হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-৫৩) একাদশ অধ্যায়



একাদশ অধ্যায়: দুঃখ আর যেতে দেওয়া

অসুস্থ হওয়াতে সমস্যা কোথায়? - ১৭৮
বক্তৃতার সময় আমি প্রায়ই শ্রোতাদেরকে বলি- তারা যদি কখনো অসুস্থ হয়ে থাকে, তাহলে যেন হাত তোলে। প্রায় প্রত্যেকেই তাদের হাত তোলে।(যারা তোলে না, তারা হয় ঘুমিয়েছিল, নয়তো কোন যৌন কল্পনায় বিভোর ছিল!) আমি তাদেরকে যুক্তি দেখাই- এটাই প্রমাণ করে যে অসুস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে সময়ে সময়ে অসুস্থ না হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক। তাই আমি বলি, ডাক্তারের সাথে দেখা করার সময় এটা কেন বলেন ‘আমার কোন সমস্যা হয়েছে, ডাক্তার’? মাঝে মধ্যে অসুস্থ না হলে সেটাই তো সমস্যা। তাই একজন যুক্তিবাদী মানুষ তার বদলে বলে, ‘আমার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে ডাক্তার। আমি আবার অসুস্থ হয়েছি!’
অসুস্থতাকে সমস্যা হিসেবে দেখা মানে হচ্ছে খারাপ লাগার সাথে সাথে অপ্রয়োজনীয় উদ্বেগ ও অপরাধবোধ যোগ করা। উনবিংশ শতাব্দীর উপন্যাস ‘আরওন এ স্যামুয়েল বাটলার এক সমাজের ছবি আঁকেন মনে মনে, যেখানে অসুস্থতা হলো একটা অপরাধ, আর বিচারকেরা এটাকে ধারাবাহিক অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করেন। উপন্যাসের একটা অনুচ্ছেদে এমন আছে যে, তার ম্যজিস্ট্রেটের সামনে সর্দি নিয়ে হাজির হওয়া এই প্রথম নয়। এ সবকিছু হয়েছিল নিজের দোষেই - সে বাইরের খাবার খেয়েছিল। যথেষ্ট ব্যায়াম করে নি, আর উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভরা জীবনযাপন করেছে। এজন্য তাকে কয়েক বছরের জেল দেওয়া হয়।

যখন আমরা অসুস্থ হই, কতজন নিজেদেরকে দোষী ভাবী বলুন তো? একজন সতীর্থ ভিক্ষু অনেক বছর ধরে এক অজানা রোগে ভুগছিল। সে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বিছানায় কাটাত সারা দিন। সে এত দুর্বল ছিল যে রুমের বাইরেও হেঁটে যেতে পারতো না। বিহার কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসার কোন কিছুই বাদ রাখে নি। সাধ্যমত মেডিকেল থেরাপি, প্রবীন বৈদ্য ও বিকল্প চিকিৎসা, সবকিছুই করা হয়েছে। কিছুতেই কিছু হয় নি। সে মনে করতো একটু ভালো বোধ করছে, আর বাইরে একটু হাঁটতে বেরোত। এরপর আবার সপ্তাহ যাবত বিছানায় থাকতে হতো। অনেকবার তারা মনে করেছে যে সে মারা যাবে।

একদিন বিহারাধ্যক্ষ সমস্যাটার একটা দারুণ সমাধান খুঁজে পেলেন। তিনি অসুস্থ ভিক্ষুর রুমে গিয়ে হতাশ চোখে চেয়ে রইলেন। তিনি বললেন, ‘আমি এসেছি এই বিহারের ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের পক্ষ থেকে, উপাসক উপাসিকাদের পক্ষ থেকে। এরা সবাই তোমাকে ভালোবাসে ও যত্ন নেয়। এদের সবার পক্ষ হয়ে আমি তোমাকে মরার অনুমতি দিচ্ছি। তোমার আর সেরে ওঠার দরকার নেই।

এই কথায় ভিক্ষুটি কেঁদে উঠল। সে কত চেষ্টা করেছে ভালো হয়ে ওঠার জন্য। তার বন্ধুরা কত কষ্ট করে তার রোগগ্রস্ত শরীরকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে, সে তাদেরকে মর্মাহত করতে চায় নি। সুস্থ হতে না পেরে, সে নিজেকে এমন ব্যর্থ, এমন অপরাধী ভাবছিল যে বলার নয়। অধ্যক্ষের কথা শুনে তখন তার আর অসুস্থ হতে কোন পিছুটান রইল না। সে এখন মরতে পারে। বন্ধুদেরকে খুশি করার জন্য সুস্থ হওয়ার আর কোন প্রয়োজন নেই। বিশাল দায়িত্ববোধ থেকে ভারমুক্ত হয়ে পরম স্বস্তিতে সে কেঁদে ফেলল।

এর পরে কী হলো বলে আপনার মনে হয়? সেদিন থেকে সে আরোগ্য লাভ করতে শুরু করল।

অসুস্থ কোন রোগীকে দেখতে যাওয়া- ১৮০
হাসপাতালে কাউকে দেখতে গিয়ে আমাদের মধ্যে কতজন বলেন, ‘আজকে কেমন বোধ হচ্ছে?’
শুরুতেই কী বোকার মতো কথা! অবশ্যই তারা জঘন্য বোধ করছে। তা না হলে তো তারা হাসপাতালেই থাকতো না। থাকতো কি? তাছাড়া এই সাধারণ শুভেচ্ছাসূচক কথাটা রোগীকে গভীর মানসিক উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দেয়। তারা ভাবে, সত্যিকথাটা বললে হয়তো দর্শনার্থীর মন খারাপ হয়ে যাবে। এত কষ্ট করে মূল্যবান সময় ব্যয় করে হাসপাতালে দেখতে এলো, এমন সহৃদয় লোককে কীভাবে মনে দুঃখ পাওয়ার মতো এমন জবাব দেবে সে? কীভাবে বলবে যে, সে এখন অসহায় বোধ করছে, বাসি হয়ে যাওয়া চা পাতার মতো অচল বোধ করছে? তাই তার বদলে সে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়, ‘মনে হয় আজকে একটু ভালো বোধ করছি। আর মনে মনে নিজেকে দোষী ভাবে, সুস্থ হচ্ছে না কেন! দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক দর্শনার্থীই রোগীকে আরো অসুস্থ বোধ করতে দেন।

তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের অনুসারী এক অস্ট্রেলিয়ান ভিক্ষুণী পার্থের এক হাসপাতালে ক্যান্সারে মারা যাচ্ছিল। আমি তাকে কয়েক বছর ধরে চিনতাম আর প্রায়ই তাকে হাসপাতালে দেখতে যেতাম। একদিন সে আমার বিহারে ফোন করে আমাকে অনুরোধ করল তাকে সেদিন দেখতে যাওয়ার জন্য। কারণ তার মনে হচ্ছিল তার সময় ঘনিয়ে আসছে। তাই আমি কাজ ফেলে দ্রুত একজনকে নিলাম সত্তর কিলোমিটার দূরে সেই হাসাপাতালে আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হাসপাতালে অভ্যর্থনা কক্ষের নার্সটা কড়াভাবে শুনিয়ে দিল যে তিব্বতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর কড়া নির্দেশ, যেন কেউ তাকে দেখতে না যায়।

‘কিন্তু আমি এত দূর থেকে এসেছি শুধু তাকে দেখার জন্য,’ আমি ভদ্র সুরে বললাম।

নার্সটা খেঁকিয়ে উঠল, ‘আমি দুঃখিত। সে কোন দর্শনার্থী চায় না আর আমাদেরকে তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।

‘কিন্তু ব্যাপারটা এমন হতেই পারে না। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘সে দেড় ঘন্টা আগে আমাকে ফোন করে আসতে বলেছে।

নার্সটি অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে আমাকে ভস্ম করার চেষ্টা করে পরে তাকে অনুসরণ করতে বললো। আমরা সেই অস্ট্রেলিয়ান ভিক্ষুণীর রুমের বাইরে দাঁড়ালাম। নার্সটি বন্ধ দরজার উপরে সাঁটানো বড় বড় করে লেখা কাগজটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
একদম কোন দর্শনার্থী নয়।

দেখলেন তো!’ নার্সটি বললো।

একটু ভালো করে দেখতেই তার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা দেখতে পেলাম, ‘... আজান ব্রাহম্ বাদে। তাই আমি ভেতরে গেলাম।

আমি ভিক্ষুণীকে জিজ্ঞেস করলাম এত কড়া করে নোটিশটা টাঙানোর কারণটা কী। সে ব্যাখ্যা করল এভাবে- যখন তার বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনেরা তাকে দেখতে আসে, তারা তাকে মরতে দেখে এতই বিষন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে তার আরো খারাপ লাগে।

সে বললো, ক্যান্সারে মরাটা এমনিতেই যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু তার সাথে সাথে দর্শনার্থীদের আবেগীয় সমস্যাগুলোকেও সামাল দিতে হলে আরো খারাপ লাগে। সে বললো যে, আমিই তার একমাত্র বন্ধু যে তাকে ব্যক্তি হিসেবে দেখে, কোন মরণাপন্ন হিসেবে নয়, যে তার শোচনীয় অবস্থা দেখেও বিচলিত হয় না। বরং তার বদলে তাকে মজা করে কৌতুক শোনায় আর হাসায়। তাই এক ঘন্টা ধরে আমি তাকে কৌতুক শোনালাম আর সে আমাকে শেখাল কীভাবে একজন মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে সাহায্য করতে হয়। আমি তার কাছ থেকে শিখলাম যে, যখন আপনি হাসপাতালে কাউকে দেখতে যাবেন, ব্যক্তির সাথে কথা বলুন। অসুস্থতার ব্যাপারটা ডাক্তার ও নার্সদের হাতেই ছেড়ে দিন। সে আমার দেখা করার দুই দিন পরে মারা গিয়েছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !