“ভন্তে নাগসেন! ভগবান বলিয়াছেন-‘আনন্দ! এই সদ্ধর্ম এখন পঞ্চশত বর্ষ পর্যন্ত থাকিবে।’ পুনরায় পরিনির্বাণ সময়ে পরিব্রাজক সুভদ্র কর্তৃক প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া ভগবান ইহাও বলিয়াছেন,‘সুভদ্র! যদি ভিক্ষুগণ ধর্মানুসারে বিহরণ করে তবে এই জগত কখনও অর্হৎ শূন্য হইবে না।’ ইহা তাঁহার অশেষ, নিঃ শেষ ও নিষ্পর্যায় বচন।”
“ভন্তে! যদি ভগবান ইহা ঠিক বলেন,‘আনন্দ! এই সদ্ধর্ম এখন পঞ্চশত বর্ষ পর্যন্ত থাকিবে’ তবে এই বচন মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় যে‘এই জগত কখনও অর্হৎশূন্য হইবে না।’ আর যদি ভগবান ইহা বলিয়া থাকেন, ‘এই জগত অর্হৎশূন্য হইবে না’ তবে বচন মিথ্যা প্রতিপন্ন যে,‘ এই সদ্ধর্ম এখন পঞ্চশত বর্ষ পর্যন্ত থাকিবে।
ভন্তে! ইহাও উভয়কোটিত প্রশ্ন। ইহা গভীর হইতে গভীরতর, প্রবল হইতে প্রবলতর ও গ্রন্থিযুক্ত হইতে গ্রন্থিযুক্ততর। এই প্রশ্ন আপনার সম্মুখে উপস্থাপিত করা হইয়াছে। সমুদ্রাভ্যন্তরগত মকরের ন্যায় এ বিষয়ে আপনার জ্ঞান-বল প্রদর্শন করুন।”
“মহারাজ! ভগবান যথার্থই বলিয়াছেন,‘আনন্দ, এই সদ্ধর্ম এখন পঞ্চশত বর্ষ পর্যন্ত থাকিবে।’পুনরায় পরিনির্বাণ সময়ে পরিব্রাজক সুভদ্র কর্তৃক প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া ভগবান ইহাও বলিয়াছেনÍ‘সুভদ্র! যদি ভিক্ষুগণ ধর্মানুসারে বিহরণ করে তবে এই জগত কখনও অর্হৎশূন্য হইবে না।’
কিন্তু ভগবানের সেই বচন অর্থ ও শব্দ হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন। ইহাদের মধ্যে একটিতে বুদ্ধশাসন কতদিন চলিবে, তাহার সীমা নির্দেশিত। আর একটিতে বুদ্ধশাসনের শীলাদি আচরণের ফল প্রকাশিত হইয়াছে। ইহারা উভয়ে পরস্পর হইতে সম্পূর্ণ দ্রুরে ও সম্পর্কবর্জিত।
যেমন আকাশ পৃথিবী হইতে এবং সুখ দুঃখ হইতে সম্পূর্ণ দ্রুরে ও সস্পর্কবিবর্জিত সেইরূপ পূর্বোক্ত উভয়বিধ বাক্য পরস্পর সম্পূর্ণ ভিন্ন ও সর্ম্পকবিবর্জিত। তথাপি আপনার প্রশ্ন যাহাতে ব্যর্থ না হয় তজ্জন্য সহজভাবে উপমা সহকারে আপনাকে বলিব।
মহরাজ! ভগবান যে বলিয়াছেনÍ‘আনন্দ! এখন পঞ্চশত বর্ষ পর্যন্ত সদ্ধর্ম থাকিবে’ ভগবান উহাতে কেবল শাসনের অবনতি প্রকাশচ্ছলে শেষ সীমা নির্দেশ করিয়াছেন। তিনি পরিষ্কার বলিয়াছেনÍ‘আনন্দ! যদি ভিক্ষুণীদিগকে প্রব্রজ্যা দেওয়া না হইত তবে সদ্ধর্ম সহস্র বৎসর পর্যন্ত থাকিত। কিন্তু এখন কেবল পঞ্চশত বর্ষ পর্যন্ত থাকিবে।’
মহারাজ! ভগবান কেবল এইরূপ বলিয়া সত্যই কি সদ্ধর্মের অন্তর্ধান সূচিত করিয়াছেন অথবা ধর্মবাহকগণের নিন্দা করিয়াছেন?”
“না, ভন্তে! তাঁহাদের নিন্দা করেন নাই।”
“মহারাজ! ভগবান পরিহানির বিষয় বলিতে যাইয়া তাহার সীমা প্রকাশ করিয়াছেন। যেমন, কোন ব্যক্তির সঞ্চিত ধন নষ্ট হইলে সে নষ্টাবশেষ লইয়া জনগণকে প্রকাশ করে‘আমার এত সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছে এবং এই পরিমাণ অবশিষ্ট আছে’ সেইরূপ ভগবান পরিহানির বিষয় প্রকাশ করিতে গিয়া দেব-মানবগণকে ইহা বলিয়াছেন। ইহাতে তিনি শাসনের সীমা নির্দেশ করিয়াছেন মাত্র।
পনুরায় স্বীয় পরিনির্বাণ সময়ে সুভদ্র পরিব্রাজককে শ্রমণদিগকে প্রশংসা করিবার জন্য ভগবান বলিয়াছেন-‘সুভদ্র! যদি এই ভিক্ষুগণ ধর্মানুসারে ঠিকভাবে থাকে তবে জগতে কখনও অর্হৎশূন্য হইতে পারে না।’
এতৎদ্বারা ধর্মাচরণের ফল প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু আপনি সদ্ধর্ম স্থিতির সীমা নির্দেশ ও উহার অনুকুল আচরণের ফল-প্রকাশ এই দুই বিষয় একাভিপ্রায়যুক্ত করিয়াছেন। যদি আপনার শুনিবার ইচ্ছা হয় তবে আমি উহাদের সম্বন্ধ একাভিপ্রায়যুক্ত করিয়া বুঝাইতে পারি। অবিক্ষিপ্ত চিত্তে উত্তমরূপে শ্রবণ করুন, মনোযোগ দিন।
মহারাজ! মনে করুন, এখানে নব সলিলপূর্ণ এক সরোবর আছে। জল উহার মুখ পর্যন্ত উচ্ছলিত এবং চতুর্দিকে পরিচ্ছন্ন বাঁধ। সেই সরোবরের জলের পরিক্ষয় না হইতে যদি তদুপরি প্রবল মেঘ ক্রমান্বয়ে বর্ষণ করিতে থাকে, তবে কি মহারাজ! সেই সরোবরের জলের পরিক্ষয় ও নিঃশেষ হইবে?”
“না, ভন্তে!”
“কেন?”
“ভন্তে! মেঘের ক্রমান্বয়ে প্রবর্ষণের দরুন।”
“মহারাজ! সেইরূপ ভগবানের উপদিষ্ট উত্তম সদ্ধর্ম এক সরোবর। উহা আচার, শীল, গুণ, ব্রত ও পতিপত্তিরূপ নির্মল নব সলিল দ্বারা সতত পরিপূর্ণ। উহা উচ্ছলিত হইয়া ভবাগ্রকেও অভিভূত করিয়া থাকে। যদি ইহাতে বুদ্ধপুত্রগণ সর্বদা আচার, শীল, গুণ ও পতিপত্তিরূপ প্রবল মেঘ ক্রমান্বয়ে অভিবর্ষণ করান তবে এই বুদ্ধোপদিষ্ট উত্তম সদ্ধর্মসরোবর দীর্ঘকাল বিদ্যমান থাকিবে। সুতরাং জগত কখনও অর্হৎশূন্য হইতে পারে না। ভগবানের ইহাই অভিপ্রায় ছিল, তজ্জন্য তিনি বলিয়াছেনÍ‘সুভদ্র! যদি এই ভিক্ষুগণ ধর্মানুসারে বিহরণ করে তবে জগত কখনও অর্হৎশূন্য হইবে না।’
মহারাজ! যদি কেহ কোন অগ্নিরাশি প্রজ্বলিত করে এবং তাহাতে উপর্যুপরি শুষ্ক তৃণ, কাষ্ঠ ও গোময়াদি ইন্ধন দেয় তবে কি সেই অগ্নিরাশি নিভিয়া যাইবে?”
“না, ভন্তে! উহা আরো অধিক জ্বলিবে অধিকতর শিখা বিস্তার করিবে।”
“মহারাজ! ঠিক সেই প্রকার দশ সহস্র লোকধাতুতে বুদ্ধের ধর্মও আচার, শীল, গুণ, ব্রত ও প্রতিপত্তিদ্বারা প্রজ্বলিত ও উদ্ভাসিত হইতেছে। তদুপরি বুদ্ধপুত্রগণ যদি সাধনার পঞ্চাঙ্গ সমন্বিত হইয়া সতত অপ্রমত্তভাবে উদ্যোগ করেন, প্রবল আগ্রহের সহিত ত্রিবিধ শিক্ষার পূর্ণতা সাধন করেন এবং আচরণীয় শীল গ্রহণ করিয়া চরিত্র গঠন করেন তবে এই প্রকারে বুদ্ধের উত্তম ধর্ম অধিক হইতে অধিকতর দীর্ঘকাল বিদ্যমান থাকিবে। সুতরাং জগত অর্হৎশূন্য হইবে না। মহারাজ! ভগবান এই অভিপ্রায়েই বলিয়াছেনÍ‘সুভদ্র! এই ভিক্ষুগণ যদি ধর্মানুসারে ঠিক থাকে তাহা হইলে জগত কখনও অর্হৎশূন্য হইবে না।’
মহারাজ! কোন স্নিগ্ধ, সমান, সুমার্জিত, প্রভাযুক্ত ও নির্মল দর্পণকে যদি স্বচ্ছ ও সূক্ষ্ম গৈরিক চূর্ণদ্বারা উপর্যুপরি মার্জন করে তবে কি সেই দর্পণে মল, কর্দম ও ধুলিজাল উৎপন্ন হইবে?”
“না, ভন্তে! বরং নির্মল ও উজ্বলতর হইবে।”
“মহারাজ! সেই প্রকারেই বুদ্ধের উত্তম ধর্মই স্বয়ংই কলুষ-মল ও রজোজাল মুক্তহেতু স্বভাবতঃ নির্মল। যদি বুদ্ধপুত্রগণ আচার, শীল, গুণ, ব্রত, প্রতিপত্তি, কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন ও ধুতাঙ্গ গুণ দ্বারা বুদ্ধের সেই উত্তম ধর্ম সতত সম্মার্জন করে তবে এইরূপে উত্তম জিনশাসন দীর্ঘকাল বিদ্যমান থাকিবে। সুতরাং জগত আর কখনও অর্হৎশূন্য হইবে না। মহারাজ! এই অভিপ্রায়েই ভগবান বলিয়াছেনÍ‘সুভদ্র! এই ভিক্ষুগণ যদি ধর্মানুসারে ঠিক থাকে তাহা হইলে জগত কখনও অর্হৎশূন্য হইবে না।
মহারাজ! শাস্তার সদ্ধর্মের মূল হইল প্রতিপত্তি বা আচার-আচরণ। প্রতিপত্তিই ইহার কারণ, প্রতিপত্তি অন্তর্হিত না হইলে সদ্ধর্ম চিরকাল বর্তমান থাকে।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি যে বলিতেছেন সদ্ধর্মের অন্তর্ধান হয়, তাহা কি প্রকার?”
“মহারাজ! সদ্ধর্মের অন্তর্ধান তিন প্রকারে হইয়া থাকে। সেই তিন প্রকার কি? অধিগম অন্তর্ধান, প্রতিপত্তি অন্তর্ধান এবং লিঙ্গ অন্তর্ধান।
“মহারাজ! অধিগম অন্তর্হিত হইলে উত্তম প্রতিপত্তি পূরণকারীর ও প্রকৃত ধর্মাববোধ হয় না। প্রতিপত্তি অন্তর্হিত হইলে বুদ্ধের শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপ্তি অন্তর্হিত হয়, কেবল লিঙ্গ বা চিহ্নই অবশিষ্ট থাকে। লিঙ্গ অন্তর্হিত হইলে ধর্মের প্রবেণী বা পরস্পরা সম্পূর্ণরূপে উচ্ছিন্ন হয়। এই তিন প্রকারে যে কোন ধর্মেই অন্তর্ধান
হয়।”
“ভন্তে! আপনি উত্তমরূপে বুঝাইয়াছেন। গভীরকে সহজ করিয়াছেন। জটিলতা ছেদন করিয়াছেন। আপনার ন্যায় গণিবরবৃষভের সম্মুখে আসিয়া প্রতিপক্ষীয় মতবাদ নষ্ট, ভগ্ন ও নিষ্প্রভ হইয়াছে।”
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।