অবৌদ্ধ ধর্মমত


গবান বুদ্ধের কয়েকটি দেশনায় অবৌদ্ধ ধর্মমতের সাধন প্রক্রিয়ার অসারতাই দেখানো হইয়াছে। কয়েকজন পরিব্রাজক ভগবান বুদ্ধকে প্রশ্ন করেনজগৎ শাশ্বত, না অশাশ্বত? আত্মা শরীর এক, না পৃথক? নির্বাণের পর বুদ্ধের অস্তিত্ব থাকে কিনা? ত্যাদি। ভগবান বুদ্ধ প্রশ্নগুলির কোন উত্তর দেন নাপ্রশ্নগুলির অবাস্তবতাই অব্যাকৃতির কারণ। প্রশ্নকর্তারা যেন আকাশ-কুসুমের রঙ্ বুঝিতে চাহেন। জানিতে চাহেন, তাহাদের গন্ধ আছে কিনা। আত্মার অস্তিত্ব বা নাস্তিত্ব সম্বন্ধে বৌদ্ধমত হইতেছে যে, উহা একেবারে অবাস্তবআকাশকুসুমের ন্যায়। জগৎ বিকল্প মাত্র। উহার নিত্যতা বা অনিত্যতার প্রশ্ন উঠে না। সেইজন্য এই ধরণের প্রশ্নকে তিনিঅব্যাকৃতবলিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন। ভগবান বুদ্ধের মতে এই ধরণের প্রশ্নের সমাধানে প্রশ্নকর্তা মুক্তি পায় না। তাঁহার মেধাশক্তির অপব্যয় হয় মাত্র।

শুধু পরিব্রাজক নয়, বিভিন্ন ধর্মাচার্যগণও অনুরূপ প্রশ্নের অবতারণা করিতেন। তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন, অজিৎ কেশকম্বলী, প্রকুধকাত্যায়ন, পূর্ণকাশ্যপ, মস্করিন্ গোশালপুত্র, সঞ্জয় বৈরুপুত্র নির্গন্থ নাথপুত্র। ইহাদের মধ্যে প্রথম তিনজন ছিলেন, ঘোর জড়বাদী, চতুর্থ আচার্য ছিলেন নিয়তিবাদী। এই চার আচার্যের দার্শনিক মতাবলম্বীদের বুদ্ধদেব আখ্যা দিয়াছিলেনঅব্রহ্মচর্যাবাসীপঞ্চম আচার্য ছিলেন সঠিক জ্ঞানাভাববাদী এঁরই শিষ্য ছিলেন সারিপুত্র মৌদ্গল্যায়ন। ষষ্ঠ আচার্য হইতেছেন সুবিখ্যাত জৈনধর্ম প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর।

জৈনধর্মে শীলরক্ষা কর্মবাদ পুনর্জন্মবাদ গৃহীত হইয়াছে। সেইজন্য ভগবান বুদ্ধ এই ধর্মমতকে পৃথকভাবে আলোচনা করিয়াছেন। গৃহপতি উপালী অভয়রাজকুমার জৈনধর্মাবলম্বী ছিলেন। দেবদত্তও মনে হয় জৈনধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া বুদ্ধ বিদ্বেষী হইয়াছিলেন।

পূর্বোক্ত প্রথম পাঁচটি দার্শনিক মত সম্বন্ধে গৌতম বুদ্ধের বিশেষ আপত্তি ছিল। কারণ জৈনদর্শন ব্যতীত অন্যান্য মতবাদগুলিতে পাপ পুণ্যের স্থান নাই। ইঁহারা কর্মফলে পুনর্জন্মে বিশ্বাস করিতেন না। বৌদ্ধ, জৈন ব্রাহ্মণ্য ধর্মাদিতে কর্মফল পুনর্জন্মের অস্তিত্ব বহু প্রমাণাদির দ্বারা নিরুপিত হইয়াছে। প্রাণী হত্যায় পাপ নাই, দয়া দানে পুণ্য নাই আধ্যাত্মিক বাহ্যিকভাবে পরীক্ষা করিয়া এই ধারণাকে ভগবান বুদ্ধ অমূলক বলিয়া দেখাইয়াছেন।

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম

ব্রাহ্মণ্য দর্শনের প্রতিবাদ পালিশাস্ত্রে প্রায় বিরল। কেবল যাগযজ্ঞের নিরর্থকতা, যজ্ঞে পশুবলির নির্মমতা ও জাতিভেদে ব্রাহ্মণের প্রাধান্যের অযৌক্তিকতা পুনঃ পুনঃ উল্লিখিত হইয়াছে।

কোনো কোনো সূত্রে বেদের অপৌরুষেয়তার প্রতিবাদ আছে। ভগবান বুদ্ধ বলেন যে, ঋক্বেদের মন্ত্রগুলি কায়েকজন সু-ব্রাহ্মণ মহর্ষি দ্বারা রচিত। এই মহর্ষিরা কোনদিনই ঈশ্বরকে স্বচক্ষে সাক্ষাৎ করেন নাই এবং করিয়াছেন বলিয়াও কোন উক্তি নাই। সেইজন্য বেদ পুরুষকৃত, অপৌরুষেয় নয়।

জাতিভেদের অযৌক্তিকতা কয়েকটি সূত্রে আলোচিত হইয়াছে। ভগবান বুদ্ধ বলেন, সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণদের মধ্যে যদি কেহ শিক্ষা ও চর্চায় ব্যাপৃত থাকে ও শুচিভাবে জীবনযাপন করে, আর যদি কেহ প্রাণীহত্যা ও চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে তাহা হইলে এই দুই প্রকার ব্রাহ্মণদের কি এক পর্যায়ে স্থান দেওয়া উচিত?

তিনি আরও বলেন, যদি কেহ নিকৃষ্ট বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াও দয়াশীল ও শীলবান হয় ও পুণ্যকার্যে ব্যাপৃত থাকে তাহা হইলে তিনি দুঃশ্চরিত্র ও পাপকার্যে লিপ্ত ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও উচ্চস্থান অধিকার করিবে না, কে ইহার মধ্যে নির্বাণ বা মুক্তি লাভ করিবে? মানুষের জন্ম ও মৃত্যুতে কোন পার্থক্য নাই, তাহাদের পার্থক্য হয় কর্মেতে। সেইজন্য জাতিভেদে বিশ্বাস অযৌক্তিক।

অবৌদ্ধমত লইয়া সমস্ত আলোচনা মধ্যম নিকায় গ্রন্থে নিবদ্ধ হইয়াছে


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !