[চতুর্থ বর্গ]
সশরীরে ব্রহ্মলোক
৩৮। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে নাগসেন! এমন কেহ আছেন
যিনি সশরীরে উত্তরকুরু বা ব্রহ্মলোক কিংবা
অপর দ্বীপে যাইতে পারেন?”
“হাঁ, মহারাজ! এমন
ব্যক্তিও আছেন যিনি এই
চারি মহাভৌতিক দেহ সহ উত্তরকুরু,
ব্রহ্মলোক কিংবা অপর দ্বীপে যাইতে
পারেন।”
“ভন্তে! তাঁহারা কি প্রকারে------- যান?”
“মহারাজ! স্মরণ হয় কি আপনি
এই পৃথিবী হইতে কখনও এক
বিঘত কিংবা একহাত উর্ধ্বে উল্লম্ফন করিয়াছেন?”
“হাঁ, ভন্তে! আমি
জানি যে আমি আট
হাত পর্যন্ত উর্ধ্বে উল্লম্ফন করিতে পারি।”
“মহারাজ!
আপনি আট হাত কি
প্রকারে উল্লম্ফন করিতে পারেন?”
“ভন্তে! আমি এই চিত্তোৎপদন
করি যে ওখানে গিয়া
পতিত হইব। এই চিত্তোৎপত্তির
সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর হাল্কা
হয় (আর আমি লম্ফ
প্রদান করি)।”
“মহারাজ! এইরূপেই, ঋদ্ধিমান, চিত্তবশীকৃত ভিক্ষু স্বীয় দেহকে চিত্তে সমারোপিত করিয়া চিত্তবশে আকাশে গমন করেন।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
শত যোজন দীর্ঘ অস্থি
৩৯। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে! আপনারা বলেন যে শত
যোজন দীর্ঘ অস্থিও আছে। এত দীর্ঘ
বৃক্ষও নাই, কিরূপে এত
দীর্ঘ অস্থি থাকিতে পারে?”
“মহারাজ! কেমন, আপনি শুনিয়াছেন কি
মাহসমুদ্রে পাঁচ শত যোজন
দীর্ঘ মৎস্য আছে?”
“হাঁ, ভন্তে! শুনিয়াছি।”
“মহারাজ! সেই পঞ্চ শত
যোজন দীর্ঘ মৎস্যের অস্থি পঞ্চশত যোজন হইবে কি
না?”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
শ্বাস-প্রশ্বাসের নিরোধ
৪০। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে নাগসেন! আপনারা কি ইহা বলেন
যে‘শ্বাস ও প্রশ্বাস নিরোধ
করা সম্ভব।”
“হাঁ, মহারাজ! নিরোধ
করা সম্ভব।”
“ভন্তে! কি প্রকারে?”
“মহারাজ! আপনি কি পূর্বে
কাহারও (নিদ্রিত অবস্থায়) নাসিকাধ্বনি শুনিয়াছেন?”
“হাঁ, ভন্তে, শুনিয়াছি।”
“মহারাজ! শরীর নমিত হইলে
সেই শব্দ থামিবে কি?”
“হাঁ, ভন্তে! থামিবে।”
“মহারাজ! যদি সেই অভাবিত-কায়, অভাবিত-শীল,
অভাবিত-চিত্ত ও অভাবিত-প্রজ্ঞ
ব্যক্তির শরীর নমিত হইলে
নাসিকাধ্বনি থামিয়া যায়, তখন ইহাতে
আশ্চর্য কি যে ভাবিত-কায়, ভাবিত-শীল,
ভাবিত-চিত্ত ও ভাবিত-প্রজ্ঞ
চতুর্থ ধ্যান লাভীর শ্বাস ও প্রশ্বাস নিরুদ্ধ
হইবে না।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
সমুদ্র নাম কেন
৪১। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে নাগসেন! সকলেই‘সমুদ্র সমুদ্র’ বলে, কি কারণে
জলকে সমুদ্র বলা হয়?” স্থবির
কহিলেন, “মহারাজ! উহাতে যত জল, তত
লবণ এবং যত লবণ
তত জল আছে। লবণের
সমান জল থাকায় উহাকে
সমুদ্র বলা হয়।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
সমুদ্রের এক রস
৪২। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে নাগসেন! কি কারণে মহাসমুদ্র
একমাত্র লবণ রসযুক্ত?”
“মহারাজ! বহুকাল হইতে জলরাশি একস্থানে
থাকার দরুন সারা সমুদ্র
একমাত্র লবণরসে পরিণত হইয়াছে।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
সূক্ষ্ম ধর্মের ছেদন
৪৩। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে নাগসেন! সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্মবস্তুকেও ছেদন করা সম্ভব
কি?”
“হাঁ, মহারাজ! ছেদন
করা সম্ভব।”
“ভন্তে! সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম বস্তু কি?”
“মহারাজ! ধর্মই সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম বস্তু। কিন্তু সকল ধর্ম সূক্ষ্ম
নহে। সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল ধর্ম সমূহেরই নামান্তর।
যাহা কিছু ছেদনীয় দ্রব্য
আছে সেই সমস্ত প্রজ্ঞা
দ্বারা ছিন্ন হয়। প্রজ্ঞা অপেক্ষা
ছেদনের আর দ্বিতীয় অস্ত্র
নাই।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
বিজ্ঞান, প্রজ্ঞা ও জীব (আত্ম)
৪৪। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে নাগসেন!‘বিজ্ঞান’,‘প্রজ্ঞা’ কিংবা‘ভূতে জীব’ এই
সকল শব্দ অর্থ ও
ব্যঞ্জন হিসাবে পৃথক্ পৃথক্, অথবা ইহারা একার্থবোধক
ভিন্ন ভিন্ন নাম?”
“মহারাজ! বিশেষরূপে জানা বিজ্ঞানের লক্ষণ
(স্বভাব), প্রকৃষ্টরূপে জানা প্রজ্ঞার লক্ষণ,
ভূতের মধ্যে‘জীব’ বলিয়া কোন
দ্রব্যের অস্তিত্ব নাই।”
“ভন্তে! যদি জীব (আত্মা)
বলিয়া কোন দ্রব্য না
থাকে, তবে আমাদের ভিতরে
থাকিয়া কে চক্ষুদ্বারা রূপ
দেখে, কর্ণদ্বারা শব্দ শোনে, নাসিকাদ্বারা
গন্ধ আঘ্রাণ করে, জিহ্বাদ্বারা রস
আস্বাদন করে, কায়দ্বারা স্পৃশ্য
স্পর্শ করে এবং মনদ্বারা
ধর্ম অবগত হয়?”
“মহারাজ! যদি শরীর ব্যতীত
কোন জীব (আত্মা) থাকে,
যাহা মানুষের ভিতরে
থাকিয়া চক্ষুদ্বারা রূপ দেখে, কর্ণদ্বারা
শব্দ শোনে, নাসিকাদ্বারা গন্ধ আঘ্রাণ করে,
জিহ্বাদ্বারা রস আস্বাদন করে,
কায়দ্বারা স্পৃশ্য স্পর্শ করে এবং মনদ্বারা
ধর্ম অবগত হয়, তবে
সেই জীব তাহার চক্ষু
উন্মোচিত হইলে মহা আকাশের
রহস্য বহির্মূখী হইয়া আরও সুষ্ঠুভাবে
আকাশের সাহায্য আরও সুষ্ঠুভাবে রূপ
দেখিবে। তদ্রƒপ কর্ণ,
নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক উৎপাটিত
হইলে মহা আকাশের সাহায্যে
আরও সুষ্ঠুরূপে শব্দ শুনিবে, গন্ধ
আঘ্রাণ করিবে, রস আস্বাদন করিবে
এবং স্পৃশ্য স্পর্শ করিতে পারিবে নহে কি?”
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! তাহা হইলে ভূতের
মধ্যে কোন জীবের অস্তিত্ব
নাই।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
বুদ্ধের দুষ্কর কর্ম সম্পাদন
৪৫। রাজা বলিলেন,
“ভন্তে নাগসেন! ভগবান কোন দুষ্কর কাজ
করিয়াছেন কি?”
“হাঁ, মহারাজ! ভগবান
একটি দুষ্কর কাজ করিয়াছেন।”
“ভন্তে! তাহা কি?”
“মহারাজ! একই আলম্বনে বর্তমান
অরূপী (চেতন) চিত্ত-চৈতসিক ধর্ম (মন ও মনোবৃত্তি)
নিচয়ের বিশ্লেষণ করিয়া তিনি বলিয়াছেনÍ‘ইহা
স্পর্শ, ইহা বেদনা, ইহা
সংজ্ঞা, ইহা চেতনা এবং
ইহা চিত্ত’Íভগবান ইহা অতি দুষ্কর
কাজ করিয়াছেন।”
“ভন্তে উপমা প্রদান করুন।”
“মহারাজ! কোন লোক নৌকা
যোগে মহাসমুদ্রে গমন করিয়া তথায়
করপুটে জল গ্রহণ করিয়া
এবং উহা জিহ্বায় আস্বাদন
করিয়া জানিতে পারে কিÍইহা
গঙ্গার জল, ইহা যমুনার
জল, ইহা অচিরবতীর জল,
ইহা সরভূর জল, ইহা মহী
নদীর জল?”
“ভন্তে! এইরূপ বলা কঠিন কাজ।”
“মহারাজ! ভগবান তদপেক্ষা অতি কঠিন কাজ
করিয়াছেন যে তিনি একই
বিষয় অবলম্বন করিয়া বিদ্যমান চেতন চিত্ত ও
চৈতসিক ধর্মনিচয়ের এইরূপ বিশ্লেষণ করিয়াছেনÍ‘ইহা স্পর্শ, ইহা
বেদনা, ইহা সংজ্ঞা, ইহা
চেতনা এবং ইহা চিত্ত’।”
“ভন্তে! বেশ বেশ” বলিয়া
রাজা (স্থবিরের ভাষণ) অনুমোদন করিলেন।
[চতুর্থ বর্গ সমাপ্ত]
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।