পঞ্চম অধ্যায়: সুখ সৃষ্টি করা
#দুই আঙুলের হাসি- ৭৫
প্রশংসা আমাদেরকে টাকা বাঁচিয়ে দেয়, সম্পর্ককে
সমৃদ্ধ করে এবং সুখের সৃষ্টি করে। তাই আমাদের প্রশংসার চর্চাকে আরো বেশি করে চারদিকে
ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। আমরা যাকে প্রশংসা করতে সবচেয়ে কার্পণ্য করি, সে হলো নিজেকে। আমি
এই বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছিলাম যে, যারা নিজেদেরকে প্রশংসা করে, তারা আসলেই মাথামোটা
লোক। ব্যাপারটা সেরকম নয়। তারা বরং মহান হৃদয়ের অধিকারী হয়ে ওঠে। আমাদের ভালো গুণগুলোকে
নিজেদের কাছে প্রশংসা করলে এই গুণগুলো আরো সুদৃঢ় হয়ে ওঠে।
যখন আমি একজন ছাত্র ছিলাম, আমার প্রথম
ধ্যানের শিক্ষক আমাকে বাস্তব কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে লাগলেন
আমি সকালে উঠে সবার আগে কী করি।
‘বাথরুমে যাই।’
আমি বললাম।
’তোমাদের বাথরুমে কি আয়না আছে?’ তিনি
জিজ্ঞেস করলেন।
’অবশ্যই আছে।’
’ভালো,’ তিনি বললেন, ‘আমি চাই, এখন থেকে
প্রত্যেক সকালে দাঁত মাজার আগেই তুমি আয়নায় নিজেকে দেখবে এবং নিজের দিকে তাকিয়ে হাসবে।’
‘স্যার!’ আমি প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলাম,
‘আমি একজন ছাত্র। মাঝে মাঝে অনেক দেরীতে ঘুমাই, আর সকালে উঠে শরীরটা ভালো বোধ করি না।
কোন কোন সকালে আয়নায় নিজেকে দেখতেই ভয় পাই, হাসা তো দূরের কথা!’
তিনি হাসলেন, আমার দিকে চেয়ে বললেন,
‘যদি স্বাভাবিক হাসি হাসতে না পারো, তাহলে তোমার তর্জনী দুটো ঠোঁটের দুকোণায় রেখে
উপরে ঠেলে দেবে।’ বলে তিনি আমাকে সেটা করে দেখালেন।
তাকে হাস্যকর দেখাচ্ছিল। আমি হেসে উঠলাম।
তিনি আমাকে সেটা চেষ্টা করতে বললেন। আমিও তাই করলাম।
পরেরদিন সকালে আমি বিছানা থেকে নিজেকে
টেনে তুললাম আর টলতে টলতে বাথরুমে ঢুকলাম। সেখানে আয়নায় নিজেকে দেখে ‘উহ্!’ করে আর্তনাদ
করে উঠলাম। নিজেকে এমন চেহারায় দেখা কোন সুখকর দৃশ্য ছিল না। এমন অবস্থায় কোন স্বাভাবিক
হাসি আসে না। তাই আমি তর্জনী উঁচিয়ে দুঠোঁটের কোণা ধরে উপরে ঠেলে দিলাম। আমি আয়নায়
এই বোকা ছাত্রকে দেখলাম উদ্ভট চেহারা করে আছে। তা দেখে আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না।
স্বাভাবিক হাসি আসাতে এবার দেখলাম আয়নার ছাত্রটা আমাকে দেখে হাসছে। তাই আমি আরো বেশি
হাসলাম। আয়নার মানুষটা আরো বেশি হাসল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা পরস্পরকে দেখে হাসিতে
ফেটে পড়লাম।
আমি দুবছর ধরে প্রত্যেক সকালে এই অভ্যাসটা
করেছিলাম। প্রত্যেক সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীর যেমন লাগে লাগুক, আমি তাড়াতাড়ি আয়নায় নিজেকে
দেখে হাসতাম, সাধারণত দুটো আঙুলের সাহায্য নিয়ে। লোকজন বলে আমি নাকি ইদানিং প্রচুর
হাসি। সম্ভবত আমার মুখের চারপাশের মাংসপেশীগুলো অনেকটা সেই হাস্যকর অবস্থায় আটকে গেছে।
আমরা এই দুই আঙুলের কৌশলটা দিনের যে কোন
সময় কাজে লাগাতে পারি। এটা বিশেষ করে কার্যকরী হয় যখন আমরা অসুস্থ, ত্যক্ত বিরক্ত অথবা
হতাশ বোধ করি। হাসি আমাদের রক্তে এনডোরফিনস্ নিঃসরণ করায় বলে প্রমাণিত হয়েছে, যা আমাদের
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করে এবং আমাদেরকে সুখী হওয়ার অনুভূতি দেয়।
এটা আমাদেরকে দেয়ালের ৯৯৮টি ভালো ইট দেখতে
সাহায্য করে, কেবল ২টি খারাপ ইট নয়। আর হাসির কারণে আমাদেরকে সুন্দর দেখায়। এজন্যই
আমি পার্থে আমাদের বৌদ্ধ বিহারটাকে মাঝে মাঝে বলি, ‘আজান ব্রাহ্মের সৌন্দর্য সেলুন’।
#অমূল্য
শিক্ষা - ৭৭
আমাকে জানানো হয়েছিল যে হতাশা একটি শত
কোটি ডলারের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা সত্যিই হতাশার! লোকজনের হতাশাকে পুঁজি
করে বড়লোক হওয়াটা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয় না আমার।
আমাদের কট্টরপন্থী ঐতিহ্য অনুযায়ী, ভিক্ষুরা
টাকা নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। আমরা আমাদের বক্তৃতার জন্য কখনোই কোন সম্মানী দাবি
করি না। পরামর্শ বা অন্য কোন সহায়তা দিতে গিয়েও কোন ফি নিই না।
একবার এক আমেরিকান মহিলা আমাদের এক সতীর্থ
ভিক্ষুকে ফোন করল। ভিক্ষুটি ছিল বিখ্যাত ধ্যান প্রশিক্ষক। মহিলাটি তাকে জিজ্ঞেস করে
জানতে চাইল কী করে ধ্যান করতে হয়।
‘আমি শুনেছি আপনি ধ্যান করা শেখান।’
সে টেনে টেনে বলে উঠল ফোনে।
’জ্বি ম্যাডাম, শেখাই।’
ভিক্ষুটি নম্রভাবে জবাব দিল।
’কত টাকা নেন আপনি?’ সে এবার আসল কথায়
আসলো।
’কিছুই নিই না, ম্যাডাম।’
’তার মানে আপনি ভালো নন।’
এই বলে মহিলাটি ফোন নামিয়ে রাখল।
কয়েক বছর আগে আমিও এক পোলিশ-আমেরিকান
ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এমন একটা ফোন পেয়েছিলাম।
‘আপনার বুড্ডিস্ট সেন্টারে কি আজকে সন্ধ্যায়
কোন দেশনার পালা আছে?’ মহিলা জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ ম্যাডাম। এটি রাত ৮টায় শুরু হয়।’
আমি তাকে জানিয়ে দিলাম।
’কত টাকা দিতে হবে আপনাকে?’ সে জিজ্ঞেস
করলো।
’কিছুই দিতে হবে না, ম্যাডাম। এটি ফ্রি।’
আমি তাকে ব্যাখ্যা করে দিলাম। ওপাশে খানিকক্ষণ নিরবতা।
এরপরে সে জোরে জোরে বলল, ‘আপনি আমার কথা
বোঝেন নি। সেই দেশনা শোনার জন্য আপনাকে আমার কত টাকা দিতে হবে?’
‘ম্যাডাম, আপনাকে কোন টাকা দিতে হবে না।
এটি ফ্রি।’ আমি তাকে শান্ত করার সুরে
বললাম।
’শুনুন!’ সে ফোনে চিৎকার করে বলল, ‘আমি
ডলারের কথা বলছি, সেন্টের কথা বলছি। ভেতরে আসার জন্য ঠিক কী পরিমাণ ডলার কাশতে হবে
আমাকে?’
‘ম্যাডাম, আপনাকে কোন কিছুই কেশে বের
করতে হবে না। আপনি সোজা ভেতরে ঢুকে যাবেন। পেছনে বসবেন। যখন খুশি চলে যাবেন। কেউই আপনার
নামধাম জিজ্ঞেস করবে না। কোন লিফলেটও দেওয়া
হবে না। দরজায় কোন চাঁদাও চাওয়া হবে না। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।’
এবার বেশ দীর্ঘক্ষণ বিরতি। এরপর সে জিজ্ঞেস
করলো, আন্তরিকভাবেই জানতে চাইলো, ‘তো, তাহলে আপনারা এসব করে কী পান?’
‘সুখ, ম্যাডাম,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘সুখ!’
আজকাল যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই
শিক্ষার মূল্য কত, আমি কখনই বলি না এগুলো ফ্রি। আমি বলি, এগুলো অমূল্য।
------------------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।