মিলিন্দ প্রশ্নের ৫ম বর্গের মণ্ডক প্রশ্ন পর্বে রাজা মিলিন্দ বুদ্ধের সর্বজ্ঞতা ও অকুশলমুক্ততা বিষয়ে প্রশ্ন করেন। ভান্তে নাগসেন তার যুক্তি ও বাস্তবতা দিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রাজার সন্দেহ দূর করে। এখানে সেই প্রশ্ন+উত্তর পর্বটি হুবাহু তুলে ধরা হলো-
“ভন্তে নাগসেন! তথাগত কি সমস্ত অকুশল দগ্ধ করিয়া সর্বজ্ঞতা প্রাপ্ত হইয়াছেন, অথবা কিছু অকুশল অবশিষ্ট থাকিতেই সর্বজ্ঞ হইয়াছেন?”
“মহারাজ! সমস্ত অকুশল দগ্ধ করিয়া ভগবান সর্বজ্ঞতা প্রাপ্ত হইয়াছেন। তাঁহার কোন অকুশল অবশিষ্ট নাই।”
“ভন্তে! তাঁহার দৈহিক কোন দুঃখানুভূতি হইয়াছিল কি?”
“হ্যাঁ, মহারাজ! রাজগৃহে ভগবানের পদ প্রস্তর দ্বারা আহত হইয়াছিল, তাহাতে তাঁহার রক্তস্রাব জনিত পীড়া উৎপন্ন হয়। শরীরে দোষাধিক্য হইলে একবার জীবক তাঁহাকে বিরেচন করাইয়াছিল।” বাতরোগ হওয়ায় সেবক (আনন্দ স্থবির) গরম জলের দ্বারা পরিচর্যা করিয়াছিলেন।”
“ভন্তে! যদি ভগবান নিজের সমস্ত অকুশল দগ্ধ করিয়া সর্বজ্ঞতা লাভ করিয়া
থাকেন এই কথা মিথ্যা যে তাঁহার পদ প্রস্তর দ্বারা আহত হইয়াছিল এবং রক্ত স্রাব জনিত পীড়া উৎপন্ন হইয়াছিল। আর যদি তাঁহার পদ প্রস্তর দ্বারা আহত হইয়া থাকে এবং রক্তস্রাব জনিত পীড়া উৎপন্ন হইয়া থাকে তবে এই কথা মিথ্যা যে তিনি নিজের সমস্ত অকুশল দগ্ধ করিয়া সর্বজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন। ভন্তে! কর্ম ব্যতীত কোনকিছুই (সুখ-দুখঃ) অনুভূত হয়না। সমস্ত অনুভূতির মূল উৎস কর্ম।
কর্ম প্রভাবেই জীবের সুখ-দুখঃ হয়। ইহাও উভয় কোটিক প্রশ্ন, আপনার সম্মুখে উপস্থাপিত হইয়াছে। আপনাকে ইহার সমাধান করিতে হইবে।”
“না মহারাজ! যাবতীয় অনুভূতি কর্ম মুলক নহে আটটি কারনে অনুভূতি সমুহ উৎপন্ন হয় যদ্দারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রানী সুখ-দুঃখ অনুভব করিয়া থাকে। সেই আটটি কারন কি? বায়ুর প্রকোপ, পিত্তের প্রকোপ, শ্লেস্মার আধিক্য, সান্নিপাতিক, ঋতুর পরিবর্তন, খাদ্য ও পানীয়ের ভীষণ ব্যবহার উপক্রম প্রসুত এবং স্বীয় কর্মফল। এই আটটি কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রাণী সুখ-দুঃখ অনুভব করিয়া থাকে। মহারাজ! এক্ষেত্রে যাহারা বলে যে কর্মই জীবগণকে প্রপীড়িত করে এবং পূর্বের সাতটি কারন অস্বীকার করে তাহাদের সেই বাক্য মিথ্যা।”
“ভন্তে! বায়ুর প্রকোপের সেই সাতটি কারনও কর্মমূলক; কর্মপ্রভাবেই ঐ সকল সম্ভব হয়।”
“মহারাজ! যদি সমস্ত ব্যাধিই কর্মসমুত্থিত হইত, তাহা হইলে উহাদের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষন হইত না। মহারাজ! দশ-কারণে বায়ু প্রকোপিত হয়। যথা শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা, পিপাসা, অতি ভোজন, অধিক দাড়ান, অতি পরিশ্রম, অতি দৌড়ান, বাহ্যিক উপক্রম ও স্বীয় কর্মফল। এই কারন সমুহের মধ্যে প্রথম নব কারণ পূর্ব জন্ম ও পরজন্মের সহিত সম্পর্কযুক্ত নহে। কেবল বর্তমান জন্মেই উৎপন্ন হইয়া থাকে। সেই কারণে বলা যায় না যে ‘সমস্ত! বেদনা কর্মসম্ভূত’।
মহারাজ! পিত্ত কোপিত হওয়ার তিন কারণ শীত, উষ্ণ ও ভীষম ভোজন। শ্লেষ্মা কোপিত হওযার তিন কারণ শীত, উষ্ণ ও খাদ্য-পানীয়ের অত্যাচার। মহারাজ! বায়ু, পিত্ত ও শ্লেস্মা প্রকোপের কারণ সমুহের দ্বারা কোপিত হইয়া যুগপৎ স্ব স্ব বেদনাই উৎপন্ন করে। ঋতু পরিণামজ বেদনা ঋতুর পরিবর্তনেই হয়। বিষম আহারজ বেদনা বিষম আহারেই হয়। উপক্রমিক বেদনা ক্রিয়াও কর্মফলেই হইয়া থাকে। কর্ম-বিপাকজ বেদনা পূর্ব (জন্ম)-কৃতকর্ম প্রভাবেই হয়।
মহারাজ! এই প্রকারে কর্ম বিপাকজ বেদনা স্বল্প মাত্র, অন্য বেদনা অপেক্ষাকৃত বহুতর। এক্ষেত্রে মূর্খেরাই সমস্ত কর্ম বিপাকজ মাত্রা লঙ্গন করে। বুদ্ধ জ্ঞান ব্যতীত কাহারও পক্ষে সেই সকল নির্নয় করা সম্ভব নহে।
“মহারাজ! প্রস্তর খন্ড দ্বারা ভগবানের পদ যে আহত হইয়াছিল উহা বায়ু প্রকোপের দরুণ নহে-----কর্মবিপাকজও নহে। কিন্তু উহা ঘটনাক্রমে কাহারো উপক্রম দ্বারাই ঘটিয়াছে। মহারাজ! বহু শত-সহস্র জন্ম হইতে তথাগতের প্রতি দেবদত্তের প্রতিহিংসা চলিয়া আসিতেছে। তিনি সেই হিংসাপ্রণোদিত হইয়া বড় ও ভারী শিলাখণ্ড লইয়া‘বুদ্ধের মাথায় নিক্ষেপ করিব’ বলিয়া নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। তখন সেই শিলা দুই বড় পাথরে সংলগ্ন হইয়া তথাগতের নিকট না পৌঁছিতেই অবরুদ্ধ হইয়া পড়িল। উহাদের সংঘাতে এক ক্ষুদ্র প্রস্তর খণ্ড উঠিয়া তথাগতের পাদে পতিত হইয়া তৎদ্বারা তাঁহার রক্তপাত হইয়াছিল। মহারাজ! ভগবানের এই দুঃখবেদনা স্বীয় কর্মফল কিংবা কাহারো প্রক্রিয়া সিদ্ধ হইয়াছে। উহা ছাড়া অন্য বেদনা ছিল না। যেমন ক্ষেত্র কিংবা বীজের দোষে অঙ্কুরিত হয় না। কর্ম বিপাক কিংবা কোন প্রক্রিয়া হইতে ভগবানের এই দুঃখ বেদনা উৎপন্ন হইয়াছে। তাহা ছাড়া অন্য বেদনা নহে। অথবা যেমন উদর কিংবা খাদ্যদোষে ভুক্তদ্রব্য হজম হয় না। সেইরূপ কর্মবিপাক কিংবা কোন প্রক্রিয়া হইতে ভগবানের এই দুঃখ বেদনা উৎপন্ন হইয়াছে। তাহা ছাড়া অন্য বেদনা নহে।”
“মহারাজ! অথচ ভগবানের কর্মফল জনিত বেদনা ও খাদ্য-পানীয়ের বিষম ব্যবহার জনিত কোন বেদনা হয় নাই। অবশিষ্ট ছয় প্রকার সমুত্থান বা কারণ হইতে ভগবানের (দুঃখ) বেদনা হইয়া থাকে। কিন্তু সেই বেদনার এমন শক্তি নাই যাহাতে উহা ভগবানের প্রাণান্তকর হইতে পারে। মহারাজ! এই চাতুর্ভৌতিক দেহে ইষ্টানিষ্ট ও শুভাশুভ বেদনা উৎপন্ন হইয়াই থাকে। মহারাজ! আকাশে উৎক্ষিপ্ত লোষ্ট্র মাটিতে আসিয়া পতিত হয়। কেমন, মহারাজ! সেই লোষ্ট্র কি পৃথিবীর পূর্বকৃত কর্মফলে এইরূপ তাহাতে পতিত হয়?”
“মহারাজ! এই প্রকারেই ভগবানকে পৃথিবীর ন্যায় জানিবেন। যেমন লোষ্ট্র কর্ম ব্যতিতই মাটিতে নিপতিত হয়, সেইরূপ পূর্বকৃত কর্মফল ব্যতীত অন্য কারণে সেই শিলাখণ্ড তথাগতের পাদে পতিত হইযাছে। মহারাজ! এই জগতে মানুষেরা পৃথিবী খনন করে, বিদীর্ণ করে। তবে কি পৃথিবীর পূর্বকৃত কর্মের ফলের দরুন এইভাবে খনিত ও বিদীর্ণ হয়?
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! এইরূপ, যেই প্রস্তর খণ্ড ভগবানের পাদে পতিত হইয়াছিল তাহা ভগবানের পূর্ব কর্মের দরুণ পতিত হয় নাই। ভগবানের যে রক্তস্রাবজনিত পীড়া হইয়াছিল উহাও পূর্ব কর্মের দরুণ হয় নাই, সন্নিপাতবশতই হইয়াছে। তাঁহার অপর যে সকল দৈহিক ব্যাধি উৎপন্ন হইয়াছে, উহারা কর্মসম্ভূত নহে। কিন্তু অবশিষ্ট ষড়বিধ কারণের অন্যতম কারণ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।
মহারাজ! দেবাতিদেব ভগবান সংযুক্ত নিকায়ের মোলিয়া সীবক নামক উপদেশে ভাষণ করিয়াছেনঃ ‘সীবক! দৈহিক কোন কষ্ট পিত্ত প্রকোপিত হইলেই উৎপন্ন হয়। তোমার পক্ষে স্বয়ং ইহা জানা উচিত। এবং জগতের ইহা সত্যসম্মত বিষয়-----সীবক এক্ষেত্রে শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ এই ধারণ পোষণ করেন ও এইরূপ বলেন যে মানুষ সুখ, দুঃখ ও অদুঃখ-অসুখ যাহা কিছু ভোগ করে তৎসমুদায় পূর্ব কৃত কর্ম হেতুই ভুগিয়া থাকে তাহারা স্বীয় অভিজ্ঞতা ও লোকসম্মত সত্যকে লঙ্ঘন করিতেছে। সুতরাং আমি বলি যে তাহাদের মতবাদ মিথ্যা। শ্লেষ্মা, বায়ু, সন্নিপাত প্রভৃতি দ্বারা উৎপন্ন বেদনাকে এই ভাবে জানিতে হইবে। হইা স্বয়ং ও জানা উচিত এবং জগতে ইহা সত্যসম্মত বিষয়। সীবক! যে সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ এরূপ বলে ও প্রচার করে যে সমস্ত অনুভুতি সুখ, দুঃখ কিংবা অদুঃখ-অসুখ নিজের কর্মফলের দরুন হইয়া থাকে তাহারা নিজের অভিজ্ঞতা লোকসম্মত সত্যকে লঙ্ঘন করিতেছে। সুতরাং আমি বলিতেছি যে তাহাদের এই মতবাদ মিথ্যা।’
মহারাজ! এই প্রকারে ইহা জানা উচিত যে সমস্ত বেদনা কর্মফলের দরুন উৎপন্ন হয় না। অতএব ইহাও স্বীকার করা উচিত যে সমস্ত অকুশল দগ্ধ করিয়াই ভগবান সর্বজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন।”
“অতি উত্তম, ভন্তে! আপনি যেরূপ বলিতেছেন আমি সেরূপই স্বীকার করিতেছি।”
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।