বৌদ্ধধর্ম ও সাধনার মার্গ

 

বৌদ্ধধর্ম ও সাধানার মার্গ

মধ্যম নিকায় গ্রন্থের প্রায় প্রত্যেক সূত্রে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাধনার নির্দেশ আছে। সাধনার আনু-পূর্বিক ধারাও কোন কোন সূত্রে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। তবে প্রত্যেক ভিক্ষুকে যে সেই একই ধারা অবলম্বন করিতে হইবে এইরূপ কোন বিধান নাই।

যে সমস্ত সাধনার নির্দেশ এই গ্রন্থে আছে তাহার মর্ম এইরূপ:

(১) ব্রহ্মচর্য পালন বা সাত্ত্বিকভাবে জীবনযাপন। পালিভাষায় বলে “সিক্খাসাজীবসমাপন্নো” অর্থাৎ শীলচর্চা ও দৈনিক জীবনযাপনে আত্মসংযম।

যে সমস্ত অকুশল কর্ম হইতে ভিক্ষুদের বিরত হইতে হইবে তাহা এই:

(ক) জীবহিংসা, অদত্তদ্রব্য গ্রহণ, অব্রহ্মচর্য, মিথ্যাবচন বা হিংসাসূচক অনর্থক বচনাদি, বীজ ও বৃক্ষের অনিষ্ট সাধন।

(খ) নৃত্যগীতবাদ্য-উপভোগ, মালা-গন্ধ-বিলেপন ব্যবহার, স্বর্ণরৌপ্য গ্রহণ, অরন্ধিত ধান্য ও মাংস গ্রহণ, স্ত্রী-পুরুষ-কুমারী-দাস-দাসী বা পর্শ্বাদি গ্রহণ।

(গ) দৌত্যকার্য, বাণিজ্য, বন্ধনাদি।

(ঘ) মধ্যাহ্নের পর আহার, চীবরাদি পছন্দ করা, ইত্যাদি।

মোটের উপর ভিক্ষুদের প্রয়োজনে অল্পাহার, যৎসামান্য চীবর, শয্যা, আসন ইত্যাদির ব্যবহার অর্থাৎ যাহাতে শরীর সুস্থ ও সবল থাকে। লোভ ও আকাঙ্খা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া বিহারে বাস ও চিত্ত স্থির করিবার প্রয়াস। বিহারে বাস করার নিয়মাদি পালন।

(২) ত্রয়োদশ ধুতাঙ্গ। যদিও ভগবান বুদ্ধ কৃচ্ছ্র সাধনার পক্ষপাতী ছিলেন না তবুও যে সমস্ত ভিক্ষুদের চিত্ত কৃচ্ছ্র সাধনার দিকে আকৃষ্ট হইত তাঁহাদের জন্য তের রকম কঠোর সাধনের ব্যবস্থা দিয়াছিলেন, যেমন সদাসর্বদা অরণ্যে বাস, ভিক্ষোপলব্ধ আহারই একমাত্র উপজীবিকা, শ্মশানে বাস, ছিন্ন ও ত্যক্ত বস্ত্রখ- হইতে চীবর ব্যবহার ইত্যাদি।

(৩) ইন্দ্রিয় সংযম। ইন্দ্রিয় সংযমের উপর ভগবান বুদ্ধ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। পঞ্চিন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধ বিষয়াদির প্রতি চিত্তকে নিরপেক্ষ রাখা। ইহাকে পালিভাষায় বলে “পঞ্চকামগুণা” হইতে বিরতি। জগতে সর্ববিষয় সম্বন্ধে নির্লিপ্ত ও নির্বিকার মনোভাব পোষণ করা এবং ঐ উদ্দেশ্যে সদাসর্বদা সচেতন থাকা। আহারাদির পর নির্জনে চিত্তস্থির করার প্রয়াস।

(৪) চৈতসিক ক্লেশ ও উপক্লেশাদি বর্জন। আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নির্বাণমার্গে অগ্রসর হইবার একমাত্র উপায় চিত্তের বিশুদ্ধতা, অর্থাৎ চিত্তের উপক্লেশাদিকে নির্মূল করা। উপক্লেশাদি অনেক প্রকার, তন্মধ্যে উল্লেখ্য অতি লোভ, হিংসা, অলসতা, ঔদ্ধত্য, সন্দিগ্ধতা, আত্মা বা জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস, ত্রিরত্নে শ্রদ্ধাভাব, ব্রত ও আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপের সার্থকতায় আস্থা স্থাপন, ইত্যাদি।

(৫) নির্বাণমার্গের উচ্চতর সাধনা। পূর্বোক্ত বিধানগুলি সাধারণভাবে সকল ভিক্ষুকে পালন করিতে হয়। তবে উচ্চস্তরে যে সমস্ত সাধনার ব্যবস্থা আছে তাহাদের মধ্যে বিশেষ সাধনপথকে সাধকেরা স্ব স্ব শরীর ও মনোভাব অনুযায়ী বাছিয়া লইতে পারেন। ভগবান বুদ্ধ তাঁহার শিষ্যদের মনোভাব পরীক্ষা করিয়া সাধনামার্গ নির্দেশ করিয়া দিতেন। কোন ভিক্ষুকে হয়ত শ্মশানে শব সাধনা করিতে দিতেন, আবার কাহাকেও বা মনোরম ফুলের বাগানে সুন্দর ফুল বা গন্ধকে ধ্যানের বিষয় করিতে বলিতেন।

কাহাকেও চতুর্থধ্যান বা অষ্টধ্যান বা চতুর্ব্রহ্মবিহার ইত্যাদি সাধনা করিতে বলিতেন। আবার কাহাকেও কেবলমাত্র শাস্ত্রাভ্যাসের জন্য নির্দেশ দিতেন এবং উহার দ্বারা তাহার চিত্তের স্থৈর্যের মার্গ দেখাইয়া দিতেন। সেইজন্য পালিশাস্ত্রে সাইত্রিশটি বোধিপক্ষীয় ধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সাইত্রিশটি ধর্মের যে কোনও একটি বা দুইটি সাধনার দ্বারা মোক্ষ লাভ হইতে পারে। এই ধর্মগুলির ব্যাখ্যা মধ্যম নিকায় গ্রন্থের অনেক সূত্রে আছে। ধর্মগুলির একটি তালিকা প্রদত্ত হলো:

(ক) চার প্রকার উদ্যম (প্রধান)। যেমন, চিত্তে অকুশল চিন্তা আসিতে না দেওয়া ইত্যাদি।

(খ) চার প্রকার অত্যুদ্যম (ঋদ্ধিপাদ)। যেমন, সমাধির জন্য ব্যগ্রতা, বীর্যপ্রয়োগ ইত্যাদি।

(গ) পাঁচ রকম চিত্তপ্রয়োগ (ইন্দ্রিয়)। যথা: শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি ইত্যাদি বৃদ্ধির জন্য মানসিক প্রযত্ন

(ঘ) পাঁচ রকম চিত্তশক্তি অর্জন। যেমন, শ্রদ্ধাশক্তি, স্মৃতিশক্তি ইত্যাদি।

(ঙ) সাত রকম বোধিজ্ঞান লাভের অঙ্গবিশেষ। যেমন, ধর্মবিশ্লেষণ, চিত্তের প্রীতি ও প্রশমতা, উপেক্ষা ইত্যাদি লাভ।

(চ) অষ্টপর্যায় মার্গ। যেমন, বৌদ্ধ দার্শনিক মত গ্রহণ (সম্যকদৃষ্টি), কায়িক ও বাচনিক সংযম ও চিত্তের স্থৈর্য।

(ছ) চার প্রকার স্মৃতিমান হওয়ার উপায়। কায়িক কর্মাদির প্রত্যবেক্ষণ, সুখ, দুঃখ, অদুঃখাসুখ ভাবাদির অনুধাবন, চৈতসিক ক্রিয়াদি ও সাধনার ক্রমোন্নতি লাভের দিকে দৃষ্টি।

(৬) ধ্যান ও সমাধি। বৌদ্ধ সাধনার মার্গে ধ্যান ও সমাধি ব্যতীত আধ্যাত্মিক উন্নতি হইতে পারে না। সেইজন্য সকল সাধককে প্রথম চারটি ধ্যানে সর্বাঙ্গীন পূর্ণতা লাভ করিতে হইবে। তারপর যাঁহারা সক্ষম হইবেন তাঁহারা আরও চারিটি সমাপত্তির সাধনা করিবেন। প্রথম চারটি ধ্যান চিত্তে উপেক্ষাভাবজনিত হয় ও দ্বিতীয় চারিটি সমাপত্তিতে জগতের জীব ও বস্তু সম্বন্ধে একপ্রকার ভাব জ্ঞান হয়।

(৭) স্মৃত্যুপস্থান। ভগবান বুদ্ধ কোন কোন সূত্রে বলিয়াছেন যে, একমাত্র স্মৃত্যুপস্থান ভাবনার দ্বারা মুক্তিলাভ হয়। চারপ্রকার স্মৃত্যুপস্থানের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে এবং গ্রন্থে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা আছে।

(৮) ব্রহ্মবিহার। বিশ্বের সর্বজীবের প্রতি মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষাচিত্ত হওয়ার জন্য ভগবান বুদ্ধ কোনো কোনো সাধকের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও দিয়াছেন। বিশেষত গৃহী বা বোধিসত্ত্বদের জন্য। এই চারিটি সাধনার মধ্যে “মুদিতা” সাধনা বিশেষ কঠিন। কারণ সাধকের মনোভাব এমনি করিতে হয় যে, সাধক তাহার নিজের ক্ষতি স্বীকার করিয়াও শত্রুর উন্নতি সাধনে প্রীতিলাভ করিবেন। এই গ্রন্থের মাঝে মাঝে দার্শনিক মতের আলোচনাও আছে। যেমন, মহারাহুলোবাদ সূত্রে ভগবান বুদ্ধ বলিয়াছেন যে, জীব চিত্ত ও চারি মহাভূতের সমষ্টি। এই চিত্ত বা মহাভূতের স্বকীয় সত্ত্বা নাই এবং উহাকে নিত্য আত্মা বলিয়া গ্রহণ করা ভূল। উহার অনিত্যতা ও অনাত্মতা উপলব্ধিতে সম্যক জ্ঞানলাভ হয় এবং তাহাতেই মুক্তি পাওয়া যায়।

দুই রকম সাধনার পথে ক্রমোন্নতির স্তর এই গ্রন্থে ভিক্ষুদের সাধনার পথে ক্রমোন্নতির স্তরগুলি সম্বন্ধে কয়েকটি উক্তি আছে। সাধারণতঃ চারিটি কিম্বা আটটি স্তরের কথা প্রচলিত আছে; যেমন, স্রোতাপত্তিমার্গস্থ ও ফলস্থ, সকৃদাগামীমার্গস্থ ও ফলস্থ, অনাগামীমার্গস্থ ও ফলস্থ এবং অর্হত্ত্বমার্গস্থ ও ফলস্থ। এই চার বা আট স্তরের মধ্যে অনেক অনুস্তর নির্ণীত হইয়াছে। যেমন কায়সাক্ষী, দৃষ্টিপ্রাপ্ত, শ্রদ্ধাবিমুক্তধর্মানুসারী, শ্রদ্ধানুসারী, উভতোভাগোবিমুক্ত (৮৫ পৃ.) প্রজ্ঞাবিমুক্তি (১১১ পৃ.) ইত্যাদি। অনুস্তরের বিবৃতি হইতে জানা যায় যে, সাধকদের কেহ শ্রদ্ধামার্গ এবং কেহ বা প্রজ্ঞামার্গ গ্রহণ করেন। এই দুই মার্গই নির্বাণপ্রাপ্তির পথ।

নির্বাণ

নির্বাণ যে কি তাহা ভগবান বুদ্ধ পরিষ্কার করিয়া বলেন নাই। তাহার কারণ নির্বাণের বিবৃতি দেওয়া যায় না; উহা কেবলমাত্র উপলব্ধির বিষয়। মহামালুঙ্ক্য সূত্রে বলা হইয়াছে যে, নির্বাণ শান্ত, শ্রেষ্ঠ তৃষ্ণাক্ষয়, সর্ব সংস্কারের সমতা। সর্ব জাগতিক বিষয় বর্জন ও তাহার বিরাগ ও নিরোধ। এক কথায় নির্বাণ অনির্বচনীয় পরমার্থ চিত্তবিমুক্তি ও পুনর্জন্ম নিঃশেষ।

মধ্যম নিকায় গ্রন্থের কয়েকটি সূত্রে ভগবান বুদ্ধের পূর্বজন্ম ও জীবনীর উল্লেখ আছে। আর কয়েকটি সূত্রে আছে তাঁহার কয়েকজন বিশিষ্ট শিষ্যের জীবনী যেমন, রাষ্ট্রপাল, অঙ্গুলিমাল। এই সঙ্গে অশ্বজিৎ, পুনর্বসু ও রাহুলের জন্য ধর্মদেশনা এবং রাজা প্রসেনজিৎ ও তাঁহার কর্মচারী পঞ্চকঙ্গ স্থপতির সহিত কথোপকথন বৌদ্ধ সাহিত্য ও ধর্মজীবনে ইহার মূল্য অপরিমেয়।

 

নলিনাক্ষ দত্ত

পালি বিভাগের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। 

আরো পড়ুন>>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !