দুটি খারাপ ইট || হৃদয়ের দরজা খুলে দিন থেকে সংকলিত


প্রথম অধ্যায়: পরিপূর্ণতা ও অপরাধবোধ

গল্প-১: দুটি খারাপ ইট

১৯৮৩ সালে আমাদের বিহারের জায়গা ক্রয় করার পরে নিঃস্ব হয়ে গেলাম আমরা। আমাদের প্রচুর দেনা হয়ে গেল। বিহারের জায়গাটিতে কোন ঘর বাড়ি ছিল না। এমনকি কোন ছাউনিও নয়। প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমাদেরকে পুরনো দরজাগুলোর উপরে ঘুমাতে হয়েছিল, যে দরজাগুলো আমরা সস্তায় পুরনো মালপত্রের দোকান থেকে কিনেছিলাম। দুপাশে ইটের স্তুপ তুলে তার উপরে দরজাগুলো বিছিয়ে চৌকির মতো বানিয়েছিলাম। (সেখানে অবশ্য কোন তোশক ছিল না, কেননা আমরা ছিলাম বনভিক্ষু।)
সবচেয়ে ভালো দরজাটা ছিল বিহারাধ্যক্ষের, সেটা ছিল সমান। আমার দরজাটার মাঝখানে বেশ বড়সড় একটা গর্ত, যেখানে আগে দরজার নব লাগানো ছিল। দরজার নবটা তুলে ফেলার কারণে আমি বেশ খুশি, কিন্তু সমস্যা হলো আমার দরজা-বিছানাটায় ঠিক মাঝখানে একটা গর্ত রেখে গেল। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, এখন আমার টয়লেটে যেতে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে না। হিম শীতল সত্য হলো যে, ছিদ্রটার মধ্য দিয়ে বাতাস আসতো। সেই রাতগুলোতে আমি খুব বেশি ঘুমাতাম না।
আমরা ছিলাম গরীব ভিক্ষু যাদের ঘরবাড়ির দরকার ছিল। কিন্তু ঘরবাড়ি তোলার মত লোক নিয়োগ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না, জিনিসপত্রও ছিল অনেক ব্যয়বহুল। তাই আমাকে শিখতে হয়েছিল কী করে নির্মাণ করতে হয়, কীভাবে ফাউন্ডেশন দিতে হয়, কংক্রীট ও ইট কীভাবে বিছাতে হয়, কীভাবে ছাদ দিতে হয়, কীভাবে পাইপ লাইন বসাতে হয়- সবকিছু।
গৃহী জীবনে আমি ছিলাম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এবং এক হাইস্কুলের শিক্ষক। হাতের কাজ করার অভ্যাস আমার ছিল না। কিন্তু কয়েক বছর পরে আমি মিস্ত্রির কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠলাম। আমার লোকজনকে তখন আমি বলতাম বিবিসি (বুড্ডিস্ট বিল্ডিং কোম্পানি)। শুরুর দিকে আমার সময়টা এমনই কঠিন ছিল।
(ads1)
ইট বিছানোটা সহজ মনে হতে পারে, এক দলা মশলা নিচে দিয়ে, ইটের এককোণায় একটা বাড়ি, আরেক কোণায় এক বাড়ি, ব্যস। যখন আমি ইট বিছানো শুরু করলাম, এক কোণায় বাড়ি দিয়ে সমান করার চেষ্টা করলাম, আরেক কোণা উঁচু হয়ে উঠে গেল। তাই আমি সেই কোণাটায় বাড়ি দিলাম। এতে করে পুরো ইটটাই বেলাইনে চলে গেল। ঠেলেঠুলে এটাকে লাইনে আনলে প্রথম কোণাটি আবার উঁচু হয়ে রইল। আপনি নিজেই করে দেখুন না!
ভিক্ষু হওয়াতে আমার ধৈর্য্য ও সময় যথেষ্ট ছিল। আমি নিশ্চিত করলাম যেন প্রত্যেকটি ইট সুন্দরভাবে বসানো হয়, যত সময় লাগুক না কেন। অবশেষে আমার প্রথম ইটের দেয়াল বানানো শেষ করে একটু পেছনে গিয়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখলাম নিজের সৃষ্টিকে। কেবল তখনই আমার চোখে পড়ল- হায়! হায়! আমি দুটো ইটকে নষ্ট করেছি। সবগুলো ইটই সারিবদ্ধভাবে সাজানো, কেবল এই দুটো ইট বাঁকা হয়ে গেছে। সেগুলোকে দেখতে খুব বিশ্রী দেখাচ্ছিল। তারা পুরো দেয়ালটাকেই নষ্ট করেছে। তারা এর সৌন্দর্যটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
বিহারের অতিথিদের আমাদের নতুন বিহার দেখাতে গিয়ে সবসময় আমি তাদেরকে আমার ইটের দেয়ালের ওদিকে নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে চাইতাম। আমার ভুলটা অন্য কেউ দেখুক এটা আমার সহ্য হতো না। এরপর তিন চার মাস পরে বিহারের কাজ শেষ হলে একদিন এক অতিথিকে নিয়ে বেড়ানোর সময় দেয়ালটা দেখল সে।
‘এটা তো সুন্দর একটা দেয়াল। সে মন্তব্য করল।
‘স্যার’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি কি আপনার চশমা গাড়িতে ফেলে এসেছেন? আপনার কি চোখের সমস্যা আছে? আপনি কি ঐ দুটো খারাপ ইটকে দেখেন নি, যেগুলো পুরো দেয়ালটাকে নষ্ট করেছে?’
সে এর উত্তরে যা বললো তা দেয়ালটা সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরোপুরি পাল্টে দিল, নিজের সম্পর্কে ধারণা তো পাল্টালই। জীবনের অন্যান্য দিকগুলোও পাল্টে গেল। সে বললো, ‘হ্যাঁ, আমি ঐ খারাপ ইট দুটো দেখেছি, কিন্তু আমি সেই সাথে ৯৯৮টা ভালো ইটও দেখেছি।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তিনমাসেরও বেশি সময় ধরে এই প্রথমবার আমি দুটো ভুলের পাশাপাশি অন্যান্য ভালো ইটগুলোকেও দেখলাম। সেই খারাপ ইটগুলোর উপরে, নিচে, বামে, ডানে ছিল ভালো ইট, সুন্দরভাবে সাজানো ইট। তাছাড়া সুন্দরভাবে সাজানো ইটগুলো ছিল দুটো খারাপ ইটের তুলনায় বহু বহুগুণ বেশি। আগে আমার দৃষ্টি পড়ে থাকত কেবল আমার দুটো ভুলের উপরে, বাকি সব বিষয়ে আমি ছিলাম অন্ধ। অবশ্যই আমি দেয়ালের দিকে থাকাতে পারতাম না, অন্য কাউকেও তা দেখাতে কুণ্ঠিত ছিলাম। এজন্যই আমি দেয়ালটাকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলাম। এখন আমি ভালো ইটগুলো দেখতে পেয়েছি, দেয়ালটা এখন আর অত খারাপ দেখাচ্ছে না। এটা ছিল সেই অতিথির কথায়, ‘একটা সুন্দর ইটের দেয়াল’। দেয়ালটা এখনো সেখানে আছে, কিন্তু বিশ বছর পরে আমি এখন ভুলে গেছি, সেই দুটো খারাপ ইট দেয়ালটার ঠিক কোন জায়গায় আছে। আক্ষরিক অর্থেই এখন আর আমি সেই ভুলগুলোকে দেখি না।
কত লোক তাদের সম্পর্ককে শেষ করে দেয় অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ করে কারণ তারা শুধুমাত্র তাদের সঙ্গীর ‘দুটো খারাপ ইটকেই দেখে? আমাদের মধ্যে কতজন হতাশ হয়ে পড়ি, এমনকি আত্মহত্যা করার কথাও ভাবি, কারণ আমরা আমাদের মাঝে কেবল দুটো খারাপ ইটকেই দেখি? সত্যিকথা হচ্ছে, দোষগুলোর উপরে, নিচে, বামে, ডানে অনেক অনেক ভালো ইট, সাজানো ইট আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে আমরা সেগুলোকে দেখি না। তার বদলে প্রতিবার আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ভুলগুলোর উপরে। আমরা দেখি কেবল ভুলগুলো, ভাবি কেবল সেগুলোরই কথা, তাই আমরা সেগুলোকে ধ্বংস করতে চাই। আর দুঃখের কথা যে, মাঝে মাঝে আমরা সত্যিই এভাবে ‘খুব সুন্দর দেয়ালকে ধ্বংস করে দিই।
আমাদের সবারই দুয়েকটা খারাপ ইট আছে, কিন্তু সুন্দর, সাজানো ইট আছে খারাপগুলোর চেয়ে অনেক, অনেক বেশি। যখন আমরা এভাবে দেখি, তখন কোনকিছু আর অতটা খারাপ বলে মনে হয় না। এতে করে আমরা আমাদের ত্রুটি দেখেও নিজেদেরকে মেনে নিয়ে শান্তিতে থাকি। শুধু নিজেদের নিয়েই নয়, সঙ্গীদের সাথে থাকাটাও তখন আমরা উপভোগ  করি। এটা বিবাহ বিচ্ছেদের উকিলদের জন্য খারাপ খবর হতে পারে, কিন্তু আপনার জন্য ভালো খবর।
আমি এই গল্পটা অনেকবার বলেছি। একবার এক মিস্ত্রি আমার কাছে তাদের একটা পেশাগত গোপনীয় তথ্য জানালো। ‘আমরা মিস্ত্রিরা সবসময় ভুল করি,’ সে বললো, ‘কিন্তু আমরা কাস্টমারদের বলি যে এটা একটা নতুন ডিজাইন, যা আশেপাশের কোন বাড়িতে নেই। আর এর জন্য আমরা তাদের কাছ থেকে আরো অতিরিক্ত কয়েক হাজার ডলার আদায় করি।
কাজেই আপনার বাড়িটার অনন্য ডিজাইনটাই হয়তো একটা ভুল থেকে শুরু হয়েছে। একইভাবে যেটাকে আপনি আপনার ভুল, আপনার সঙ্গীর ভুল বা সাধারণভাবে জীবনের ভুল হিসেবে ভাবছেন, সেটাই হয়তো অনন্য বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে, আপনার সময়কে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে, যখন আপনি ‘শুধুমাত্র তাদেরকে দেখা বন্ধ করবেন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !