তার শালাদের এই সুখবরটা জানালো। কিন্তু
তার শালারা কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করলো না। সিঙ্গাপুরের বিহার রক্ষাকারী চাইনীজ দেবতা
একজন বিদেশী অস্ট্রেলিয়ানকে জয়ী ঘোড়ার নাম বলে দেবে, এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তারা এটাকে
আমলেই নিল না।
অস্ট্রেলিয়ান লোকটা একাই ঘোড়দৌড়ে গেল,
সেই ঘোড়াটার উপরে বড় অংকের বাজি ধরল আর ঘোড়াটা জিতল।
বিহার রক্ষাকারী চাইনীজ দেবতা নিশ্চয়ই
অস্ট্রেলিয়ানদের পছন্দ করত। তার শালারা রাগে ফুঁসতে লাগল।
#ভয় কী- ৩৯
ভয় হচ্ছে ভবিষ্যতের কোন ভুল, দোষ বা অপ্রীতিকর
কোন কিছু খুঁজে পাওয়া। ভবিষ্যত যে কীরূপ অনিশ্চিত তা যদি আমরা মনে রাখতে পারি, তাহলে
আমরা আর কখনো চেষ্টা করতে যাবো না কী কী ঝামেলা হতে পারে। ভয়ের সেখানেই সমাপ্তি।
একবার ছোটবেলায় আমি দাঁতের ডাক্তারের
কাছে যাওয়ার ভয়ে আতংকিত ছিলাম। ঐদিন আমার ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল
কিন্তু আমি যেতে চাই নি। আমি বোকার মতো নিজেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু ডাক্তারের
কাছে পৌঁছে জানলাম যে আমার এপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়ে গেছে। এতেই বুঝলাম, ভয়টা যে কী মারাত্মক
সময় অপচয়কারক।
ভয় মিশে থাকে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায়। কিন্তু
প্রজ্ঞাকে কাজে না লাগালে ভয় আমাদেরকেই মেরে ফেলতে পারে। কুংফু নামে একটা পুরনো টেলিভিশন
সিরিজে এই ভয়টা তরুণ বৌদ্ধ শ্রমণ ছোট্ট ঘাসফড়িংকে প্রায় মেরে ফেলেছিল। ছোট্ট ঘাসফড়িংয়ের
আচার্য্য ছিল অন্ধ। সেই অন্ধ আচার্য্য একদিন তার শিষ্য ছোট্ট ঘাসফড়িংকে নিয়ে গেল বিহারের
পিছনের এক রুমে, যা সাধারণত তালাবদ্ধ থাকত। রুমের ভেতরে ছিল ছয় মিটার চওড়া একটি পুকুর,
যার মাঝামাঝি জায়গায় ছিল একটা ছোট কাঠের ব্রীজ। সেই আচার্য্য ছোট্ট ঘাসফড়িংকে সাবধান
করে দিল যেন পুকুরের কিনারা থেকে দূরে থাকে। কারণ পুকুরে পানি ছিল না, ছিল এসিড।
‘তোমাকে সাতদিন পরে পরীক্ষা করা হবে,’
ঘাসফড়িংকে বলা হলো।‘এই ছোট্ট কাঠের ব্রীজ পার হয়ে তোমাকে
পুকুরের ওপারে যেতে হবে। সাবধান! পুকুরের তলায় জমা হওয়া ঐ হাড়গোড়গুলো দেখতে পাচ্ছ তো?’
ঘাসফড়িং ভয়ে ভয়ে পুকুরের তলায় তাকাল এবং
অনেক হাড়গোড় দেখল।
‘ওগুলো তোমার মতো অনেক শ্রমণের হাড়গোড়।’
আচার্য্য ঘাসফড়িংকে সেই ভয়ংকর রুম থেকে
বাইরে নিয়ে এল। বিহারের উঠোনে ভিক্ষুরা একটা একই মাপের কাঠের ব্রীজ বানিয়ে সেটাকে দুটো
ইটের উপরে বসাল। সাত দিন ধরে ঘাসফড়িংয়ের সেই ব্রীজ হেঁটে পার হওয়া ছাড়া আর কোন কাজ
ছিল না। কাজটা সহজ। কয়েকদিনের মধ্যেই সে নিখুঁতভাবে
ছোট্ট ব্রীজটা হেঁটে পার হতে পারত, এমনকি চোখ বাঁধা অবস্থায়ও পার হয়ে যেতে পারত অবলীলায়।
এবার পরীক্ষার পালা আসল।
আচার্য্য ঘাসফড়িংকে নিয়ে গেল এসিডের পুকুরের
রুমে। পুকুরের তলায় শ্রমণগুলোর হাড়গোড়গুলো চক চক করছিল। ঘাসফড়িং ব্রীজের এক প্রান্তে
উঠে দাঁড়ালো এবং আচার্য্যরে দিকে তাকালো। ‘হাঁটো,’ তাকে আদেশ দেওয়া হলো।
এসিডের পুকুরের উপরে যে ব্রীজটা, তা উঠোনের
সেই একই মাপের ব্রীজের চেয়ে অনেক অনেক সংকীর্ণ। ঘাসফড়িং হাঁটতে শুরু করল কিন্তু তার
পদক্ষেপ নড়বড়ে হয়ে উঠল। সে টলতে শুরু করল। অর্ধেক পথও পেরোয় নি, এরই মাঝে সে আরো ভীষণভাবে
দুলে উঠল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে এসিডের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়
একটা বিজ্ঞাপন বিরতি হলো।
অনেক বিরক্তি চেপে সেই জঘন্য বিজ্ঞাপনগুলো
সহ্য করেছিলাম আমি। মনে সবসময় ভাবনা ছিল বেচারা ঘাসফড়িং কী করে নিজেকে বাঁচাবে।
বিজ্ঞাপন শেষ হলো। আমরা আবার ফিরে এলাম
যেখানে ঘাসফড়িং ব্রীজের মাঝপথে গিয়ে ভয়ে আত্মবিশ্বাস হারাতে বসেছে। আমি তাকে টলমল পায়ে
পা বাড়াতে দেখলাম। এরপর সে দুলে উঠলো আর পুকুরে পড়ে গেল।
ছোট্ট ঘাসফড়িংয়ের পুকুরে পড়ার শব্দ শুনে
বৃদ্ধ অন্ধ আচার্য্য হেসে উঠলো। এটা এসিড নয়, ছিল কেবল পানি। হাড়গোড়গুলো ফেলে দেওয়া
হয়েছিল ‘স্পেশাল ইফেক্ট’ হিসেবে, গল্পটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার
জন্য। সেগুলোই ঘাসফড়িংকে বোকা বানিয়েছিল, আর বোকা বনে গিয়েছিলাম আমিও।
‘কে তোমাকে ফেলে দিয়েছিল?’ আচার্য্য জিজ্ঞেস
করলো, ‘ভয়ই তোমাকে ফেলে দিয়েছিল, হে ছোট্ট ঘাসফড়িং, কেবল ভয়।’
--------------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।