[শাস্তা শ্রাবস্তীনগরে অবস্থানকালে জনৈক হীনবীর্য্য ভিক্ষুসম্বন্ধে এই কথা বলিয়াছিলেন। এই ব্যক্তি সাধনা ত্যাগ করিয়া বিহারে ফিরিলে অপর ভিক্ষুগণ তাঁহাকে শাস্তার নিকট লইয়া গেলেন। শাস্তা বলিলেন, ‘এই মার্গফলপ্রদ শাসনে প্রবিষ্ট হইয়া যদি তুমি উৎসাহ পরিত্যাগ কর, তাহা হইলে লক্ষ মুদ্রা মূল্যের সুবর্ণপাত্র হইতে বঞ্চিত হইয়া সেরিব বণিকের যে দুর্দ্দশা হইয়াছিল, তোমারও সেইরূপ হইবে।’ অনন্তর ভিক্ষুগণ শাস্তাকে সেই কথা সবিস্তর বলিবার জন্য অনুরোধ করিলেন; শাস্তাও তাঁহাদের অবগতির জন্য ভাবান্তর-প্রতিচ্ছন্ন অতীত বৃত্তান্ত বর্ণন করিতে লাগিলেন :]
পুরাকালে, বর্তমান সময়ের চারিকল্প আগে বোধিসত্ত্ব, সেরিব নামক রাজ্যে ফেরিওয়ালার কাজ করিতেন। তখন তাঁহার নাম ছিল ‘সেরিবান’। সেরিবরাজ্যে সেরিবা নামে আরও এক ব্যক্তি ঐ কারবার করিত। ইহার বড় অর্থলালসা ছিল। একদা বোধিসত্ত্ব তাহাকে সঙ্গে লইয়া তেলবাহনদের অপরপারে অন্ধপুরনগরে বাণিজ্য করিতে গিয়াছিলেন। সেখানে তাঁহারা কে কোন রাস্তায় ফেরি করিয়া বেড়াইবেন তাহা ভাগ করিয়া লইলেন। কথা হইল একজন যে রাস্তায় একবার ফেরি করিয়া গিয়াছেন, অপরজন তাহার পরে সেখানেও ফেরি করিতে পারিবেন।
অন্ধপুরে পূর্ব্বে এক অতুলসম্পত্তিশালী শ্রেষ্ঠীপরিবার বাস করিত। কালে কমলার কোপে পড়িয়া তাহারা নির্ধন হয়, একে একে পুরুষেরাও মারা যায়। যে সময়ের কথা হইতেছে, তখন ঐ বংশে কেবল একটী বালিকা ও তাহার বৃদ্ধা পিতামহী জীবিতা ছিলেন। তাঁহারা অতিকষ্টে প্রতিবেশীদিগের বাড়ীতে কাজকর্ম্ম করিয়া দিনপাত করিতেন। বাড়ীর কর্ত্তা সৌভাগ্যের সময় যে সুবর্ণপাত্রে ভোজন করিতেন, সেটী তখনও ছিল; কিন্তু দীর্ঘকাল ব্যবহৃত না হওয়ায় এবং ভগ্নপাত্রাদির মধ্যে পড়িয়া থাকায় উহার উপর এত ময়লা জমিয়াছিল, যে সহসা উহা সোণার বাসন বলিয়া বোধ হইত না।
একদিন লোভী ফেরিওয়ালা ‘কলসী কিনিবে’ ‘কলসী কিনিবে’ বলিতে বলিতে ঐ শ্রেষ্ঠীদিগের বাড়ীর পাশ দিয়া যাইতেছিল। তাহা শুনিয়া বালিকাটী বলিল, ‘আমায় একখানা গহনা কিনিয়া দাওনা, দিদিমা।’ দিদিমা বলিলেন, ‘বাছা, আমরা গরিব লোক, পয়সা পাইব কোথায়?’ তখন বালিকা সেই সোণার বাসনখানি আনিয়া বলিল, ‘এইখানা বদল দিলে হয় না কি? ইহা ত আমাদের কোন কাজে লাগে না।’ বৃদ্ধা ইহাতে আপত্তি না করিয়া ফেরিওয়ালাকে ডাকিলেন এবং তাহাকে বসিতে বলিয়া বাসনখানি দিয়া কহিলেন, ‘মহাশয়, ইহার বদলে আপনার এই বোনটীকে যাহা হয় একটা জিনিস দিন।’
বাসনখানি দুই একবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া ফেরিওয়ালার সন্দেহ হইল, সম্ভবতঃ উহা স্বর্ণনির্ম্মিত। এই অনুমান প্রকৃত কি না তাহা পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত সে সূচী দিয়া উহার পিঠে দাগ কাটিল এবং উহা যে সোণার বাসন সে সম্বন্ধে তখন আর তাহার কিছুমাত্র সংশয় ছিল না। কিন্তু মেয়েমানুষ দুইটাকে ঠকাইয়া ইহা বিনামূল্যে লইব, এই দূরভিসন্ধি করিয়া সে বলিল, ‘ইহার আবার দাম কি? ইহা সিকি পয়সায় কিনিলেও ঠকা হয়’ অনন্তর সে নিতান্ত অবজ্ঞার ভাণ করিয়া বাসনখানি ভূমিতে ফেলিয়া সে স্থান হইতে চলিয়া গেল।
ইহার ক্ষণকাল পরেই বোধিসত্ত্ব সেই পথে ফেরি করিতে আসিলেন এবং ‘কলসী কিনিবে’, ‘কলসী কিনিবে’ বলিতে বলিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে লাগিলেন। তাহা শুনিয়া বালিকাটী তাহার পিতামহীকে আবার সেই প্রার্থনা জানাইল। বৃদ্ধা কহিলেন, ‘যে বাসন বদল দিতে গিয়াছিলে তাহার ত কোন দামই নাই শুনিলে। আমাদের আর কি আছে, বোন, যাহা দিয়া তোমার সাধ পুরাইতে পারি?’
বালিকা কহিল, ‘সে ফেরিওয়ালা বড় খারাপ লোক, দিদিমা। তাহার কথা শুনিলে গা জ্বালা করে। কিন্তু এ লোকটী দেখতে কত ভাল, ইহার কথাও কেমন মিষ্টি। এ বোধহয় ঐ ভাঙ্গা বাসন লইতে আপত্তি করিবে না।’ তখন বৃদ্ধা বোধিসত্ত্বকে ডাকাইয়া বসিতে বলিলেন এবং বাসনখানি তাঁহার হাতে দিলেন। বোধিসত্ত্ব দেখিবামাত্রই বুঝিলেন উহা সুবর্ণনির্ম্মিত। তিনি বৃদ্ধাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘মা, এ বাসনের দাম লক্ষমুদ্রা। আমার নিকট এত অর্থ নাই।’
বৃদ্ধা কহিলেন, ‘মহাশয়, এই মাত্র আর একজন ফেরিওয়ালা আসিয়াছিল। সে বলিল, ইহার মূল্য সিকি পয়সাও নহে। বোধহয় আপনার পুণ্যবলেই বাসনখানি এখন সোণা হইয়াছে। আমরা ইহা আপনাকেই দিব; ইহার বিনিময়ে আপনি যাহা ইচ্ছা দিয়া যান।’ বোধিসত্ত্বের নিকট তখন নগদ পাঁচ শ কাহণ এবং ঐ মূল্যের পণ্যদ্রব্য ছিল। তিনি ইহা হইতে কেবল নগদ আট কাহণ এবং দাঁড়িপালৱা ও থলিটী লইয়া অবশিষ্ট সমস্ত বৃদ্ধার হস্তে অর্পণ করিলেন এবং তাঁহার অনুমতি লইয়া বাসনখানি গ্রহণ করিয়া যত শীঘ্র পারিলেন নদীতীরে উপস্থিত হইলেন। সেখানে একখানি নৌকা ছিল। তিনি ইহাতে আরোহণ করিয়া মাঝির হাতে আট কাহণ দিয়া বলিলেন, ‘আমাকে শীঘ্র পার করিয়া দাও।’
এদিকে লোভী বণিক শ্রেষ্ঠীদিগের গৃহে ফিরিয়া বাসনখানি আবার দেখিতে চাহিল। সে বলিল, ‘ভাবিয়া দেখিলাম তোমাদিগকে ইহার বদলে একেবারে কিছু না দিলে ভাল দেখায় না।’ তাহা শুনিয়া বৃদ্ধা কহিলেন, ‘সে কি কথা, বাপু? তুমি না বলিলে উহার দাম সিকি পয়সাও নয়! এই মাত্র একজন সাধু বণিক আসিয়াছিলেন। বোধহয় তিনি তোমার মনিব হইবেন। তিনি আমাদিগকে হাজার কাহণ দিয়া উহা কিনিয়া লইয়া গিয়াছেন।’
এই কথা শুনিবামাত্র সেই লোভী বণিকের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে পাগলের মত ছুটাছুটি করিতে লাগিল; সঙ্গে যে সকল মুদ্রা ও পণ্যদ্রব্য ছিল তাহা চারিদিকে ছড়াইয়া ফেলিল। অনন্তর উলঙ্গ হইয়া, ‘হায়, সর্ব্বনাশ হইয়াছে, দুরাত্মা ছল করিয়া আমার লক্ষ মুদ্রার সুবর্ণ পাত্র লইয়া গিয়াছে,’ এইরূপ প্রলাপ করিতে করিতে এবং তুলাদণ্ডটী মুদ্গরের ন্যায় ঘুরাইতে ঘুরাইতে সে বোধিসত্ত্বের অনুসন্ধানে নদীতীরে ছুটিল। সেখানে গিয়া দেখে নৌকা তখন নদীর মধ্যভাগ পর্য্যন্ত গিয়াছে। সে ‘নৌকা ফিরাও’ ‘নৌকা ফিরাও’ বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল; কিন্তু বোধিসত্ত্ব নিষেধ করায় মাঝি নৌকা ফিরাইল না। বোধিসত্ত্ব অপর পারাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন; দুষ্টবুদ্ধি বণিক, একদৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল; অনন্তর সূর্য্যের তাপে জলহীন তড়াগের তলদেশস্থ কর্দ্দম যেমন শতধা বিদীর্ণ হয়, দার্বণ যন্ত্রণায় তাহার হৃৎপিণ্ডও সেইরূপ বিদীর্ণ হইল; তাহার মুখ দিয়া রক্ত উঠিতে লাগিল এবং সেই মুহূর্ত্তেই সে প্রাণত্যাগ করিল। ইহার পর বোধিসত্ত্ব দানাদি সৎকার্য্যে জীবন যাপন করিয়া কর্ম্মফলভোগের জন্য লোকান্তর গমন করিলেন।
[কথান্তে সম্যকসম্বুদ্ধ হইয়া শাস্তা এই গাথা পাঠ করিলেন :
মুক্তি-মার্গ প্রদর্শক বুদ্ধের শাসন;
লভিতে সুফল তাহে কর প্রাণপণ।
নিরুৎসাহ অনুতাপ ভুঞ্জে চিরদিন,
বণিক সেরিবা যথা ধর্ম্মজ্ঞানহীন।
এইরূপে অর্হত্ত্ব লাভের উপায় প্রদর্শন করিয়া শাস্তা সত্যচতুষ্টয় ব্যাখ্যা করিলেন, তাহা শুনিয়া সেই হীনবীর্য্য ভিক্ষু অর্হত্ত্বরূপ সর্ব্বোত্তম ফল প্রাপ্ত হইলেন।
পুরাকালে, বর্তমান সময়ের চারিকল্প আগে বোধিসত্ত্ব, সেরিব নামক রাজ্যে ফেরিওয়ালার কাজ করিতেন। তখন তাঁহার নাম ছিল ‘সেরিবান’। সেরিবরাজ্যে সেরিবা নামে আরও এক ব্যক্তি ঐ কারবার করিত। ইহার বড় অর্থলালসা ছিল। একদা বোধিসত্ত্ব তাহাকে সঙ্গে লইয়া তেলবাহনদের অপরপারে অন্ধপুরনগরে বাণিজ্য করিতে গিয়াছিলেন। সেখানে তাঁহারা কে কোন রাস্তায় ফেরি করিয়া বেড়াইবেন তাহা ভাগ করিয়া লইলেন। কথা হইল একজন যে রাস্তায় একবার ফেরি করিয়া গিয়াছেন, অপরজন তাহার পরে সেখানেও ফেরি করিতে পারিবেন।
অন্ধপুরে পূর্ব্বে এক অতুলসম্পত্তিশালী শ্রেষ্ঠীপরিবার বাস করিত। কালে কমলার কোপে পড়িয়া তাহারা নির্ধন হয়, একে একে পুরুষেরাও মারা যায়। যে সময়ের কথা হইতেছে, তখন ঐ বংশে কেবল একটী বালিকা ও তাহার বৃদ্ধা পিতামহী জীবিতা ছিলেন। তাঁহারা অতিকষ্টে প্রতিবেশীদিগের বাড়ীতে কাজকর্ম্ম করিয়া দিনপাত করিতেন। বাড়ীর কর্ত্তা সৌভাগ্যের সময় যে সুবর্ণপাত্রে ভোজন করিতেন, সেটী তখনও ছিল; কিন্তু দীর্ঘকাল ব্যবহৃত না হওয়ায় এবং ভগ্নপাত্রাদির মধ্যে পড়িয়া থাকায় উহার উপর এত ময়লা জমিয়াছিল, যে সহসা উহা সোণার বাসন বলিয়া বোধ হইত না।
একদিন লোভী ফেরিওয়ালা ‘কলসী কিনিবে’ ‘কলসী কিনিবে’ বলিতে বলিতে ঐ শ্রেষ্ঠীদিগের বাড়ীর পাশ দিয়া যাইতেছিল। তাহা শুনিয়া বালিকাটী বলিল, ‘আমায় একখানা গহনা কিনিয়া দাওনা, দিদিমা।’ দিদিমা বলিলেন, ‘বাছা, আমরা গরিব লোক, পয়সা পাইব কোথায়?’ তখন বালিকা সেই সোণার বাসনখানি আনিয়া বলিল, ‘এইখানা বদল দিলে হয় না কি? ইহা ত আমাদের কোন কাজে লাগে না।’ বৃদ্ধা ইহাতে আপত্তি না করিয়া ফেরিওয়ালাকে ডাকিলেন এবং তাহাকে বসিতে বলিয়া বাসনখানি দিয়া কহিলেন, ‘মহাশয়, ইহার বদলে আপনার এই বোনটীকে যাহা হয় একটা জিনিস দিন।’
বাসনখানি দুই একবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া ফেরিওয়ালার সন্দেহ হইল, সম্ভবতঃ উহা স্বর্ণনির্ম্মিত। এই অনুমান প্রকৃত কি না তাহা পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত সে সূচী দিয়া উহার পিঠে দাগ কাটিল এবং উহা যে সোণার বাসন সে সম্বন্ধে তখন আর তাহার কিছুমাত্র সংশয় ছিল না। কিন্তু মেয়েমানুষ দুইটাকে ঠকাইয়া ইহা বিনামূল্যে লইব, এই দূরভিসন্ধি করিয়া সে বলিল, ‘ইহার আবার দাম কি? ইহা সিকি পয়সায় কিনিলেও ঠকা হয়’ অনন্তর সে নিতান্ত অবজ্ঞার ভাণ করিয়া বাসনখানি ভূমিতে ফেলিয়া সে স্থান হইতে চলিয়া গেল।
ইহার ক্ষণকাল পরেই বোধিসত্ত্ব সেই পথে ফেরি করিতে আসিলেন এবং ‘কলসী কিনিবে’, ‘কলসী কিনিবে’ বলিতে বলিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে লাগিলেন। তাহা শুনিয়া বালিকাটী তাহার পিতামহীকে আবার সেই প্রার্থনা জানাইল। বৃদ্ধা কহিলেন, ‘যে বাসন বদল দিতে গিয়াছিলে তাহার ত কোন দামই নাই শুনিলে। আমাদের আর কি আছে, বোন, যাহা দিয়া তোমার সাধ পুরাইতে পারি?’
বালিকা কহিল, ‘সে ফেরিওয়ালা বড় খারাপ লোক, দিদিমা। তাহার কথা শুনিলে গা জ্বালা করে। কিন্তু এ লোকটী দেখতে কত ভাল, ইহার কথাও কেমন মিষ্টি। এ বোধহয় ঐ ভাঙ্গা বাসন লইতে আপত্তি করিবে না।’ তখন বৃদ্ধা বোধিসত্ত্বকে ডাকাইয়া বসিতে বলিলেন এবং বাসনখানি তাঁহার হাতে দিলেন। বোধিসত্ত্ব দেখিবামাত্রই বুঝিলেন উহা সুবর্ণনির্ম্মিত। তিনি বৃদ্ধাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘মা, এ বাসনের দাম লক্ষমুদ্রা। আমার নিকট এত অর্থ নাই।’
বৃদ্ধা কহিলেন, ‘মহাশয়, এই মাত্র আর একজন ফেরিওয়ালা আসিয়াছিল। সে বলিল, ইহার মূল্য সিকি পয়সাও নহে। বোধহয় আপনার পুণ্যবলেই বাসনখানি এখন সোণা হইয়াছে। আমরা ইহা আপনাকেই দিব; ইহার বিনিময়ে আপনি যাহা ইচ্ছা দিয়া যান।’ বোধিসত্ত্বের নিকট তখন নগদ পাঁচ শ কাহণ এবং ঐ মূল্যের পণ্যদ্রব্য ছিল। তিনি ইহা হইতে কেবল নগদ আট কাহণ এবং দাঁড়িপালৱা ও থলিটী লইয়া অবশিষ্ট সমস্ত বৃদ্ধার হস্তে অর্পণ করিলেন এবং তাঁহার অনুমতি লইয়া বাসনখানি গ্রহণ করিয়া যত শীঘ্র পারিলেন নদীতীরে উপস্থিত হইলেন। সেখানে একখানি নৌকা ছিল। তিনি ইহাতে আরোহণ করিয়া মাঝির হাতে আট কাহণ দিয়া বলিলেন, ‘আমাকে শীঘ্র পার করিয়া দাও।’
এদিকে লোভী বণিক শ্রেষ্ঠীদিগের গৃহে ফিরিয়া বাসনখানি আবার দেখিতে চাহিল। সে বলিল, ‘ভাবিয়া দেখিলাম তোমাদিগকে ইহার বদলে একেবারে কিছু না দিলে ভাল দেখায় না।’ তাহা শুনিয়া বৃদ্ধা কহিলেন, ‘সে কি কথা, বাপু? তুমি না বলিলে উহার দাম সিকি পয়সাও নয়! এই মাত্র একজন সাধু বণিক আসিয়াছিলেন। বোধহয় তিনি তোমার মনিব হইবেন। তিনি আমাদিগকে হাজার কাহণ দিয়া উহা কিনিয়া লইয়া গিয়াছেন।’
এই কথা শুনিবামাত্র সেই লোভী বণিকের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে পাগলের মত ছুটাছুটি করিতে লাগিল; সঙ্গে যে সকল মুদ্রা ও পণ্যদ্রব্য ছিল তাহা চারিদিকে ছড়াইয়া ফেলিল। অনন্তর উলঙ্গ হইয়া, ‘হায়, সর্ব্বনাশ হইয়াছে, দুরাত্মা ছল করিয়া আমার লক্ষ মুদ্রার সুবর্ণ পাত্র লইয়া গিয়াছে,’ এইরূপ প্রলাপ করিতে করিতে এবং তুলাদণ্ডটী মুদ্গরের ন্যায় ঘুরাইতে ঘুরাইতে সে বোধিসত্ত্বের অনুসন্ধানে নদীতীরে ছুটিল। সেখানে গিয়া দেখে নৌকা তখন নদীর মধ্যভাগ পর্য্যন্ত গিয়াছে। সে ‘নৌকা ফিরাও’ ‘নৌকা ফিরাও’ বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল; কিন্তু বোধিসত্ত্ব নিষেধ করায় মাঝি নৌকা ফিরাইল না। বোধিসত্ত্ব অপর পারাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন; দুষ্টবুদ্ধি বণিক, একদৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল; অনন্তর সূর্য্যের তাপে জলহীন তড়াগের তলদেশস্থ কর্দ্দম যেমন শতধা বিদীর্ণ হয়, দার্বণ যন্ত্রণায় তাহার হৃৎপিণ্ডও সেইরূপ বিদীর্ণ হইল; তাহার মুখ দিয়া রক্ত উঠিতে লাগিল এবং সেই মুহূর্ত্তেই সে প্রাণত্যাগ করিল। ইহার পর বোধিসত্ত্ব দানাদি সৎকার্য্যে জীবন যাপন করিয়া কর্ম্মফলভোগের জন্য লোকান্তর গমন করিলেন।
[কথান্তে সম্যকসম্বুদ্ধ হইয়া শাস্তা এই গাথা পাঠ করিলেন :
মুক্তি-মার্গ প্রদর্শক বুদ্ধের শাসন;
লভিতে সুফল তাহে কর প্রাণপণ।
নিরুৎসাহ অনুতাপ ভুঞ্জে চিরদিন,
বণিক সেরিবা যথা ধর্ম্মজ্ঞানহীন।
এইরূপে অর্হত্ত্ব লাভের উপায় প্রদর্শন করিয়া শাস্তা সত্যচতুষ্টয় ব্যাখ্যা করিলেন, তাহা শুনিয়া সেই হীনবীর্য্য ভিক্ষু অর্হত্ত্বরূপ সর্ব্বোত্তম ফল প্রাপ্ত হইলেন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।