নরকাগ্নি উষ্ণতর
৪। রাজা বলিলেন-
“ভন্তে নাগসেন! আপনারা বলেন- স্বাভাবিক অগ্নি অপেক্ষা নরকের অগ্নি অধিকতর উষ্ণ। সাধারণ অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হইলে ক্ষুদ্র পাষাণও
সারাদিন প্রজ্বলিত হইলেও বিগলিত হয় না, অথচ
কুটাগার সদৃশ পাষাণও নরকাগ্নিতে
প্রক্ষিপ্ত হইলে মুহুর্তের মধ্যে
গলিয়া যায়, এই কথা আমি
বিশ্বাস করি না। আপনারা
ইহাও বলেন- যে সকল প্রাণী
তথায় উৎপন্ন হয় তাহারা অনেক
শত সহস্রবর্ষ নরকে প্রজ্বলিত হইলেও
বিগলিত হয় না, এই
কথাও আমি বিশ্বাস করি
না।”
স্থবির কহিলেন- “মহারাজ! আপনি কি মনে
করেন- মকর, কুম্ভীর, কচ্ছপ,
ময়ুর ও কবুতরের স্ত্রী
জাতিরা শক্ত পাথর ও
কঙ্কর খায়?”
“হাঁ, ভন্তে! খায়।"
“কেমন, সেই সকল তাহাদের
পেটে হজম হয় কি?”
“হাঁ, ভন্তে! হজম
হয়।"
“তাহাদের উদরে যে গর্ভ
হয় তাহা হজম হয়
কি?”
“না, ভন্তে!”
“কারণ কি?"
“ভন্তে! মনে হয় স্বীয়
কর্ম প্রভাবেই বিনষ্ট হয় না।”
“মহারাজ! এই প্রকারেই স্বীয়
কর্মপ্রভাবেই নরকগামী জীবগণ অনেক শতসহস্রবর্ষ ব্যাপী
নরকে পরিপক্ক হইয়াও কিন্তু বিনষ্ট হয় না। মহারাজ!
ভগবান ইহাও বলিয়াছেন— সেই
পাপকর্ম যতদিন শেষ না হয়
ততদিন তথায় পাপীর মৃত্যু হয় না।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“মহারাজ! আপনি কি মনে
করেন, যে সকল সিংহ,
ব্যাঘ, দ্বীপী ও কুকুরের স্ত্রী
জাতিরা আছে তাহারা শক্ত
অস্থি- মাংস খায়?”
“হাঁ, ভন্তে! খায়।”
“সেই সকল তাহাদের
উদরে জীর্ণ হয় কি?”
“হাঁ , ভন্তে! হয়।”
“তাহাদের উদরে যে গর্ভ
হয় তাহাও কি জীর্ণ হয়?”
“না, ভান্তে।”
“ভন্তে!
মনে হয় স্বীয় কর্মপ্রভাবেই
জীর্ণ হয় না?”
“মহারাজ! এই প্রকারে স্ব
স্ব কর্মপ্রভাবে নরকের প্রাণীরা অনেক শতসহস্র বর্ষ
নরকে পরিপক্ক হইলেও তথায় বিনষ্ট হয় না।"
“পুনরায় উপমা প্রদান করুন।"
“মহারাজ! আপনি কি মনে
করেন, যে সকল সুকোমল
যবন, ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ ও গৃহপতি মহিলারা
আছেন তাহারা শক্ত খাদ্য- মাংসাদি
খান?"
“হাঁ, ভন্তে! খান।”
“মহারাজ! তাহাদের উদরে গিয়া যে
সকল হজম হয় কি?'
“হাঁ, ভন্তে! হজম
হয়।”
“তাহাদের উদরে যে গর্ভ
হয় তাহাও কি হজম হয়?"
”না, ভান্তে।”
“কেন?"
“ভস্তে! মনে হয়, স্বীয়
কর্মপ্রভাবেই হজম হয় না।”
“মহারাজ! এই প্রকারে স্ব
স্ব কর্মপ্রভাবেই নরকের প্রাণিগণ অনেক শতসহস্রব্যাপী তথায়
পরিপক্ক হইলেও বিনষ্ট হয় না। ভগবানও
ইহা বলিয়াছেন, “যতদিন তাহার পাপকর্ম শেষ না হইবে
ততদিন তাহার মৃত্যু হইবে না।"
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।" পৃথিবীর
প্রতিষ্ঠা।
৫। রাজা বলিলেন- “ভন্তে নাগসেন! আপনারা বলেন এই মহাপৃথিবী জলে প্রতিষ্ঠিত, জল বায়ূতে প্রতিষ্ঠিত এবং বায়ূ আকাশে প্রতিষ্ঠিত। এই বাক্যও আমি সমর্থন করি না।”
স্থবির ধর্মকরক দ্বারা জল লইয়া রাজা মিলিন্দকে বুঝাইলেন- “মহারাজ, এই জল যেমন বায়ু দ্বারা স্থিত আছে, সেইরূপ সেই জলও বায়ুর দ্বারা স্থিত থাকে।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
নিরোধই নির্বাণ
৬। রাজা বলিলেন-
“ভন্তে! নিরোধ কি নির্বাণ?"
“হাঁ, মহারাজ! নিরোধ
নির্বাণ।"
“ভন্তে নাগসেন! নিরোধই নির্বাণ, ইহা কি প্রকারে?"
“মহারাজ! সমস্ত অজ্ঞ প্রাকৃতজন আভ্যন্তরীণ
ও বাহ্যিক ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের উপভোগে
রত হয়, উহাকে অভিনন্দন
করে, উহার প্রশংসা করে
এবং উহাতে নিমজ্জিত থাকে। তাহারা সেই স্রোতে ভাসিয়া
যায়। বার বার জন্মগ্রহণ
করে, জরা, মরণ, শোক,
পরিবেদন, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও মনস্তাপ হইতে
মুক্ত হয় না। আমি
বলি, তাহারা দুঃখ হইতে সম্পূর্ণ
মুক্ত হয় না।
মহারাজ!
পক্ষান্তরে জ্ঞানবান আর্যশ্রাবক আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ইন্দ্রিয়
ও বিষয়ের উপভোগে রত হন না,
তাহাকে অভিনন্দন করেন না, প্রশংসা
করেন না এবং উহাতে
নিমগ্ন হন না। তদ্ধেতু
তাহার তৃষ্ণার নিরোধ হয়। তৃষ্ণা নিরোধের
ফলে উপাদান (আসক্তি) নিরুদ্ধ হয়, উপাদান নিরুদ্ধ
হইলে ভব (কর্ম) নিরুদ্ধ
হয়, ভব নিরুদ্ধ হইলে
জন্ম নিরুদ্ধ হয়, জন্ম নিরুদ্ধ
হইলে জরা, মরণ, শোক,
পরিবেদন, দুঃখ দৌর্মনস্য ও
মনস্তাপ নিরুদ্ধ হয়। এইরূপে তাহার
যাবতীয় দুঃখরাশির অবসান হয়। মহারাজ এইরূপেই
নিরুদ্ধ হওয়াই নির্বাণ।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।"
নির্বাণ লাভ
৭। রাজা বলিলেন-
“ভন্তে! সকল লোকই কি
নির্বাণ লাভ করে?"
“না, মহারাজ। সকলেই
নির্বাণ লাভ করে না,
অথচ যিনি সম্যকরূপে ধর্মপথে
চলেন, জানিবার যোগ্য ধর্মসমূহ জানেন, পরিজ্ঞেয় ধর্মসমূহ পরিজ্ঞাত হন, পরিত্যজ্য বস্তু
পরিত্যাগ করেন, অনুশীলনীয় ধর্মসমূহ নিজের মধ্যে অনুশীলন করেন ও প্রত্যক্ষ
করণীয় ধর্মসমূহকে স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেন, কেবল তিনিই নির্বাণ
লাভ করেন।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
নির্বাণ সুখ জানা
৮। রাজা বলিলেন-
“ভন্তে! যে ব্যক্তি নির্বাণ
লাভ করে না সে
নির্বাণ সুখ জানিতে পারে
কি?”
“হাঁ, মহারাজ! যে
নির্বাণ লাভ করে না,
সেও নির্বাণ সুখ জানিতে পারে
”
“ভন্তে! নিজে লাভ না
করিয়া কি প্রকারে নির্বাণ
সুখ জানিতে পারে?"
"মহারাজ! যাহাদের হস্ত-পদ কখনও
ছিন্ন হয় নাই, তাহারা
হস্ত-পদ-ছেদন দুঃখ
কি তাহা জানিতে পারে
কি?”
“হাঁ, ভন্তে! জানিতে
পারে।”
“কি প্রকারে জানিতে
পারে?”
“ভন্তে! হস্ত-পদ ছিন্ন
অন্য লোকের রোদন শব্দ শুনিয়া
তাহারা জানিয়া থাকে যে ইহাতে
দুঃখ হয়।”
“মহারাজ! এই প্রকাৱেই, যাহাদের
নির্বাণ-দর্শন হইয়াছে তাহাদের সন্তোষজনক শব্দ শুনিয়া সে
জানিতে পারে যে ইহা
নির্বাণ সুখ।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
[প্রথম বর্গ সমাপ্ত]
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।