বুদ্ধের দর্শনে মানবতা
যে দর্শন মানুষের চিত্তে মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ ঘটায়, মানবিকতাবোধের উন্মেষ করে, মানুষের মর্যাদার প্রতি আস্থাশীল হয়, মানুষের সুখ-শান্তি-কল্যাণ ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি-অগ্রগতির জন্য নিবেদিত থাকে তা-ই মানবতাবাদী দর্শন। মানবতার কল্যাণে যা কিছু প্রয়োজন তার চিন্তা এবং বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাই মানবতাবাদ। আর মানবতার সার্বিক কল্যাণ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির মধ্যেই নিহিত আছে বিশ্বশান্তি-বিশ্বকল্যাণ-বিশ্বমৈত্রী। জগতে এর চেয়ে বড় দর্শন আর কী হতে পারে?
মানবসভ্যতার
ইতিহাসে মানবতাবাদের ধারণাটি অনেক প্রাচীন। মানুষ যখন থেকে সভ্যজগতে প্রবেশ করা শুরু
করে, চিন্তা করতে আরম্ভ করে তখন থেকেই মানবতাবোধ মানুষের ভাবনায় স্থান করে নেয়। সামাজিক
জীব হিসেবে মানুষের প্রয়োজনেই মানুষকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে হয়।
বিশ্বসভ্যতার চিন্তাজগতের ইতিহাসে যত চিন্তক মানুষকে নিয়ে চিন্তা করেছেন, মানবতাকে নিয়ে ভেবেছেন, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধের মানবতাবাদ-চিন্তা অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত। বুদ্ধের মানবতাবাদ বিশ্বমানবতাকে প্রভাবিত করেছে সবচেয়ে বেশি। জগদ্ব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শন।
মানবতার হৃদয়ে এক স্থায়ী আসন করে নিয়েছে এই আলোকিত মহৎ চিন্তাধারা। মানবসভ্যতার ভাগ্যাকাশে বুদ্ধের মানবতাবাদ এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা যার দেদীপ্যমান জ্যোতিতে উদ্ভাসিত বিশ্বসভ্যতা ও মানব জাতি। বুদ্ধের আধুনিক, উদার, সর্বজনীন মানবতাবাদ বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী। কারণ এই মহান দর্শনে বিশ্বের তাবৎ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়।
এক স্বতন্ত্র অনন্যবৈশিষ্ট্যে ভাস্বর-শাশ্বত সর্বজনীন চেতনায় মহিমান্বিত-স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল এই অসাধারণ বিশ্বজনীন আদর্শ। সব ধরণের মানবিক বৈশিষ্ট্য ও নৈতিক গুণে বিশিষ্ট এ দর্শন। আমাদের ভাবনার জগতে খুব কম মতবাদ বা দর্শন বুদ্ধদর্শনের মতো সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। বুদ্ধের মানবতাবাদ-সাধনা এক অভূতপূর্ব অভাবনীয় জাগরণ সৃষ্টি করেছে সারা বিশ্বে। মানবতার মুক্তিই ছিল বুদ্ধের নিরন্তর সাধনা।
তাঁর এই মহাসাধনায় প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানবতার জয়গান।
মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সবসময় সচেষ্ট ছিলেন বুদ্ধ। মানুষের মুক্তির কথা বলেছেনসর্বাগ্রে। সত্যিই তাঁর কল্যাণমুখী দর্শন মানবতার মুক্তিসাধন ও মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠায়
নিবেদিত-এক কথায় নিবিড়ভাবে মানবজীবন ঘনিষ্ঠ।
বুদ্ধ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী। তাঁর ধর্ম-দর্শন মানুষের দুঃখ-লাঘবের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। এজন্য আমাদেরকেও সবসময় বুদ্ধ, তাঁর ধর্ম-দর্শন ও নীতি-আদর্শের আশ্রয় নিতে হয় জীবনচলার পথে। বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শন ও আদর্শ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক এবং মানবতার জন্য এক আলোকিত অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পক্ষে খুব কম মহৎপ্রাণ এমন জোরালো ভাষায় কথা বলেছেন এবং সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছেন। বুদ্ধধর্রম সাধারণ মানুষের ধর্ম। মানুষের মর্যাদার কথা এখানে সুস্পষ্ট। অলৌকিক শক্তির চেয়ে মানবিক শক্তির উপরই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এখানে। মানবশক্তিই মানবসমাজের প্রধান শক্তি। বুদ্ধধর্ম-দর্শনে আচার-অনুষ্ঠান বা প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতার স্থান গৌণ। মানুষের মুক্তিসাধনই এখানে মুখ্য।
সুতরাং এটি সুস্পষ্ট যে, বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের
মূল উপজীব্য মানবকল্যাণ। আবির্ভাব হতে মহাপরিনির্বাণ পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ডে
মানুষই প্রধান বিষয়। 'বুদ্ধত্ব লাভের পর তাঁর অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করেছেন মানুষের
মুক্তি ও মানবসমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য। বুদ্ধের মহত্ত্ব তাঁর চেতনায়, আদর্শে,
জীবনদর্শনে। তাইতো মহান বুদ্ধের উদার-মৈত্রীময় উচ্চারণ, 'একজন মা যেমন তাঁর সন্তানদের
কল্যাণের জন্য যে কোনো বিপদ বা ঝুঁকিকে মাথা পেতে নেন, তেমনি আমাদেরও উচিত বিশ্বের
সকল প্রাণীর জন্য আমাদের দয়া ও সহানুভূতি বিলিয়ে দেওয়া।' কত উদারনৈতিক ও সর্বজনীন
তাঁর বক্তব্য! শিষ্যদের উদ্দেশ্যে একবার বলেছিলেন, 'আমার বাণী মৈত্রী, কল্যাণ ও প্রেমের।
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস প্রাচীন গ্রিসের কল্যাণমূলক দর্শনের জন্য বেঁচেছিলেন এবং মৃত্যুকেও বরণ করেছিলেন। বুদ্ধের সাথে সক্রেটিসের যথেষ্ট মিল আছে। নীতিদর্শনের ক্ষেত্রে এ মিল অত্যন্ত বেশি। জ্ঞানজগতের দুই মহান দিকপালই মানুষের জীবনের সমস্যাগুলোর প্রতি নজর দিয়েছেন, এগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন এবং সমাধানের পথও অনুসন্ধান করেছেন। তবে বুদ্ধ এক্ষেত্রে বেশি প্রায়োগিক এবং অত্যন্ত বাস্তবসম্মত চিন্তা তাঁর।
বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণের যে সর্বজনীন চিন্তা বুদ্ধ করেছেন, তা সক্রেটিসের চিন্তার পরিধিকে ছাপিয়ে আরো বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। সক্রেটিসের চিন্তা ছিল মানুষকে আদর্শ নাগরিকে পরিণত করা যাদের দ্বারা একটি সমপ্রীতিপূর্ণ, সৌহার্দপূর্ণ, শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। বুদ্ধের চিন্তা ছিল মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করা।
পুরো বিশ্বের মানুষকেই ভাল ও আদর্শবান হতে হবে। তাহলেই একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাঁর এ চিন্তা নিঃসন্দেহে কালজয়ী-যুগান্তকারী। মানুষের কল্যাণ কামনার পাশাপাশি বুদ্ধ জগতের সকল প্রাণীর বা প্রাণসত্তার শান্তি এবং মঙ্গলের কথাও ভেবেছেন। সকল সত্তার শান্তি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি ছিল তাঁর ভাবনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সবসময় আর্তপীড়িত, নিঃস্ব, অসহায়, হতদরিদ্র মানুষের মুক্তির কথাও চিন্তা করেছেন। কারণ এদের মুক্তির মাধ্যমেই একটি সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব।
দার্শনিক অধ্যাপক
ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব বুদ্ধ সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, 'He underlined and
spotlighted the importance of universal friendship as a road to freedom and,
found in it the best and most potent prayer for salvation. He was a real and a
relentless helper of those who needed help..... Spiritual wisdom was to him the
infallible mark of greatness and most
potent prayer for salvation. He was a real and a relentless helper of those who
needed help..... Spiritual wisdom was to him the infallible mark of greatness
and distinction and he never cared to raise up those at the lowest rung of the
social ladder of his times, the so-called outcastes.' (Works of G.C. Dev;
Buddha the Humanist)
একজন আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিবাদী ও প্রাগ্রসর চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ বুদ্ধের বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ভাবনা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারবেন। ধর্মীয় গোঁড়ামী, ভেদনীতি, সামপ্রদায়িকতা কখনো বুদ্ধের ভাবাদর্শে স্থান পায়নি। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করেছেন-মানবতার বৃহত্তর ঐক্যসাধনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বুদ্ধধর্মে ভেদজ্ঞানের কোনো অবকাশ নেই। বুদ্ধদর্শনের
নীতি অনুসারে ধর্মকে সমাজে শান্তি, সমপ্রীতি ও সৌহার্দের সুদৃঢ় বন্ধন তৈরিতে প্রবল
ভূমিকা রাখতে হবে। মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা লাঘবের পক্ষে; শান্তি, সত্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠার
পক্ষে বৌদ্ধিক ভাবাদর্শের অবস্থান সবসময় জোরালো। বুদ্ধের সংগ্রাম শান্তি-সত্য-ন্যায়
প্রতিষ্ঠার জন্য। এজন্য বুদ্ধ নিজেকে মানবতাবাদী হিসেবে ঘোষণা করেছেন আর তাঁর প্রবর্তিত
ধর্ম-দর্শন আধুনিক মানবসমাজের জন্য একটি মহান অর্জন।
বুদ্ধের দর্শনে যুক্তিবাদ আর প্রয়োগবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুক্তিনির্ভর নয় এমন কোনো কিছুকে তিনি তাঁর চিন্তা বা আদর্শে স্থান দেননি, গ্রহণও করেননি। মানুষের জীবনসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বুদ্ধদর্শনের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নয় বা জীবনের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন বিষয় বৌদ্ধদর্শনে স্থান পায়নি।
কোনো অন্ধবিশ্বাস, ভ্রান্ত-অযৌক্তিক মতবাদও বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনকে স্পর্শ করতে পারেনি। যুক্তিবাদী চিন্তানায়ক হিসেবে মহান বুদ্ধ জীবনের জয়গান গেয়েছেন। সামগ্রিকভাবে মানবসভ্যতার বৃহত্তর কল্যাণ ও শান্তির জন্য আত্মনিবেদন করেছেন। মানবতাবাদী চিন্তার ইতিহাসে মহামানব গৌতম বুদ্ধের এই উদার সর্বজনীন ভাবাদর্শ এক মহাবিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। আজও বুদ্ধের এই যুগান্তকারী আদর্শ অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যবহ।
বিশ্বের যে কোনো সংকটময় মুহূর্তে আমাদেরকে বুদ্ধের এবং তাঁর মহান ধর্ম-দর্শনকে অনুসরণ করতে হয়। বুদ্ধের মহান শিক্ষা-দর্শন-আদৰ্শই পারে এই অশান্ত-অস্থির বিশ্বে শান্তি, সৌহার্দ্য, মৈত্রী, সমপ্রীতি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করতে। বুদ্ধের মতে, মানবজীবনে চিন্তা ও কর্মের সমন্বয় থাকা চাই। মানুষকে চিন্তা ও কর্ম উভয়েই সৎ হতে হবে। কাজে চিন্তার প্রতিফলন থাকা চাই। আর এর জন্য যুক্তির প্রাধান্য অত্যন্ত জরুরি। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বুদ্ধের এই বোধ এক অনন্য মহিমায় ভাস্বর।
বুদ্ধেরদর্শনে সর্বজনীন মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের অবস্থান সম্পর্কে অধ্যাপক জি.সি দেব মূল্যায়ন
করেছেন এভাবে- 'His faith in the dignity of man, in the efficacy of persistent
effort which kept him far off from the idea of sin often enough associated with
traditional religion marks him out as an existentialist of a distinct type. He
was an inveterate believer in the liberation of the common man, the masses and
his gospel is in a very real sense universal. As such his existentialism is not
individualist but universalist. He is indeed a happy blend of a logical
positivist with a practical bias and an existentialist with a unversalist
gospel committed to the liberation of the common man irrespective of sectional
affiliations. No better combination of ralationlism and humanism is conceivable
perhaps. Though it may sound curious, man's future lies today in a practically
inspired logical positivism blended with a universalism of an existentialist pattern.'
(Works of G.C. Dev; Buddha the Humanist)
বুদ্ধের
যুক্তির মহিমায় অভিভূত দার্শনিক ড. এস. রাধাকৃষ্ণন বলেন, 'বুদ্ধের কথোপকথন পড়ে তাঁর
যুক্তির মহিমায় আমরা অভিভূত হই। তাঁর আবিষ্কৃত নীতি পদ্ধতি হচ্ছে সঠিক ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন
দিক নির্দেশনা। তিনি মানবের মহাকল্যাণ পথে এবং অন্তিম গন্তব্যে যা কিছু বাধা বিপত্তি
রয়েছে, যেসব অপসারণের লক্ষ্যে এক কঠিন সংগ্রাম করেছিলেন।' (গৌতম দি বুদ্ধ)
মানবতাবাদের ধারণটি তখনই সার্থকতা লাভ করে যখন সমাজে বা রাষ্ট্রে একজন মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। মানুষের সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম ও সৎ আদর্শের সঠিক প্রকাশের মাধ্যমেই সমাজে মানবতাবাদ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম ও সৎ আদর্শের সমন্বয় হলেই সমাজে শান্তি, উন্নয়ন, প্রগতি, সমৃদ্ধি ও সমপ্রীতি নিশ্চিত হয়। আর এতে করেই সমাজে মানবতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি মানবতাবাদ। এটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ-গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের মূলসুর।
মানবতা ও সমাজের
অগ্রগতিতে মানুষের সৎ ইচ্ছা বা শুভ চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। এর প্রতিফলন সমাজে থাকা
চাই। কারণ সমাজের সাথে মানবতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একজন মানুষের চিন্তাশক্তি যখন
অবরুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার ইচ্ছাশক্তিও অবদমিত হয়। অপরদিকে, এ ইচ্ছাশক্তিই হচ্ছে
মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ-কারণে বুদ্ধদর্শনে ইচ্ছাশক্তি
বা ইচ্ছার স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বেশ গুরুত্বের সাথে এবং এখানে এর স্থান
অনন্য। গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে গুরুত্বের
সাথে বিবেচনা করা হয়।
বুদ্ধদর্শনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ব্যক্তির ভাগ্য তার নিজের মধ্যেই নিহিত। মানুষের নিজের কর্ম দ্বারাই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়, কোনো অলৌকিক বিষয়ের দ্বারা নয়। ব্যক্তি নিজেই তার আপনসত্তার নির্মাতা। মানুষ কর্ম, চিন্তা ও আদর্শ প্রকাশের মাধ্যমে তার মধ্যে অন্তর্নিহিত মানবীয় সত্তার বিকাশ করতে পারে।
সুতরাং নিজের ভাগ্যের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। পরিপূর্ণ মানবসত্তারূপে প্রতিভাত হওয়ার জন্য মানুষকে তার অন্তর্নিহিত প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধি এবং অর্জিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতাসমূহকে ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই মানবসত্তার সম্পূর্ণ বিকাশ সম্ভব। মানসবত্তার পরিপূর্ণ বিকাশসাধনই মানবতার মুক্তির পথ। এটিই বুদ্ধের মহান শিক্ষা। আর এ জন্য মানবসত্তার পূর্ণ বিকাশ ও মানবতার মুক্তির উপর জোর দিয়েছেন বুদ্ধ সবচেয়ে বেশি।
জগৎসভ্যতার ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল। মানবতাবাদের এ এক অনন্য উজ্জ্বল নিদর্শন। বুদ্ধের মতে, মানুষ নিজেই তার সুখ ও দুঃখভোগের জন্য দায়ী। এটি একান্তভাবে নির্ভর করে তার কর্মের উপর। মানবসমাজের প্রতি উদ্দেশ করে বুদ্ধের ঘোষণা-তিনি মানবতার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, কিন্তু কোনো মুক্তিদাতা নন। মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। মানবসত্তা বা মানবতার বিকাশ ঘটাতে হবে মানুষকেই। তবেই সে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হবে। ড. এডওয়ার্ড কোন্জ এর ভাষায়-'বুদ্ধ চিকিৎসক সদৃশ।
ঠিক একজন চিকিৎসক যেমনি বিভিন্ন রোগের কারণ নির্ণয় করে যথাযথ প্রতিষেধক প্রয়োগপূর্বক
রোগ প্রতিকারের ব্যবস্থা করে থাকেন অনুরূপ বুদ্ধও চিকিৎসকের ন্যায় চারি আর্যসত্য শিক্ষাদানের
মধ্য দিয়ে দুঃখ, দুঃখের উৎপত্তি, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায় এর ব্যবস্থা করে
থাকেন।' (বুড্ডিজম)
বুদ্ধ সকল প্রাণীর সুখ-শান্তি ও কল্যাণ কামনা করেছেন। সকল প্রাণীর প্রাণশক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলেছেন। তিনি মনে করেন, জগতের প্রত্যেক প্রাণীর একটি স্বকীয় সত্তা আছে-সকল প্রাণীর মধ্যে ‘বুদ্ধত্ব’ বা ‘বোধি’ লাভের ক্ষমতা আছে। জগতের কোনো প্রাণী অসুখ-দুঃখ-যন্ত্রণা চায় না। সকলেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-শান্তি চায়।
সুখ-শান্তি লাভের প্রত্যাশা সকল মানুষের মধ্যেও আছে। সবাই দুঃখ হতে মুক্তি চায়। বুদ্ধ মনে করেন, মানুষের সাথে মানুষের সমতা বা সাম্য বিধানের একটি সাধারণ উপায় হচ্ছে সবার জন্য সুখ-শান্তি কামনা করা। বুদ্ধ আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, একজন মানুষের সুখ-শান্তি অন্য একজন মানুষের সুখ-শান্তির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। এটি জাতি বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানুষের উপরই মানুষ নির্ভরশীল হয়, একইভাবে একটি দেশও অন্য একটি দেশের উপর নির্ভরশীল হতে পারে।
একজনের জীবন অন্য আরেকজনের জীবন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। আবার
ব্যক্তির প্রভাব সমাজ-দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের উপরও পড়তে পারে। যেহেতু সুখ ও শান্তি আমাদের
সকলের পরম আকাঙক্ষার বিষয় সেহেতু এগুলো প্রতিষ্ঠার কাজে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে
অবতীর্ণ হতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা,
সহনশীলতা, সততা, একতা। এ মানবীয় গুণাবলির যথার্থ চর্চা ও প্রয়োগের দ্বারাই আমরা প্রতিষ্ঠিত
করতে পারি নিজেকে, নিজের পরিবারকে, সমাজ-জাতি-রাষ্ট্রকে।
বুদ্ধধর্ম এমন এক ধর্মমত যা প্রতিষ্ঠার জন্য বা প্রবর্তনের জন্য কেনো রক্তপাতের প্রয়োজন হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি বলেন, 'Buddhism's most distinguishing feature is its altruistic ethics which teaches that everyone must do good in the interest of the whole world and make over to others' any merit he may acquire by his virtues.
'বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের সারকথাই হচ্ছে ত্যাগ। অপরের জন্য ত্যাগের মানসিকতা চাই। অপরের উন্নতি, শান্তি ও কল্যাণের জন্য আমাকে কাজ করতে হবে। কারণ অপরের উন্নতি-শান্তি-কল্যাণের মধ্যে আমার উন্নতি-শান্তি-কল্যাণ নিহিত। অপরের উপকার সাধনে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই নিজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি হবে। অপরকে আমার একান্ত অখণ্ড সত্তা বা আপন সত্তা বলে বিবেচনা করতে হবে। গভীরভাবে চিন্তা করলে অনুধাবন করা যায়, আমি বা আমার নিজ সত্তা এবং অপরের সত্তার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। কারণ আমি বা আমার সত্তা যে উপাদান দ্বারা গঠিত অপরের সত্তাও সেই একই উপাদান দ্বারা গঠিত।
যদিও বাহ্যিক
দৃষ্টিকোণে কিছু পার্থক্য আছে, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে আমরা এক ও অভিন্ন সত্তা। আমাদের
মধ্যে আছে এক নিবিড় অবিচ্ছেদ্য মানবিক সম্পর্ক। অপরের উন্নতিতে আমার উন্নতি, অপরের
কল্যাণে আমার কল্যাণ, অপরের শান্তিতে আমার শান্তি-এ মনোবৃত্তিকে জাগ্রত করতে হবে সবার
হৃদয়ে। আর এটি বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শন। আজকের অশান্ত-অস্থির-স্বার্থপর পৃথিবীতে
শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহান বুদ্ধের এই শাশ্বত মানবদর্শন অতি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শনে মানুষের জীবনের আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মানুষের, সমাজের, বিশ্বের ভাগ্য কোনো অলৌকিক সত্তার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
যে মানবীয় শক্তি মানুষের আছে সেটিই তার পরম সম্পদ। যখনই মানুষ তার মানবীয় শক্তিকে ইতিবাচক কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করেছে তখনই বিশ্বসভ্যতা তথা বিশ্বমানবতার অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। মানুষের মানবীয় গুণ ও শক্তির সদ্ব্যবহারের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন বুদ্ধ। এর মাধ্যমেই মানবসমাজের মধ্যে জাগরুক থাকতে পারে মনুষ্যত্ববোধ। কবি চণ্ডীদাসের উক্তি বুদ্ধের দর্শনের সাথে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ।
চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই।'
মানুষের মানবিক ক্ষমতার কথাই উচ্চারিত হয়েছে এখানে যা বুদ্ধের দর্শনেরও কথা। বিদ্রোহী
কবি নজরুলের দৃঢ় উচ্চারণ, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছুই নাই/নহে কিছু
মহীয়ান।' মানবশক্তি তথা মানবতার জয়গানই ধ্বনিত হয়েছে নজরুলের কণ্ঠে। সুতরাং অভীষ্ঠ
লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে মানবীয় গুণ ও মানবিক শক্তির সদ্ব্যবহার করা চাই।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক বুদ্ধ কোনো দেবতা বা ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ নন। বুদ্ধ একজন মানুষ। তাঁর চিন্তা-চেতনা-ধর্ম-আদর্শ-দর্শন সবকিছুই আবর্তিত হয়েছে মানুষকে কেন্দ্র করে। বুদ্ধের প্রবর্তিত ও প্রচারিত ধর্ম শুধু ধর্ম নয়-জীবনদর্শনও বটে। এ জীবনদর্শন সর্বজনীন, সর্বমানবের জন্য। মানবতাবোধ বা মনুষ্যচেতনাই মানবজাতির প্রধান সম্পদ বলে বিবেচনা করেছেন বুদ্ধ। বিশ্বকে জয় করতে হবে মানবতা দিয়ে। তাই বুদ্ধের দর্শনে মানবতার জয়গাথাই গীত হয়েছে।
মানবতার মুক্তি, কল্যাণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাই মানবতার বড়ো সেবা। এ অনেক বিশাল ত্যাগ। এ সর্বজনীন উদার চিন্তা বুদ্ধের দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মানুষের ভাবনায় থাকতে হবে শুধু শারীরিক উন্নতি নয়, মানসিক উন্নতি এবং আত্মিক উৎকর্ষও। বিশ্বের আর কোনো চিন্তকের কণ্ঠ মানবতার পক্ষে এত জোরালোভাবে ধ্বনিত হয়েছে বলে মনে হয় না।
মানুষের মর্যাদা নিয়েই বুদ্ধ চিন্তাশীল ছিলেন বেশি। জনৈক মুসলিম দার্শনিক বলেছেন, 'বুদ্ধ কেবল বৌদ্ধদের সম্পদ নহে বরং তিনি সমগ্র মানবজাতির সম্পদ। তাঁর শিক্ষা সর্বসাধারণের জন্য। বুদ্ধের পর যে সকল ধর্মের অভ্যুদয় ঘটেছে তা বুদ্ধের কাছ থেকে অনেক ভাল ভাল জ্ঞান ধার করেছে।' ‘Man is the principal criterion of measuring everything - G আপ্তবাক্য বুদ্ধের দর্শনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ আন্দোলন, সংস্কার আন্দোলন, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলায়ও আমরা বুদ্ধের দর্শনের মানবতাবাদী চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাই। দার্শনিক হেগেল, মার্ক্স, মিল, হাইডেগার, কিয়েরকেগার্ড, নীট্শে, সার্ত প্রমুখ দার্শনিকগণের চিন্তায় বুদ্ধের দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। ইউরোপে যে যুক্তিবাদী, উদারতাবাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার বিকাশ ঘটেছিল তা বিগত তিন শতক ধরে এখনো অব্যাহত আছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূলমন্ত্র ছিল মানবতাবাদ। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আন্দোলন প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার মূলে ছিল মানবতার মুক্তি আর মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শনও একটি আন্দোলন যার মূলভিত্তি ও মূল লক্ষ্য মানবতার মুক্তি। কী অসাধারণ সাদৃশ্য দুয়ের মধ্যে!
রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও দর্শনে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের প্রবল প্রভাব আমরা দেখতে পাই। বুদ্ধের মানবতাবাদী চিন্তার সাথে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে, প্রবন্ধে বুদ্ধের সর্বজনীন উদার মানবতাবাদী চিন্তাধ্বনির অনুরণন ঘটেছে অনেক বার।
'সোনার তরী', 'বলাকা, 'ক্ষণিকা, ‘গীতিমাল্য, ‘বিসর্জন, 'চণ্ডালিকা, ‘ঘরে বাইরে' প্রভৃতি সাহিত্যকর্মে বুদ্ধের মানবতাবাদী চিন্তার প্রভাব দেখা যায়। বুদ্ধ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যথার্থ মূল্যায়ন, ‘যিনি সর্বভূতকে আপনরাই মতো দেখেন এবং আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন, তিনি প্রচ্ছন্ন থাকেন না। আপনাকে আপনাতেই যে বদ্ধ করে সে থাকে লুপ্ত; আপনাকে সকলের মধ্যে যে উপলব্ধি করে সেই হয় প্রকাশিত। মনুষ্যত্বের এই প্রকাশ ও প্রচ্ছন্নতার একটা মস্ত দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। বুদ্ধদেব মৈত্রীবুদ্ধিতে সকল মানুষকে এক করে দেখেছিলেন।'
(শিক্ষার মিলন প্রবন্ধ) একইভাবে লালন শাহ, স্বামী বিবেকানন্দ, মেকলে, এমারসন, হেনরি
ডেভিড থরো, টি এস এলিয়ট, নজরুল প্রমুখ দার্শনিক-কবি-সাহিত্যিকগণের চিন্তা ও কর্মে
আমরা দেখি বুদ্ধের মহান মানবতাবাদী দর্শনের প্রোজ্জ্বল আভা।
সকল অবিদ্যা-অন্ধকার-কুসংস্কার-গোঁড়ামী দূর করতে হলে মানবতার বিকাশ সাধন ও এর যথার্থ মূল্যায়নের বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক সব ধরনের তাৎপর্য রয়েছে মানবতাবাদী দর্শনের। সর্বক্ষেত্রে মানবতাবোধের বোধ্যয়ন বা জাগরণেই মানবসমাজের প্রধান সার্থকতা-মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা এবং মূল্যায়ন করাতেই মানবজীবনের বড় মাহাত্ম্য। মনুষ্যত্ববোধই মানুষের সবচেয়ে বড় চেতনা।
এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়। বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে মহান বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শনের আবেদন ও প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেন, 'বুদ্ধ সকল প্রকার প্রচলিত ধর্মমত ও অন্ধবিশ্বাস এর ঊর্ধ্বে এবং তাঁর শাশ্বত বাণী যুগপৎ মানবতাকে রোমাঞ্চিত করেছে।
সম্ভবত তাঁর শান্তির বাণী আর্তপীড়িত ও বিপন্ন মানবতার জন্য আজকের চেয়ে অতীতে কোনোকালে এমনটা প্রয়োজন হয়নি।' মানবতাবাদ চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েই মানবসমাজকে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে; সমাধান করতে হবে মানুষের সব সমস্যার। আর এটিই গণতান্ত্রিক দর্শন। বুদ্ধের মতে, মানুষের মানবসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারলেই সব সমস্যা, অজ্ঞতা, অন্ধকার দূর করা যাবে। মানুষের সব ধরনের শক্তিকে মানুষের কল্যাণে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে হবে; মানুষের কল্যাণে মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে; মানুষের মর্যাদা মানুষকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; মানবতাকে রক্ষায় মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে-এটি বুদ্ধের মহান শিক্ষা।
মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানবসত্তার, মানবশক্তির, মানবচিন্তার
ইতিবাচক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমেই সব ধরনের সাফল্য ও অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে। যে যে
ক্ষেত্রে মানবশক্তির ইতিবাচক সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি, সে সেক্ষেত্রে মানবতা
বিপর্যস্ত হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া দুটি বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলী বিচার করলে
এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে অপরিসীম ভাবনা ও মানবতার মুক্তির চিন্তা করেছেন বলে মহাকারুণিক বুদ্ধ তাঁর ধর্ম-দর্শনে পঞ্চশীল নীতি, চতুরার্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, ব্রহ্মবিহার (মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা) চৰ্চা, কর্মতত্ত্ব, দান-শীল-ভাবনা-প্রজ্ঞা অনুশীলন, অহিংসনীতি, সাম্যবাদ, প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি প্রভৃতি মানবজীবনের সাথে একান্তভাবে সম্পর্কিত বিষয় আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।
জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন বলেই বুদ্ধ শ্রেষ্ঠতম
দর্শন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে মানবজীবনঘনিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলো মানুষের জন্য
উপস্থাপন করেছেন। তাই বুদ্ধ আমাদের মহান শিক্ষক-জগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক-অদ্বিতীয় মনীষা।
মানুষের মুক্তির জন্য এ বিষয়গুলোর উপলব্ধি, চর্চা এবং বাস্তবজীবনে এর যথার্থ প্রয়োগ
অপরিহার্য। এ প্রত্যয়গুলোর তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য মানুষের জীবনে অত্যন্ত ব্যাপক। বুদ্ধের
অমূল্য ধর্ম-দর্শনের এক একটি প্রধান স্তম্ভ এ বিষয়গুলো আমাদের জীবন চলার নিত্য অবলম্বন।
তাই বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন মানবতা ও মানবসভ্যতার জন্য এক পরম সম্পদ।
কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা কোনো বিশেষ জাতির জন্য বুদ্ধধর্ম-দর্শন নয়, পুরো মানবজাতির জন্য নিবেদিত মহান বুদ্ধের পবিত্র ধর্ম-দর্শন, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু বা প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে মানবতাবাদ বা মনুষ্যত্বের সাধনা। বুদ্ধের এই অতুলনীয় অদ্বিতীয় কালজয়ী দর্শন সর্বজনীন, সর্বকালিক, সর্বদেশিক। বিশ্বমানবতার জন্য চিরন্তন উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শনের আলোয় আলোকিত মানবসভ্যতা, যার মহিমায় মহিমান্বিত পুরো মানবসমাজ, যার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত সারাবিশ্ব।
বিশ্বসভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে মানবতার জয়গান ততদিন
ধ্বনিত হবে। মানবজাতি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন মানবতাবাদের জয়ধ্বনি উচ্চারিত হবে,
ততদিন বুদ্ধের মহান ধর্ম-দর্শন মানুষকে উজ্জ্বল বাতিঘর হিসেবে আলোর পথ দেখাবে। মানবতার
শক্তি অজেয়, অক্ষয়, অবিনশ্বর। মানবতার জয় হোক। মানবতাবাদের জয়গাথা উচ্চারিত হোক
সর্বক্ষেত্রে। শাশ্বত চিরন্তন মানবতাবাদী চিন্তা প্রসারতা লাভ করুক সবার হৃদয়ে। সর্বক্ষেত্রে
মানবতাবোধের উদ্বোধন হোক। বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন সমুন্নত থাকুক সবার অন্তরে। বুদ্ধের শাসন
চিরস্থিতি লাভ করুক।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।