বিহারের বাগান || হৃদয়ের দরজা খুলে দিন


প্রথম অধ্যায়: পরিপূর্ণতা ও অপরাধবোধ

গল্প-২: বিহারের বাগান- ৮
জাপানের বৌদ্ধ বিহারগুলো তাদের বাগানের জন্য বিখ্যাত। অনেক বছর আগে সেখানে এক বিহার ছিল যা তার অসাধারণ সুন্দর বাগানের জন্য গর্ব করত। সারা দেশ থেকে লোকজন আসত শুধুমাত্র এর মনকাড়া সাজসজ্জা ও সুন্দর নান্দনিকতা উপভোগের জন্য।
একবার এক বৃদ্ধ ভিক্ষু সেখানে বেড়াতে এল। সে খুব সকালে এসে পৌঁছল, ভোর হওয়ার পরপরই। সে আবিষ্কার করতে চাইল, কেন এই বাগানটা সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী বলে খ্যাত, তাই সে একটা বড় ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলো, যেখান থেকে পুরো বাগানটা দেখা যায়।
সে দেখল এক তরুণ ভিক্ষু বিহার থেকে হাতে দুটো বড় ঝুড়ি নিয়ে বের হলো। পরের তিন ঘন্টা ধরে বুড়ো ভিক্ষুটি দেখল যে, তরুণ ভিক্ষুটি সাবধানে প্রত্যেকটি পাতা ও ডালপালা কুড়িয়ে নিল যেগুলো বাগানের মাঝে থাকা গাছটি হতে ঝরে পড়েছিল। প্রত্যেকটি পাতাও ডাল তুলে নিয়ে সে তার কোমল হাতে এটিকে উল্টে পাল্টে দেখল, পরীক্ষা করল, গভীরভাবে ভাবল। পছন্দ হলে সে এটিকে একটি ঝুড়িতে রাখল। পছন্দ না হলে সে সেটি দ্বিতীয় ঝুড়িতে রাখল, যেটি হচ্ছে আবর্জনার ঝুড়ি। প্রত্যেকটি পাতা ও ডাল কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে এরপর সে আবর্জনার ঝুড়িটি বিহারের পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে খালি করল আর একটু থেমে চা পান করল। এরপর সে তার মনকে প্রস্তুত করল পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপের জন্য। তরুণ ভিক্ষুটি আরো তিন ঘন্টা ব্যয় করে মনোযোগের সাথে, যত্নের সাথে, দক্ষতার সাথে প্রত্যেকটি পাতা ও ডালকে বাগানের একেবারে সঠিক জায়গায় বসাল। যদি কোন ডালের অবস্থান তার মনের মতো না হতো, সে এটাকে সামান্য ঘোরাতো, অথবা সামান্য সামনের দিকে সরিয়ে দিতো, যতক্ষণ না তার মুখে সন্তুষ্টির হালকা হাসি ফুটে উঠতো। এরপর সে পরবর্তী পাতাটার আকার ও রং থেকে বাগানে এর সঠিক জায়গাটা বেছে নিত। খুঁটিনাটি সবকিছুর প্রতিও তার মনোযোগ ছিল অতুলনীয়। রং ও আকারের সাজসজ্জায় তার দক্ষতা ছিল অপূর্ব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তার ছিল গভীর জ্ঞান। তার কাজ শেষ হলে বাগানটা অনিন্দ্যসুন্দর দেখালো।
এরপর বুড়ো ভিক্ষুটা বাগানে বেরিয়ে এল। ভাঙা দাঁতের পিছন থেকে একটা হাসি দিয়ে সে তরুণ ভিক্ষুটিকে অভিনন্দন জানালো, ‘চমৎকার! চমৎকার হয়েছে ভান্তে। আমি তোমাকে সারাটা সকাল ধরে লক্ষ করেছি। তোমার অধ্যবসায় সর্বোচ্চ প্রশংসার যোগ্য। আর তোমার বাগান... হুম! তোমার বাগানটা প্রায় নিখুঁত হয়েছে।
তরুণ ভিক্ষুটির মুখ সাদা হয়ে গেল। তার শরীর শক্ত হয়ে গেল যেন কাঁকড়াবিছে কামড়েছে। তার মুখ থেকে আত্ম সন্তুষ্টির হাসি খসে পড়ল আর সে যেন শূণ্যতার এক গভীর খাদে পড়ে গেল। জাপানে, বুড়ো হাসিখুশি ভিক্ষুদের বিষয়ে আপনি কখনই নিশ্চিত থাকতে পারবেন না।
‘আপনি কী-কী বলতে চান?’ সে ভয়ে তোতলালো। ‘প্রায় নিখুঁত বলতে আপনি কী-কী বুঝাতে চান?’ আর সে বুড়ো ভিক্ষুটির পায়ে পড়ে গেল। ‘ও প্রভু! ও আমার গুরু! প্লিজ, আপনার দয়া আর মৈত্রী বর্ষণ করুন আমার উপরে। নিশ্চয়ই বুদ্ধ আপনাকে পাঠিয়েছেন আমার বাগানকে কীভাবে আরো নিখুঁত করা যায় তা দেখাতে। আমাকে শিখিয়ে দিন, ও মহাজ্ঞানী! আমাকে পথ দেখান!’
‘তুমি কি সত্যিই চাও আমি তোমাকে দেখিয়ে দিই?’ বুড়ো ভিক্ষুটি জিজ্ঞেস করলো, তার প্রাচীন চেহারায় দুষ্টামির ছাপ!
‘জ্বী, হ্যাঁ, দয়া করে দেখান, প্লিজ, মাস্টার!’
অতএব বুড়ো ভিক্ষুটি বাগানের মাঝে হেঁটে গেল। সে তার জীর্ণ কিন্তু এখনো সবল দুটো হাত সেই পাতাবহুল গাছটার উপর রাখল। এরপর বিরাট একটা সাধুমার্কা হাসি দিয়ে সে বেচারা গাছটাকে বিশাল একটা ঝাঁকুনি দিল! পাতা, ডালপালা আর বাকল ছড়িয়ে পড়ল সবখানে, কিন্তু সে ঝাঁকাতেই থাকলো গাছটাকে। যখন আর ঝরার মতো কোন পাতা রইলো না, তখন সে থামলো।
তরুণ ভিক্ষুটি স্তব্ধ হয়ে গেল। তার বাগান ধ্বংস হয়ে গেল। সারা সকালের কাজ পুরো বরবাদ। বুড়ো ভিক্ষুটিকে মেরে ফেলার ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু বুড়োটি চারপাশে তাকিয়ে নিজের কীর্তি দেখতে ব্যস্ত। তারপরে একটা হাসি- যে হাসিতে রাগ গলে যায়-এমন হাসি দিয়ে সে ভদ্রভাবে তরুণ ভিক্ষুটিকে বললো, ‘এখন তোমার বাগানটি সত্যিই নিখুঁত।

গল্প-৩: মনের শান্তির জন্য বোকাদের গাইড

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !