কুশল-ধর্ম প্রশ্ন
১৬। রাজা বলিলেন-
“ভন্তে! আপনি এখন যে
বলিলেন “অন্যান্য কুশল ধর্ম হেতু'
সেই কুশল ধর্মসমূহ কি
প্রকার?”
“মহারাজ! শীল, শ্রদ্ধা, বীর্য,
স্মৃতি ও সমাধি ইহারাই
সেই কুশল ধর্ম।”
শীলের লক্ষণ
“ভন্তে! শীলের লক্ষণ কি?"
“মহারাজ! সমস্ত কুশল ধর্মের প্রতিষ্ঠাই
শীলের লক্ষণ। ইন্দ্রিয়, বল, বোধ্যঙ্গ, মার্গাঙ্গ,
স্মৃতি-উপস্থান, সম্যক প্রধান, ঋদ্ধিপাদ, ধ্যান, বিমোক্ষ, সমাধি ও সমাপত্তির শীলই
প্রতিষ্ঠা। মহারাজ! শীলে প্রতিষ্ঠিত সাধক
শীলকে আশ্রয় করেন, শীলের উপর ভিত্তি স্থাপন
করিয়া শ্ৰদ্ধন্দ্রিয়, বীর্যেন্দ্রিয়, স্মৃতীন্দ্রিয়, সমাধীন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞেন্দ্রিয়- এই
পঞ্চেন্দ্রিয় ভাবনা করেন ও বৃদ্ধি
করেন; ইহাতে সর্ববিধ কুশল ধর্ম পরিহীন
হয় না।”
“উপমা প্রদান করুন।"
“যেমন মহারাজ! যে
কোন বীজ-গাছপালা বৃদ্ধি,
বিস্তার ও বৈপুল্যপ্রাপ্ত হয়;
উহারা সকলেই পৃথিবীকে আশ্রয় করিয়া বৃদ্ধি, বিস্তার ও বৈপুল্যপ্রাপ্ত হয়।
সেই প্রকার সাধক শীলকে আশ্রয়
করিয়া শীলে প্রতিষ্ঠিত হইয়া
শ্রদ্ধেন্দ্রিয়, বীর্যেন্দ্রিয়, স্মৃতীন্দ্রিয়, সমাধীন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞেন্দ্রিয়- এই
পঞ্চেন্দ্রিয়ের ভাবনা করেন।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।"
“যেমন মহারাজ! যে
কোন শক্তি-সাধ্য কর্ম করা যায়,
তাহা পৃথিবীকে আশ্রয় করিয়া, পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হইয়া করা হয়, সেইরূপ
যোগী শীলকে আশ্রয় করিয়া শীলে প্রতিষ্ঠিত হইয়া
শ্রদ্ধেন্দ্রিয়, বীর্যেন্দ্রিয়, স্মৃতীন্দ্রিয়, সমাধীন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞেন্দ্রিয়- এই
পঞ্চেন্দ্রিয়ের ভাবনা করেন।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
"যেমন, মহারাজ! নগর-শিল্পী নগর-নির্মাণ মানসে প্রথমে সেই স্থান পরিষ্কার
করায় খুঁটি-কন্টক অপসারণ করায় এবং ভূমি সমতল
করায়, তৎপর রাস্তা ও
চৌরাস্তার নক্সা ঠিক করিয়া নগর
নির্মাণ করে, সেইরূপ যোগী।
শীলকে আশ্রয় করিয়া------- ভাবনা করেন।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।"
“যেমন মহারাজ! উল্লম্ফলনকারী
স্বীয় ক্রীড়া দেখাইবার মানসে পৃথিবী কৰ্ষণ করিয়া, কাকর পাথর অপসারণ
করিয়া, ভূমি সমতল করিয়া
কোমল মাটিতে ক্রীড়া প্রদর্শন করে, সেইরূপ যোগী
শীলকে আশ্রয় করিয়া ---------- ভাবনা করেন। মহারাজ! ভগবান ইহাও বলিয়াছেন- “যেই
জ্ঞানী মানুষ শীলে প্রতিষ্ঠিত হইয়া
সমাধি ও প্রজ্ঞার উন্নতি
সাধন করেন। সেই দৃঢ়বীর্য, প্রতিভাবান
ভিক্ষু এই (তৃষ্ণারূপ) জটা
ছেদন করিতে পারেন।
সেই সর্বোত্তম প্রাতিমোক্ষ
শীলরাশি ধরণীর ন্যায় প্রাণিগণের প্রতিষ্ঠা (আধার), কুশলাভিবৃদ্ধির ইহা মূল এবং
সমস্ত বুদ্ধ শাসনের ইহা মুখ-স্বরূপ।”
শ্ৰদ্ধার লক্ষণ
১৭ । রাজা
বলিলেন- “ভন্তে নাগসেন! শ্রদ্ধার লক্ষণ কি?"
“মহারাজ! চিত্তের প্রসন্নতা সাধন ও উৎসাহ
উৎপাদন শ্রদ্ধার লক্ষণ।"
“ভন্তে! চিত্তের প্রসন্নতা সাধন কি প্রকারে
শ্রদ্ধার লক্ষণ হয়?"
“মহারাজ! চিত্তে শ্রদ্ধা উৎপন্ন হইলে নীবরণ (বাধা)
সমূহ বিদুরিত হয়, নীবরণহীন চিত্ত
স্বচ্ছ, প্রসন্ন ও নির্মল হয়।
এইরূপেই মহারাজ! চিত্তের প্রসন্নতা সাধন শ্রদ্ধার লক্ষণ।”
“উপমা প্রদান করুন।"
“যেমন মহারাজ! চক্রবর্তী
রাজা যখন চতুরঙ্গিনী সেনা
সহ দীর্ঘ পথ যাত্রার সময়
সামান্য জল অতিক্রম করেন,
তখন সেই জল হাতি,
ঘোড়া, রথ ও পদাথিক
সৈন্য দ্বারা ক্ষুব্ধ, আবিল, আলোড়িত ও কর্দমাক্ত হইয়া
যায়। জল অতিক্রম করার
পর রাজা ভৃত্যদিগকে আদেশ
করেন- “ওহে! পানীয় জল
আনয়ন কর, আমি জলপান
করিব।" রাজার নিকট যদি জল
পরিষ্কারক মণি (ফিটকারি) থাকে
তবে ভৃত্যগণ ‘হা দেব!’ বলিয়া
প্রতিশ্রুতি দিয়া সেই মণি জলে
নিক্ষেপ করে। উহা জলে
নিক্ষিপ্ত হইলেই সত্বর শঙ্খ শৈবাল-পানা
বিদুরিত হয় এবং কর্দম
বসিয়া যায়। জল স্বচ্ছ, প্রসন্ন
ও নির্মল হয়। তৎপর রাজার
নিকট জল আনিয়া ভৃত্যেরা
বলিল- 'দেব জল পান
করুন।' মহারাজ! এই চিত্তও জলের
ন্যায়। সাধকগণের ন্যায়। শঙ্খ-শৈবাল-পানা
ও কর্দমের ন্যায় এই চিত্তের ক্লেশগুলি।
শ্রদ্ধা হইল জলশোধক মণি।
জলশোধক মণি জলে নিক্ষিপ্ত
হইবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্খ-শৈবাল-পানা
বিদুরিত হয়, কর্দম। তলাইয়া
যায়, জল স্বচ্ছ, প্রসন্ন
ও নির্মল হয়। সেইরূপ মহারাজ!
মনে শ্রদ্ধা উৎপন্ন হইলে নীরবণ রাশি
(সাময়িকভাবে) বিদুরিত হয়, নীবরণ-মুক্ত
চিত্ত স্বচ্ছ, প্রসন্ন হয়। এইরূপেই মহারাজ!
চিত্তের প্রসন্নতা সাধন শ্রদ্ধার লক্ষণ।"
১৮ । “ভন্তে!
মনে উৎসাহ সৃষ্টি কি প্রকারে শ্রদ্ধার
লক্ষণ হয়?”
"যেমন মহারাজ! কোন
যোগী অপর সাধকদের চিত্তকে
বিমুক্ত দেখিয়া। স্বয়ং স্রোতাপত্তি ফল, সকৃদাগামী ফল
, অনাগামী ফল, কিংবা অর্হত্ত্ব
পদের জন্য আশ্বস্ত ও
উৎসাহিত হয় এবং অপ্রাপ্তের
প্রাপ্তির নিমিত্ত, অনুপলদ্ধের উপলব্ধির নিমিত্ত, অপ্রত্যক্ষের প্রত্যক্ষের নিমিত্ত করেন, আত্মনিয়োগ করেন, এইরূপেই মহারাজ! মনে উৎসাহ সৃষ্টি
শ্রদ্ধার লক্ষণ।"
“উপমা প্রদান করুন।“
“মহারাজ! পাহাড়ের উপর প্রবল বর্ষণ
হইলে সেই জল নিম্নদিকে
প্রবাহিত হইয়া পর্বতের গুহা, গহুর, শাখা-নদী-সমূহ
পূর্ণ করিয়া অবশেষে নদীকে পূর্ণ করে। নদী দুই
কুল প্লাবিত করিয়া প্রবাহিত হয়। তখন সেখানে
অনেক লোক আসিয়া উপস্থিত
হয়। তাহারা নদীর গভীরত্ব বা
অগভীরত্ব না জানার জন্য ভীত-সন্ত্রস্ত
হইয়া তীরে অবস্থান করে।
তখন অপর এক সাহসী
ব্যক্তি তথায় আসিয়া উপনীত হয়। সে নিজের
সাহস ও শক্তি পর্যালোচনা
করিয়া দৃঢ়ভাবে কোমর বাধিয়া এবং
সাঁতার দিয়া অপর তীরে উত্তীর্ণ
হইল। উহাকে উত্তীর্ণ হইতে দেখিয়া অপর
লোকেরাও সন্তরণ করিয়া নদী পার হইয়া
গেল। মহারাজ! সেইরূপে সাধক অপর যোগীদের
চিত্তকে মুক্ত দেখিয়া স্বয়ং সেই পদ প্রাপ্তির
নিমিত্ত প্রবল উৎসাহ লাভ করেন, প্রযত্ন
ও পরিশ্রম করেন। এইরূপে মনে উৎসাহ-উৎপাদন
শ্রদ্ধার লক্ষণ। সংযুক্তনিকায়ে ভগবান ভাষণে ইহাও বিবৃত করিয়াছেন
শ্রদ্ধা দ্বারা (দুঃখ) স্রোত ও অপ্রমত্ততা দ্বারা
(সংসার) সাগর পার হওয়া
যায়। বীর্য দ্বারা দুঃখমুক্তি হয় এবং প্রজ্ঞা
দ্বারা পরিশুদ্ধি হয়।"
“ভন্তে নাগসেন! আপুনি সুদক্ষ।"
বীর্যের লক্ষণ
১৯। “রাজা বলিলেন-
“ভন্তে নাগসেন! বীর্যের লক্ষণ কি?”
“উপস্তম্ভণ
বা দৃঢ়ীকরণ বীর্যের লক্ষণ। বীর্য দ্বারা দৃঢ়ীকৃত যাবতীয় কুশলধর্মের পরিহাণি হয় না!"
“উপমা প্রদান করুন।"
"যেমন মহারাজ! অল্পসংখ্যক
সেনাকে বহুসংখ্যক সেনা পরাজিত করিল।
তৎপর রাজা ইহা পর্যবেক্ষণ
করিয়া আর ও সৈন্য
প্রেরণ করেন এবং স্বীয়
অল্পসংখ্যক সেনাকে পশ্চাৎ হইতে সাহায্য প্রদান
করেন। তাহাদের সহিত সম্মিলিত হইয়া
পূর্বোক্ত স্বল্পসংখ্যক সৈন্য বৃহৎসংখ্যক সৈন্যকে পরাজিত করে। সেইরূপই মহারাজ!
বীর্য উপস্তম্ভন লক্ষণযুক্ত। বীর্যদ্বারা দৃঢ়ীকৃত যাবতীয় কুশল-ধর্মের পরিহাণি
হয় না। মহারাজ! ভগবান
ইহাও ঘোষণা করিয়াছেন। “ভিক্ষুগণ! বীর্যবান আর্য-শ্রাবক পাপ
ত্যাগ করেন, পূণ্য বৃদ্ধি করেন, দোষযুক্ত বিষয় ত্যাগ করেন, নির্দোষ বিষয় গঠন করেন; পবিত্রভাবে
স্বীয় জীবন যাপন করেন।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি সুদক্ষ।
স্মৃতির লক্ষণ
২০। “রাজা বলিলেন-
“ভন্তে নাগসেন! স্মৃতির লক্ষণ কি?”
“মহারাজ! যথার্থ স্মরণ ও উপগ্রহণ স্মৃতির
লক্ষণ।”
“ভন্তে! কি প্রকারে যথার্থ
স্মরণ স্মৃতির লক্ষণ হয়?”
“মহারাজ! উৎপদ্যমান স্মৃতি কুশল-অকুশল, দোষযুক্ত-দোষমুক্ত, হীন উত্তম, কৃষ্ণ-শুক্ল, সদৃশ-অসদৃশ ধর্মসমূহ
পুনঃপুনঃ স্মৃতিপথে উদিত হয়। যেমন-
এই চারি স্মৃত্যুপন্থান, এই
চারি সম্যক প্রধান (চেষ্টা), এই চারি ঋদ্ধিপাদ,
এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়, এই
পঞ্চবল, এই সপ্ত বোধ্যঙ্গ,
এই আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গ,এই শমথ, এই
বিদর্শন, এই বিদ্যা, এই
বিমুক্তি ইত্যাদি। অনন্তর যোগী সেবনীয় ধর্ম
সেবন করে, অসেবনীয় ধর্ম
সেবন করে না; ভজনীয়
ধর্মের ভজনা করে, অভজনীয়
ধর্মের ভজনা করে না।
মহারাজ! এইরূপে স্মৃতির লক্ষণ স্মরণ।”
“উপমা প্রদান করুন।”
“যেমন, মহারাজ! কোন চক্রবর্তী রাজার
ভান্ডাগারিক সন্ধ্যায় ও প্রাতঃকালে রাজাকে
তাহার ঐশ্বর্যের বিষয় স্মরণ করাইয়া দেব- “দেব! আপনার এতগুলি
হস্তী, এতগুলি অশ্ব, এতগুলি রথ, এতগুলি পদাতিক
সৈন্য, এত হিরণ্য, এত
সুবর্ণ এই পরিমাণ সম্পত্তি
আছে; দেব, ইহা আপনি
স্মরণ করুন”- এইরূপে রাজার সম্পত্তি স্মরণ করাইয়া দেয়। ঠিক তদ্রুপ, মহারাজ!
উৎপদ্যমান স্মৃতি কুশল-অকুশল ধর্মসমূহকে
স্মরণ করাইয়া দেয়। অন্তর যোগী . . . . . . . করে না। এইরূপেই
মহারাজ! স্মৃতির লক্ষণ যথার্থ স্মরণ।
২১। ভন্তে! কি
প্রকারে স্মৃতির লক্ষণ উপগ্রহণ (ধারণ)?"
“মহারাজ! উৎপদ্যমান স্মৃতি হিতাহিত ধর্মসমূহের গতি অন্বেষণ করে
“এই সকল ধর্ম হিতকর,
এই সকল ধর্ম অহিতকর;
এই সকল ধর্ম উপকারক,
এই সকল ধর্ম অনুপকার
ইত্যাদি।” তৎপর যোগী অহিতকর
ধর্মসমূহ পরিত্যাগ করে, হিতকর ধর্মসমূহ
গ্রহণ করে; এবং অনুপকারক
ধর্মসমূহ পরিত্যাগ করে, উপকারক ধর্মসমূহ
গ্রহণ করে। এররূপেই মহারাজ!
স্মৃতির লাক্ষণ উপগ্রহণ।”
“উপমা প্রদান করুন।”
“যেমন , মহারাজ! কোন চক্রবর্তী রাজার
সেনাধ্যক্ষ (পরিনায়ক রত্ন) রাজার হিতাহিত বিষয়গুলি জানেন— “এইগুলি রাজার হিতকর ও ইহারা অহিতক;
এই সকল উপকারক, এই
সকল অনুপকার।” এইরূপ জানিয়া তিনি অহিতকরগুলি ত্যাগ
করান, হিতকরগুলি গ্রহণ করান; অনুপকারকগুলি ত্যাগ করান, উপকারকগুলি গ্রহণ করান। এই রূপেই মহারাজ!
উৎপদ্যমান স্মৃতি হিতাহিত ধর্মসমূহের গতি অন্বেষণ করে-
এই সকল ধর্ম হিতকর
. . . . . . এইরূপে মহারাজ! স্মৃতির লক্ষণ উপগ্রহণ। মহারাজ! ভগবান ইহাও বলিয়াছেন- “ভিক্ষুগণ!
স্মৃতিকেই আমি সর্বার্থ-সাধক
বলি।”
“ভদন্ত নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
---#চলমান।
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।