দ্বিতীয় অধ্যায়: ভালোবাসা
ও অঙ্গীকার
#নিঃস্বার্থ
ভালোবাসা- ২১
আমার
বয়স তখন তেরো, আমার বাবা আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে এমন একটা কথা বললেন, যা পরবর্তীতে
আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল। আমরা ছিলাম শুধু দুজন, লন্ডনের অন্যতম দরিদ্র একটা এলাকার
রাস্তার ধারে, তার বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে পড়া গাড়ির মধ্যে। তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন:
‘বৎস, তুমি জীবনে যাই করো না কেন, এটা জেনে রেখো। আমার ঘরের দরজা তোমার জন্য সবসময়
খোলা থাকবে।’
আমি তখন কেবল কিশোর। আমি ঠিক বুঝি নি
তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন। তবে আমি জানতাম এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, তাই আমি তা মনে
রেখেছিলাম। আমার বাবা এর তিন বছর পরে মারা যান।
যখন আমি উত্তর পূর্ব থাইল্যান্ডে এসে
ভিক্ষু হলাম, আমি বাবার সেই কথাগুলো ভেবে দেখলাম। তখন আমাদের বাড়ি বলতে ছিল লন্ডনের
দরিদ্র এলাকায় একটা ছোট ফ্ল্যাট। সেটা এমন ছিল না যে খোলা পাওয়া যাবে সবসময়। কিন্তু
পরে বুঝলাম, বাবা আসলে সেটা বুঝাতে চান নি। আমার বাবার কথার মাঝে লুকানো ছিল আমার জানামতে
সবচেয়ে সেরা ভালোবাসার প্রকাশ, যেন কাপড়ে মোড়ানো কোন অমূল্য রত্নের মতো: ‘বৎস, তুমি
জীবনে যাই করো না কেন, এটা জেনে রেখো। আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে।’
আমার বাবা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছিলেন।
কোন পিছুটান নেই সেখানে, নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ। আমি তার ছেলে, সেটাই যথেষ্ট। এটি ছিল
অপূর্ব। এটি ছিল সত্যি। তিনি আসলেই সেটা বুঝিয়েছিলেন।
কোন ‘যদি’
না রেখে আপনার হৃদয়ের দরজা কারো জন্য খুলে দেওয়া, এমন কথা বলতে সাহস লাগে, জ্ঞান লাগে।
আমরা হয়তো ভাবতে পারি, তারা আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নেবে, কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়,
অন্তত আমার অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। যখন আপনি অন্যের কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পান, সেটা
হয় অমূল্য একটা রত্ন উপহার পাওয়ার মতো। আপনি এটাকে সযত্নে আগলে রাখেন, হৃদয়ের কাছাকাছি
রেখে দেন, যেন না হারায়। যদিও সেই সময়ে আমি বাবার কথার অর্থ আংশিকমাত্র বুঝেছিলাম,
তবুও আমি এমন লোককে মনে আঘাত দেওয়ার সাহস করি নি। যদি আপনি আপনার কোন কনিষ্ঠজনকে এমন
কথা দেন, যদি আপনি সত্যিই সেরকম ভাবেন, যদি সেই কথাগুলো আসে আপনার হৃদয় থেকে, তাহলে
সেই ব্যক্তি আপনার ভালোবাসা নিয়ে উপরেই উঠবে, নিচে নামবে না।
#আপনার
হৃদয়ের দরজা খুলে দেওয়া- ২২
কয়েক
শতাব্দী আগে এশিয়ার কোন এক জঙ্গলের গুহার মধ্যে সাতজন ভিক্ষু বাস করত। তারা আগের গল্পে
উল্লেখিত নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ধ্যান করত। সেখানে ছিল প্রধান ভিক্ষু, তার ভাই ও তার
সেরা বন্ধু। চতুর্থজন ছিল প্রধান ভিক্ষুর শত্রু, আর তাদের দুজনের মধ্যে কিছুতেই ভালো
সম্পর্ক থাকতো না। পঞ্চম ভিক্ষুটি একজন খুব বুড়ো ভিক্ষু, যে এমন বুড়ো হয়ে গিয়েছিল যে
এখন মরে তো তখন মরে এমন অবস্থা। ষষ্ঠ ভিক্ষুটি ছিল অসুস্থ, এমন অসুস্থ যে তারও প্রাণ
যায় যায় অবস্থা। সপ্তম ভিক্ষুটি ছিল সবচেয়ে অকেজো ভিক্ষু। যখন ধ্যান করার কথা, তখন
সে নাক ডেকে ঘুমাত। সে তার বন্দনার লাইনগুলো মনে রাখতে পারতো না, আর পারলেও বন্দনা
করত বেতালে, বেসুরে। সে এমনকি চীবরও পরতে পারতো না ঠিকমত। কিন্তু অন্যরা তাকে সহ্য
করতো এবং ধৈর্যের শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিত। একদিন ডাকাতদের দল গুহাটাকে
খুঁজে পেল। জায়গাটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাই তারা এটাকে তাদের ঘাঁটি
বানাতে চাইলো। তারা সমস্ত ভিক্ষুদেরকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। সৌভাগ্যক্রমে প্রধান
ভিক্ষু একজন প্রভাবশালী বক্তা ছিল। সে এমনভাবে ব্যবস্থা করল- কীভাবে ব্যবস্থা করল তা
আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না- যে ডাকাতেরা সব ভিক্ষুকে যেতে দিল, কেবল একজন বাদে, যাকে মেরে
ফেলা হবে। তাকে মেরে ফেলা হবে একটা হুঁশিয়ারি হিসেবে, যাতে অন্যরা কাউকে গুহার অবস্থান
বলে না দেয়। প্রধান ভিক্ষুটির এর বেশি করার জো ছিল না।
প্রধান ভিক্ষুকে কয়েক মিনিট একা থাকতে
দেওয়া হলো, যাতে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কাকে বলি দেবে সে, যাতে অন্যরা মুক্তি পায়।
যখন আমি শ্রোতাদেরকে এই গল্পটা বলি, এই
পর্যায়ে এসে আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করি,‘তো, কী মনে হয় আপনাদের? প্রধান ভিক্ষু
কাকে বেছে নিয়েছিল?’
এমন প্রশ্ন শুনে যাদের চোখ ঘুমে ঢুলু
ঢুলু হয়ে আসছিল, তারা একটু নড়েচড়ে বসে আর যারা ঘুমিয়ে গিয়েছিল তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
আমি তাদেরকে আবার স্মরণ করিয়ে দিই যে সেখানে আছে সাতজন ভিক্ষু। প্রধান ভিক্ষু, তার
ভাই, তার শ্রেষ্ঠ বন্ধু, তার শত্রু, এক বুড়ো ভিক্ষু, এক অসুস্থ ভিক্ষু (দুজনেরই মর
মর অবস্থা), আর একজন অকেজো হাবাগোবা ভিক্ষু। কাকে সে বেছে নিয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?
কেউ কেউ তার শত্রুকে বলে। আমি বলি, ‘না।’
‘তার ভাই?’
‘ভুল।’
সবসময়ই দেখি, সেই অকেজো ভিক্ষুটির নাম
উঠে আসে খরচের তালিকায়-কেমন লোক আমরা! খানিক মজা করার পরে আমি উত্তরটা বলে দিই, প্রধান
ভিক্ষু কাউকেই বেছে নিতে পারে নি।
সে তার ভাইকে যেমন ভালোবাসত, ঠিক তেমনই
ভালোবাসত তার বন্ধুকে, বেশিও নয়, কমও নয়। ঠিক এমনই ভালোবাসা ছিল তার শত্রুর প্রতি,
বুড়ো ভিক্ষুটির প্রতি, অসুস্থ ভিক্ষুটির প্রতি, এমনকি অকেজো ভিক্ষুটির প্রতিও। সে সেই
ভালোবাসার কথাগুলো পরিপূর্ণভাবে চর্চা করেছে: আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা
থাকবে, তুমি যাই করো না কেন, যেই হও না কেন।
প্রধান ভিক্ষুটির হৃদয়ের দরজা সবার জন্য
উন্মুক্ত ছিল। নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ, বৈষম্যহীন, মুক্ত ও উদার ভালোবাসা। আর সবচেয়ে বড়
কথা, অন্যদের প্রতি তার যেমন ভালোবাসা, ঠিক তেমন ভালোবাসা ছিল তার নিজের প্রতিও। তার
হৃদয়ের দরজা তার নিজের জন্যও খোলা ছিল। একারণেই সে বলির জন্য অন্যদেরকে তো বেছে নিতে
পারে নি, নিজেকেও বেছে নিতে পারে নি।
আমি
আমার শ্রোতাদের মধ্যে থাকা ইহুদি আর খ্রিস্টানদেরকে স্মরণ করিয়ে দিই যে, তাদের ধর্মীয়
গ্রন্থ এই কথা বলে- ‘প্রতিবেশিকে নিজের মতোই ভালোবাসো’ নিজের চেয়ে কমও নয়, বেশিও নয়,
ঠিক নিজের সমান করে। এর মানে হচ্ছে, নিজেকে আপনি যেমন ভাবেন, অন্যকেও তেমন ভাবা, আর
নিজেকেও অন্যদের মতো ভাবা।
কেন এমন হয় যে, শ্রোতাদের বেশির ভাগই
মনে করে যে প্রধান ভিক্ষুটি নিজেকেই বেছে নেবে বলির জন্য? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন
কেন, যেখানে আমরা সবসময় নিজেকে বলি দিচ্ছি আর এটাকেই ভালো চোখে দেখা হচ্ছে? কেন আমরা
নিজেদের প্রতি সবচেয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠি আর অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেদেরকেই শাস্তি
দিই? এর একটাই কারণ, একই কারণ: আমরা এখনো শিখি নি কীভাবে নিজেদেরকে ভালোবাসতে হয়।
যদি অন্যকে একথা বলা আপনার পক্ষে কঠিন
হয়, ‘তুমি যাই করো না কেন, আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা’,
তাহলে এর থেকে শতগুণে কঠিন হবে নিজেকে এরূপ বলা, ‘আমি। যতদূর মনে পড়ে যে একজনের সাথে
আমি সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছি, সে হচ্ছে আমি নিজেই। আমার হৃদয়ের দরজা আমার জন্যও সবসময়
খোলা। আমি যাই করি না কেন, সেটা আমার জন্য ব্যাপার নয়। এসো, ভেতরে এসো।’
নিজেদেরকে ভালোবাসা বলতে আমি এটাকেই বুঝাই!
এটাকে বলা হয় ক্ষমা। এটা হচ্ছে অপরাধবোধের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসা। এটা
হচ্ছে নিজেকে নিয়ে শান্তিতে সহাবস্থান করা। আর আপনি যদি নিজেকে এই কথাগুলো বলার মতো
সাহস আনেন, নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলে সেই কথাগুলো গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনি
সেই অন্তর্নিহিত ভালোবাসা নিয়ে উপরেই উঠবেন, তলিয়ে যাবেন না।
আমাদের সবারই একদিন নয় একদিন নিজেদের
প্রতি এই কথাগুলো বলতে হবে। মজা করার জন্য নয়, খেলার জন্য নয়, সত্যি সত্যিই, আন্তরিকভাবে,
সততার সাথে বলতে হবে।
যখন আমরা এটা করি, যেন আমাদের একটা অংশ,
যাকে বের করে দেওয়া হয়েছে, যে বাইরের ঠাণ্ডায় এতদিন ধরে পড়ে ছিল, সে যেন এখন বাড়ি ফিরেছে।
আমরা এখন অনুভব করি একত্ব, সম্পূর্ণতা। সুখী হওয়ার জন্য এখন আর আমাদের কোন পিছু টান
নেই। যখন আমরা নিজেদেরকে এভাবে ভালোবাসব, তখনই আমরা জানতে পারব, অন্যকে ভালোবাসা বলতে
সত্যিকার অর্থে কী বুঝায়, যা বেশিও নয়, কমও নয়।
আর দয়া করে মনে রাখুন যে, নিজেকে এমন
ভালোবাসা দিতে গিয়ে আপনাকে অত নিখুঁত হতে হবে না, অত নির্দোষও হতে হবে না। যদি আপনি
পরিপূর্ণতার জন্য অপেক্ষা করেন, নিখুঁত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন, তা কখনো আসবে না।
আমরা যা করেছি, করেছি-তা নিয়েই আমাদের হৃদয়ের দরজা খুলে দিতে হবে নিজেদের জন্য। যখন
আমরা ভেতরে প্রবেশ করব, তখনই আমরা পরিপূর্ণ।
লোকজন প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, যখন প্রধান
ভিক্ষু ডাকাতদলকে বললো যে সে কাউকে বেছে নিতে অক্ষম, তখন সেই সাতজন ভিক্ষুর কপালে কী
ঘটেছিল।
এই গল্পটা আমি অনেক বছর আগে শুনেছিলাম:
সেখানে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা বলা হয় নি। আমি যতদূর বলেছি, সেখানেই গল্পটির সমাপ্তি।
কিন্তু আমি জানি এরপরে কী হয়েছিল। সেটা আমি ভেবে ভেবে বের করে নিয়েছি। যখন প্রধান ভিক্ষুটি
ডাকাতদলকে ব্যাখ্যা করে বললো যে সে কেন নিজেকে অথবা অন্যদের কাউকে বলি দেওয়ার জন্য
বেছে নিতে পারে নি, আর তাদেরকে ভালোবাসা ও ক্ষমার অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছে, যেমনটি আমি আপনাদেরকে
বুঝিয়ে দিলাম, তখন ডাকাতেরা সবাই এমন মুগ্ধ ও উৎসাহিত হলো যে তারা কেবল ভিক্ষুদেরকেই
যেতে দিল না, নিজেরাও ভিক্ষু হয়ে গেল!
------------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।