একাদশ অধ্যায়: দুঃখ আর যেতে দেওয়া
#বেচারা
আমি আর সৌভাগ্যবান তারা - ১৭৬
থাইল্যান্ডে
জুনিয়র ভিক্ষু হিসেবে আমি যেন খুব বৈষম্যের শিকার! সিনিয়র ভিক্ষুরা সবচেয়ে ভালো খাবার
খান, বসেন সবচেয়ে নরম গদিতে, আর তাদেরকে ঠেলাগাড়িও ঠেলতে হয় না। সেখানে আমার একবেলা
খাবার ছিল জঘন্য ধরনের। অনুষ্ঠানগুলোতে আমাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হতো শক্ত কংক্রিটের
মেঝেতে (মেঝেটা ছিল উঁচু নিচু, কারণ গ্রামবাসীরা কংক্রিট ঢালাই দিতে জানত না)। আর মাঝে
মাঝে আমাকে খুব কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে হতো। আমি কত দুর্ভাগা, আর ওরা, সিনিয়র ভিক্ষুরা
কত ভাগ্যবান।
আমি
নিজের এই অভিযোগগুলো নিয়ে ভেবে ভেবে অনেক ঘন্টা কাটিয়েছি। সিনিয়র ভিক্ষুরা সম্ভবত আধ্যাত্মিকতার
অনেক উপরে পৌঁছে গেছেন। সুস্বাদু খাদ্যগুলো তাদের কী কাজে আসবে? আমাকেই সেই ভালো ভালো
খাদ্যগুলো দেওয়া উচিত। সিনিয়র ভিক্ষুরা তো বছরের পর বছর ধরে শক্ত মেঝেতে বসে থাকতে
অভ্যস্ত। তাই বড়, নরম গদিগুলো পাওয়া উচিত আমারই। তাছাড়া সিনিয়র ভিক্ষুরা সবাই কম বেশি
মোটাসোটা। ভালো ভালো খাবার দাবার খেয়ে তারা আরামেই আছেন, যা দেখলেই বোঝা যায়। তারা
শুধু জুনিয়র ভিক্ষুদেরকে কাজ করতে বলেন। নিজেরা কিছুই করেন না। তারা কীভাবে জানবেন
বাইরে এত গরম? তারা কীভাবে জানবেন ঠেলাগাড়ি ঠেলা কতটা কষ্টের? বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা
তো তাদের মাথা থেকেই বের হয়। সেগুলো তারা নিজেরাই করে না কেন? ‘আমি আসলেই দুর্ভাগা,
ওরা কত ভাগ্যবান!’
যখন
আমি সিনিয়র ভিক্ষু হয়ে উঠলাম, তখন আমি ভালো খাবার খেলাম, নরম গদিতে বসলাম আর কায়িক
পরিশ্রম কমই করলাম। তাতেও জুনিয়র ভিক্ষুদেরকে আমার হিংসে হলো। তাদের তো আর ধর্মদেশনা
দিতে হয় না। সারাদিন লোকজনের সমস্যাগুলো শুনতে হয় না। বিহার পরিচালনায় তো আর তাদের
ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করতে হয় না। তারা দায়িত্বমুক্ত আর নিজের জন্য তাদের আছে অনেক
অনেক সময়। আমি নিজেই নিজেকে বলতে শুনলাম, ‘আমি বেচারা দুর্ভাগা, ওরা কত ভাগ্যবান।’
পরে
আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। জুনিয়র ভিক্ষুদের আছে ‘জুনিয়র ভিক্ষু হওয়ার দুঃখকষ্ট’।
সিনিয়র ভিক্ষুদের আছে ‘সিনিয়র ভিক্ষু হওয়ার দুঃখকষ্ট’।
যখন আমি সিনিয়র ভিক্ষু হলাম, তখন দুঃখকষ্টগুলোর রূপটাই কেবল পাল্টে গিয়েছিল। ঠিক একই
ব্যাপার ঘটে যখন ব্যাচেলর লোকেরা বিবাহিত লোকদের হিংসে করে, আর বিবাহিত লোকেরা হিংসে
করে ব্যাচেলরদেরকে। আমাদের সবারই এখন জানা উচিত যে, বিয়ে করে আমরা কেবল ব্যাচেলর জীবনের
দুঃখকষ্টগুলোর সাথে বিবাহিত জীবনের দুঃখকষ্টগুলো বদলাবদল করছি। আর যখন আমাদের মধ্যে
বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তখন আমরা বিবাহিত জীবনের দুঃখকষ্টগুলোর সাথে একাকী জীবনের দুঃখষ্টগুলোর
বদলাবদল করছি মাত্র। এভাবেই এটা চলতে থাকে। বেচারা আমি, ভাগ্যবান তারা।
কোন
কিছু হয়ে তবেই আপনি সুখী হবেন এমন ভাবাটা মোহ। অন্য কোন কিছু হয়ে দুঃখকষ্টের রূপটাই
যা পাল্টায়। কিন্তু যখন আপনি এখন যেমন তাতেই সন্তুষ্ট হন, সেটা জুনিয়র বা সিনিয়র, বিবাহিত
বা অবিবাহিত, ধনী বা গরীব, যাই আপনি হোন না কেন, আপনি তখন দুঃখকষ্ট থেকে মুক্ত। তখন
আপনি ভাবতে পারেন- ভাগ্যবান এখন আমি, বেচারা তারা।
অসুস্থ
হলে তার জন্য উপদেশ- ১৭৭
উত্তর
পূর্ব থাইল্যান্ডে তখন আমার ভিক্ষু হয়ে অবস্থানের দ্বিতীয় বছর। টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত
হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম আমি। জ্বর এমন ছিল যে উবনের আঞ্চলিক হাসপাতালে ভিক্ষুদের ওয়ার্ডে
ভর্তি করাতে হলো আমাকে। সেই দিনগুলোতে, ১৯৭০ এর মাঝামাঝি সময়ে উবন ছিল একটা হতদরিদ্র
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। আমার শরীর তখন খুব দুর্বল ও সারা গায়ে ব্যথা। হাতে এক জায়গায়
ক্ষত। এমন অবস্থায় আমি দেখলাম, পুরুষ নার্সটা বিকেল ৬টায় চলে যাচ্ছে। আধা ঘন্টা পরেও
তার বদলে কোন নার্স এলো না। আমি পাশের বেডের ভিক্ষুকে বললাম- রাতের নার্স তো এখনো এলো
না। ব্যাপারটা কাউকে জানানো দরকার। আমাকে তাড়াতাড়ি জানিয়ে দেওয়া হলো ভিক্ষুদের ওয়ার্ডে
রাতে কোন নার্স থাকে না। রাতের বেলায় যদি আাপনার খারাপ কিছু হয়ে যায়, সেটা আপনার কর্মফল।
অসুস্থ হয়ে এমনিতেই খুব খারাপ লাগছিল আমার। আর এটা জেনে তো রীতিমত আতংকিত হয়ে গেলাম
আমি।
চার
সপ্তাহ ধরে আমার পাছায় সকাল বিকেলে এন্টিবায়েটিক ইনজেকশন দিল বুনো মোষের মত এক পুরুষ
নার্স। এটা ছিল তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশের একটা হাসপাতাল। তাই একই সুঁচ বারবার ব্যবহার
করা হত। যা এমনকি ব্যাংককেও এত বেশিবার ব্যবহার করার অনুমোদন ছিল না। সেই শক্তিশালী
হাতের নার্সটা, ইনজেকশন দেওয়ার সময় মাংসে সুঁচ ঢুকাতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সজোরে কোপাতো
আমাকে। ভিক্ষুদেরকে কঠিন ও অসাধারণ সহ্যক্ষমতা সম্পন্ন হিসেবে আশা করা হয়, কিন্তু আমার
পাছা এমন ছিল না। সেখানে খুব ব্যথা করত। আমি তখন সেই নার্সটাকে ঘৃণা করতাম।
আমার
সারা গায়ে ব্যথা, দুর্বল। জীবনে এত দুর্বিসহ ভাব কখনো বোধ করি নি। এমন অবস্থায় এক বিকেলে
আজান চাহ আসলেন ভিক্ষুদের ওয়ার্ডে আমাকে দেখতে। আমাকে দেখতে! আমি এত খুশি ও মুগ্ধ হলাম,
বলার নয়। আনন্দে যেন ভাসছিলাম আমি। এত দারুণ বোধ করছিলাম- যতক্ষণ না আজান চাহ তার মুখ
খুললেন। তিনি যা বললেন, পরে আমি জেনেছি তা তিনি হাসপাতালে অনেক অসুস্থ ভিক্ষুকেই বলেছেন।
তিনি
আমাকে বললেন, ‘হয় তুমি ভালো হয়ে উঠবে, নয়তো মরবে।’
এই
বলে তিনি চলে গেলেন।
আমার আনন্দ ভেঙে খানখান
হয়ে গেল। তার আসায় আমার যে খুশি লেগেছিল তা উধাও হয়ে গেল। সবচেয়ে খারাপ জিনিসটা হলো
যে, আপনি কখনোই আজান চাহর কথায় ভুল ধরতে পারবেন না। তিনি যা বলে গেলেন তা ছিল খাঁটি
সত্য। আমি হয় ভালো হয়ে উঠবো, নয় মারা যাবো। যাই হোক না কেন, অসুস্থতার বেদনা আর থাকলো
না । অবাক করা ব্যাপার, সেটা ছিল খুব আশ্বস্ত হওয়ার বিষয়। ফলে যা ঘটলো, আমি মরলাম না,
বরং ভালো হতে শুরু করলাম। কী দারূন এক শিক্ষক আজান চাহ।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।