জীব মাত্রই কর্মের অধীন
মানুষ
জগতের শ্রেষ্ঠ জীব। তথাগত বুদ্ধ একজন মহামানব ছিলেন। তিনি বুদ্ধধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারক।
বুদ্ধধর্মে কর্ম এবং ধর্ম একটি অপরটির সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত।
আভিধানিক
অর্থে কর্ম বলতে বুঝায়, কর্তা যে ক্রিয়া বা কাজ সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু বুদ্ধধর্মে
কর্ম শব্দটি বহুব্যাপক। কায়, বাক্য, মন দ্বারা সম্পাদিত হয় এ কর্ম। কোন জীবের মন
বা চিত্তই হচ্ছে কর্মের উৎপত্তিস্থল, সে সুকর্মই হোক আর দুষ্কর্মই হোক। মন বা চিত্ত
ব্যতিরেকে কোন কর্মের জন্ম হয় না। কর্ম প্রধানত দুই প্রকার। ১. কুশল কর্ম ২. অকুশল
কর্ম।
আর
ধর্ম হচ্ছে নীতি। চলার পথে প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্ম বা নীতি বিদ্যমান। প্রত্যেকে যে
যার কর্মের কাছে আবদ্ধ এবং স্বীয় ধর্ম মেনে চলতে চেষ্টা করে। নীতিবান বা শীলবান ব্যক্তিই
জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জীবের পুনর্জন্ম, বর্তমান জীবন, পরজন্ম এ তিনটি কর্মের দ্বারাই
যোগসূত্রে আবদ্ধ। কর্মই মানুষকে জন্ম থেকে জন্মান্তরে চক্রের মত ঘুরায়। আবার কর্মই
মানুষকে জন্ম নিরোধ করে অর্থাৎ দুঃখমুক্তি সাধন করায়। জীব তার নিজ নিজ কর্মের মূর্ত
প্রতীক। এ কর্মবাদ অনুসারে জীবকে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়।
তথাগত
সম্যক সম্বুদ্ধ বলেছেন, মনের চেতনাই কর্ম। মানুষের অন্তর যখন লোভ, দ্বেষ, মোহে আকৃষ্ট
হয় তখন তার মধ্যে হিংস্র মনোভাব জাগে। এ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। তাই আমাদের উচিত
কুশলকর্ম সম্পাদন করা। কুশলকর্ম হচ্ছে দান, শীল, ভাবনা, সেবা, পুণ্যদান, ধর্ম শ্রবণ
ইত্যাদি। অকুশল কর্ম হচ্ছে মিথ্যা বলা, প্রাণীহত্যা, চুরি করা, হিংসা করা ইত্যাদি।
যেহেতু মানব জীবন দুর্লভ সেহেতু কুশলকর্ম সম্পাদন করে এই দুর্লভ মনুষ্যজীবন সার্থক
করা উচিত।
বিশ্বজুড়ে
বৈষম্য ও প্রাণীর বিভিন্নতার একমাত্র কারণ হচ্ছে এ কর্ম। কর্মই জীবের বন্ধনের কারণ,
আবার এ কর্মই বন্ধনমুক্তি নির্বাণ এনে দিতে সক্ষম।
পৃথিবীতে
প্রাণীসত্ত্বগণ কেউ স্বল্পায়ু-দীর্ঘায়ু, স্বাস্থ্যবান-রুগ্ন, সুন্দর-কুৎসিত, অন্ধ,
বিকলাঙ্গ, ডাকাত, চোর, ধার্মিক, ধনী-দরিদ্র, ক্ষমতাশালী-ক্ষমতাহীন, মূর্খ-জ্ঞানী ইত্যাদি
বৈষম্য মানুষকে দীর্ঘকাল ভাবিয়ে তুলেছিল। মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধের আগে ও পরে কেউ কেউ
তাদের এ বৈষম্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ এ বৈষম্যের
একমাত্র কারণ হিসেবে এ কর্মকেই চিহ্নিত করেছেন।
জীবের
মধ্যে নানা ধরণের বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও বুদ্ধধর্ম পালনে মানুষে মানুষে, নরনারীতে কোন
ভেদাভেদ নেই। তাই বুদ্ধধর্মে স্থান পেয়েছিলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি
সকল স্তরের মানুষ। বুদ্ধযুগে রাজা থেকে প্রজা সকল স্তরের মানুষ বুদ্ধধর্মে প্রবেশ করে
এই কর্মের দ্বারাই সমমর্যাদা এবং সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন।
বুদ্ধধর্মে
নারীদের যথেষ্ট সম্মান দেয়া হয়েছে। তাইতো মহাপ্রজাপতি গৌতমী, ক্ষেমা, উৎপলবর্ণা,
পটাচারা, কৃশা গৌতমী ভিক্ষুণীসঙ্ঘে প্রবেশ করে সম্মান লাভ করেছিলেন। একসময় পার্বত্য
চট্টগ্রামে বুদ্ধধর্মের চর্চা ছিল না বললেই চলে। বিভিন্ন কুসংস্কারে অন্ধকারাচ্ছন্ন
ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ঠিক তখনই তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের অনুসারী শ্রদ্ধেয় বনভন্তের
আবির্ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ধর্মের আলোকে আলোকিত হতে শুরু করেছে। তিনি শুধু নিজের
জীবনকে আলোকিত করার জন্য আবির্ভূত হননি বরং দেশ তথা জাতির হিতসুখ মঙ্গলার্থে কাজ করে
যাচ্ছেন।
শ্রদ্ধেয়
ভন্তে প্রায়সময়ই ধর্মদেশনায় বলে থাকেন, “যে যিনিক্কে কর্ম গুরিবা, তে সিনিক্কে ফল
ভোগ গরিবা।“ অর্থাৎ যে যেমন কর্ম করবে তার ফলও সেরূপ হবে। কোন জীবই চিরস্থায়ী নয়।
সবাইকে একদিন মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হবে। মানুষের মৃত্যু হলে কোন ধন- সম্পত্তি, আত্মীয়-স্বজন
কেউ তার সাথে যাবে না, যাবে শুধু তার কৃতকর্ম। সে কুশলকর্ম হোক আর দুষ্কর্মই হোক। তাই
নিঃসন্দেহে বলা যায় আমরা প্রত্যেকেই কর্মের অধীন।
মূল
লেখক: জেনিয়া চাকমা, প্রাক্তন ছাত্রী, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।
সূত্র:
বুড্ডিস্ট উইকি
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।