পাঠ পরিক্রমা (toc)
পটভূমিকা
পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ বুদ্ধধর্মের উৎসস্থল। আড়াই হাজার বছর পূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পবিত্র তীর্থভূমি এই ভারতবর্ষে মহামানব গৌতম বুদ্ধ আবির্ভূত হয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বকালের সর্বমানবের কল্যাণকর একটি বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবমুখী ধর্মমত প্রচার করে ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বে এক নব জাগরণের সূত্রপাত করেন। তাঁর উপদেশ ছিল স্বাভাবিক, সার্বজনীন ও একান্তভাবে বস্তুনিষ্ট। তাঁর শিক্ষা ও অনুশাসন বিচার বুদ্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধের বাণী ও শিক্ষার মধ্যে এমন সব উপাদান রয়েছে যা সর্বযুগে সকল অবস্থায় সমভাবে প্রযোজ্য। ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন চিন্তা করার অধিকার মানুষকে সর্বপ্রথম বুদ্ধই দিয়েছেন (করীম, রেজাউল: বুদ্ধের আদর্শ, জগজ্যোতি, বুদ্ধ পূর্ণিমা সংখ্যা, ১৯৯৫, পৃ. ৩৯)।
তিনি
কোনো মিথ্যা আশ্বাসের বাণী দিয়ে মানুষকে প্রলোভিত করেন নি, যা একান্ত সত্য ও যুক্তি
নির্ভর তাই প্রকাশ করেছেন অকপটে। বিচারহীন অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিল
সর্বদা সোচ্চার। তিনি বিচার- যুক্তিহীন কোনো উপদেশ যেমন দেননি, তেমনি যুক্তিহীন উপদেশ
গ্রহণ করতেও নিষেধ করেছেন।
বুদ্ধ,
যুক্তিহীন প্রচলিত প্রথা, জনশ্রুতি, গ্রন্থে লিপিবদ্ধ বাণী, মহাপুরুষের উপদেশ, এমনকি
স্বয়ং বুদ্ধ ভাষিত বাণী হলেও অন্ধভাবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন; দক্ষ স্বর্ণকার যেভাবে
কষ্টি পাথরে ঘর্ষণ করে স্বর্ণের বিশুদ্ধতা নিরূপণ করে তেমনিভাবে বিবেকরূপ কষ্টি পাথরে
বিচার করে তাঁর উপদেশ বাণীর যথার্থতা পরীক্ষান্তে গ্রহণযোগ্য বিবেচ্য হলেই গ্রহণ এবং
বর্জনীয় বিবেচ্য হলে বর্জন করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন (অঙ্গুত্তর নিকায়, ১ম খণ্ড,
প. ১৮৯; নিজের জ্ঞাত ও কথিত বিষয়ের উপর পূর্ণ আস্থা, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই
বুদ্ধের মুখে এমন দুঃসাহসিক বাণী উক্ত হয়েছিল; যা সর্বসাধারণকে আকর্ষণ করতে সক্ষম
হয়েছে।
বুদ্ধধর্মেরপ্রচার ও প্রসার
সিদ্ধার্থ
গৌতমের জন্ম নেপালের লুম্বিনী কাননে। তিনিই ছিলেন শাক্যরাজের ভাবী রাজা। কিন্তু রাজ্য
লিপ্সা কিংবা রাজৈশ্বর্য আর প্রচুর ভোগ বিলাস তাঁকে গৃহে বন্দি করে রাখতে পারেনি; তিনি
আর্তমানবতার ডাকে গৃহত্যাগ করলেন, ছ'বছর সাধনা করে বোধি বা সত্যজ্ঞানের সন্ধান পেলেন।
মানুষের কল্যাণে তাঁর আত্মোৎসর্গ ছিল অনন্য-সাধারণ।
অসাধারণ
জ্ঞান-গরিমার অধিকারী হয়েও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন সাধারণ মানুষের মত থাকতে। তিনি কখনো
অতি প্রাকৃত জন্মের বা অতি প্রাকৃত শক্তির অধিকারী বলে দাবী করেননি কিংবা অতি প্রাকৃত
শক্তি প্রমাণার্থে অলৌকিক ঘটনা দেখাননি। মার্গদাতা ও মোক্ষদাতার মধ্যে বুদ্ধ নির্দেশ
করেছেন একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য।
বুদ্ধ নিজেকে মার্গদাতা বলেই অভিহিত করেছেন (আম্বেদকর, ভীমরাও; বুদ্ধ ও তার ধর্মের ভবিষ্যৎ, জগজ্জ্যোতি, ১৯৯৫, পৃ. ২৪)। এ ছাড়া তিনি ছিলেন অসম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এসব কারণে সাধারণ মানুষ বুদ্ধ ও বুদ্ধধর্মের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়। ভারতে ও বহির্ভারতে বুদ্ধধর্ম বিস্তার লাভের কারণগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
বুদ্ধধর্মেসাম্য
বুদ্ধের
সময়কালে ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থায় অসমতা ছিল প্রকট। তথাকথিত নিচু বর্ণের লোকেরা সর্বদা
উচ্চ বর্ণ কর্তৃক নিপীড়িত ও নির্যাতিত হত। নিচু বর্ণের লোকদের কোনো অধিকার ছিল না
মন্দিরে প্রবেশ করার কিংবা নৈবেদ্য নিবেদন করার, নারীরাও ছিল ধর্মকর্মে বঞ্চিত। নিম্নবংশে
জন্মের কারণে নারী-পুরুষ কারো অধিকার ছিল না সন্ন্যাস গ্রহণের। এ ব্যাপারে একচেটিয়া
অধিকার ছিল উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে, ঈশ্বর হিসেবে
তিনি চাতুবর্ণতত্ত্বের স্রষ্টা এবং তিনি গুণ কর্মের ভিত্তিতে তৈরি করেছেন একে- এর মানে
এই যে প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা ও বৃত্তি তিনি নির্ধারণ করেছেন তাদের অন্তর্নিহিত
গুণের ভিত্তিতে (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫)। বুদ্ধ চাতুবর্ণ মতবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ
জানালেন, ‘জন্মের দ্বারা বৃষল কিংবা ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মের দ্বারাই বৃষল কিংবা ব্রাহ্মণ
হয় (সুত্ত নিপাত, বসল সুত্ত)।
বুদ্ধ
এই অন্যায় অসমতার বিরুদ্ধে প্রচার ও সংগ্রাম চালিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি এর মুলোৎপাটনের
জন্য বাস্তব পদক্ষেপও গ্রহণ করলেন। তিনি উচ্চ বর্ণের সঙ্গে নিচুবর্ণের লোক এবং স্ত্রী
জাতিকেও ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীসঙ্ঘে প্রবেশের অধিকার দিলেন। ধর্ম চর্চার সমাধিকার স্বীকৃত
হল বুদ্ধের ধর্মে। ব্রাহ্মণেতর আর নারী জাতিকে সমমর্যাদা দিয়ে বুদ্ধ মানব ইতিহাসে
এক বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ ঘটালেন।
ধর্ম
চর্চা, অনুশীলন ও সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য সকল বর্ণের মানুষের গুণগত মানকে ঊর্ধ্বে স্থান
দেওয়া হল। অস্পৃশ্য বলে কথিত নির্যাতিত ও দলিত সমাজ বুদ্ধধর্মে পেল মানবতার মর্যাদা।
মানবিক গুণে গুণান্বিত সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ অধিকার পেল বৌদ্ধ সঙ্ঘে প্রবেশের। রাজগৃহের
মালাকার সুমন, জেতবনের সেবাপরায়ণ দরিদ্র ব্রাহ্মণ রাধ, জল্লাদ তম্বদাঠিক, ব্যাধ কুকুটমিত্র,
নরঘাতক দস্যু অঙ্গুলিমাল, আলবীরাজের তাঁতী কন্যা, শ্রাবস্তীর জেলে আর্য, অবন্তী নগরের
যোনকোটি বর্ণের দস্যুদল, রাজবাড়ির নাপিত উপালি, রাজগণিকা আম্রপালী, রাজমহিষী মহাপ্রজাপতি,
বিম্বিসার-জায়া ক্ষেমাদেবী, চণ্ডাল কন্যা প্রকৃতি- এক কথায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ
বুদ্ধের সঙ্ঘে স্থান পেলেন (বিশ্বাস, অচিন্ত্য; জগজ্জ্যোতি, পৃ. ১১৩)। ধর্মে এরূপ সাধারণ
সমতাদান বুদ্ধধর্মেই প্রথম।
নৈতিকতা
বুদ্ধ
যাগ-যজ্ঞ-হোম প্রভৃতি বাহ্যিক আড়ম্বরের গুরুত্ব স্বীকার করেননি। তিনি প্রাধান্য দিলেন
নৈতিকতাকে, তাই বুদ্ধধর্মকে নৈতিকতার নামান্তর বলা চলে। ড. ভীমরাও আম্বেদকর বলেন, “বস্তুত বলা যেতে পারে যে বুদ্ধই বিশ্বে
প্রথম গুরু যিনি ধর্ম ও অনুষ্ঠান প্রতিপালনের সমীকরণের পুরনো ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত
করতে সমর্থ হয়েছিলেন” (Buddha and the future
of His religion; The Buddha Dharmankur Sabha, ed. by H. B. Chowdhury, 1992, P.90)|
আত্মোন্নতির
পক্ষে যাগ-যজ্ঞ কখনও সহায়ক হতে পারে না। বুদ্ধ নৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য শীল পালন
বা চরিত্র গঠনের উপর অত্যধিক জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে একমাত্র নৈতিক উন্নতি সাধনেই মানব
জীবনের সার্থকতা। শীল বা সুচরিত্র ব্যতীত মনুষ্যত্বের বিকাশ অসম্ভব। তাঁর মতে ভাল ও
মন্দ ভেদে কৃত কর্ম দ্বিবিধ এবং প্রাণিদের একমাত্র বন্ধু হচ্ছে কর্ম, স্ব স্ব কর্মের
ফল নিজেকেই ভোগ করতে হবে- ভালো কর্মের ভালো ফল, মন্দ কর্মের মন্দ ফল (কন্মসকোম্হি,
কম্মদাযাদো, কম্মযোনি, কন্মপটিসরণো, যং কম্মং করিস্সামি কল্যাণং বা পাপকং তস্র দাযাদো
ভবিস্সামি)। সুচরিত্র শীল অনুশীলন ব্যতীত ভাল কর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।
তাই
বুদ্ধ সর্বসাধারণের জন্য শীলানুশীলন অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছেন। হনন, অদত্ত গ্রহণ,
পরদার লঙ্ঘন, মিথ্যাকথন ও মাদকদ্রব্য সেবন হতে বিরত থেকে কায়-বাক্য-মন সুচরিত কর্ম
সম্পাদনেই নৈতিকতার বিকাশ,১ আর নৈতিকতার বিকাশই হচ্ছে মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানব জন্মের
সার্থকতা। এই নৈতিকতার বিধিসমূহ নীতিগতভাবে সর্ব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। সাম্য বা
সমতার সাথে স্বীকৃতি পেল মানুষের সামাজিক, মানসিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা।
বৌদ্ধ সঙ্ঘ
বুদ্ধের
সবচেয়ে বড় সফলতা বৌদ্ধ সঙ্ঘ গঠন। মানবসমাজের পক্ষে একে ঐতিহাসিক বিপ্লবাত্মক প্রক্রিয়া
বলে সনাক্ত করা উচিত (বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১০)। বোধিজ্ঞান লাভের পর বুদ্ধ সর্বপ্রথম
সঙ্ঘ গঠনে মনোনিবেশ করেছিলেন। কারণ, বুদ্ধের ধর্মের ধারক, বাহক ও সমপ্রচারক হলেন সঙ্ঘ।
বুদ্ধধর্মের রূপকার হলেন সঙ্ঘ।
বুদ্ধ
প্রথম বর্ষাবাসের পরই পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু (কোওঞঞ, অসজিত, ভদ্দিয়, বাপ্প, মহানাম) ও
যশ প্রভৃতি ষাটজন ভিক্ষুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “ভিক্ষুগণ, তোমরা দিকে দিকে যাও, বহুজনের
হিতের জন্য, বহজনের সুখের জন্য দেবতা ও মনুষ্যদের কল্যাণের জন্য। দুজন এক পথে যেও না।
তোমরা ধর্মপ্রচার কর-যার আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ। অর্থযুক্ত,
ব্যঞ্জনযুক্ত, সমগ্র পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রচার কর।”
বুদ্ধের
এই নিদের্শের মধ্যে ভিক্ষুসঙ্ঘের আদর্শ রূপায়ণ সম্ভব এবং এ জন্য ভিক্ষুসঙ্ঘই প্রতিনিধিত্ব
করবেন। ভিক্ষুসঙ্ঘ মানবের সঠিক ও নিরপেক্ষ পথ নির্দেশের সন্ধান দেবেন। তাই তিনি ভিক্ষুসঙ্ঘকে
স্বতন্ত্র বিনয়ের নিয়মে আবদ্ধ করেছেন। তাঁরা হবেন মুক্ত বিহঙ্গের মত। তাঁদের স্থায়ী
বাসস্থান কিংবা সম্পত্তিতে অধিকার থাকবে না। যেহেতু এগুলো আত্মোন্নতি ও জনপরিসেবার
বিরাট অন্তরায়। বলা যেতে পারে, সঙ্ঘ বুদ্ধধর্মের মূল ভিত্তি। ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার
জন্য বুদ্ধ কতিপয় বিধিবদ্ধ নিয়মের প্রবর্তন করেছিলেন।
নিয়ম
অনুযায়ী সাধারণের বৌদ্ধ সঙ্ঘে প্রবেশের পূর্বে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে হয় কোনো অভিজ্ঞ
ভিক্ষুর নিকট। প্রব্রজিত ব্যক্তি গুরুর নিকট প্রাতিমোক্ষ শীল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয়
শিক্ষা গ্রহণ করে যোগ্যতা অর্জন করলেই দশাধিক ভিক্ষুর উপস্থিতিতে ভিক্ষু ধর্মে দীক্ষা
গ্রহণ করতে পারবেন। তখন তাঁকে উপসম্পন্ন বলা হয় এবং তখন থেকে তিনি একজন সঙ্ঘের সদস্যরূপে
বিবেচ্য হবেন।
নব
উপসম্পন্নকে অবশ্যই আচার্য ও উপাধ্যায়ের নিকট ধর্ম বিনয় শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এই
সময়কাল হচ্ছে কমপক্ষে দশ বছর (মহাবর্গ, অনু. স্থবির, প্রজ্ঞানন্দ, কলিকাতা, ১৯৩৭,
পৃ. ৮৭)৩। এই শিক্ষার ফলে প্রতিটি ভিক্ষু ধর্ম-বিনয়ে পারঙ্গমতা লাভ করতেন। এ ছাড়া
তাঁদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহনশীলতা গড়ে ওঠত। ফলে সঙ্ঘ
এমন একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়েছিল যার মাধ্যমে সমগ্র ভারতবর্ষে বুদ্ধধর্ম প্রসার
ঘটেছিল।
প্রসঙ্গত
উল্লেখ্য যে, সঙ্ঘের সদস্য সংখ্যা প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মগধরাজ বিম্বিসার, রাজ চিকিৎসক
জীবক, কোসলরাজ প্রসেনজিৎ, শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিক, মিগারমাতা বিশাখা প্রমুখ সদ্ধর্মপ্রাণ
ব্যক্তিবর্গের অর্থানুকূল্যে ভিক্ষুসঙ্ঘের বসবাসের জন্য বহু বিশাল বিশাল সঙ্ঘারাম গড়ে
উঠেছিল যেখানে ভিক্ষুসঙ্ঘরা ধর্ম-বিনয়-দর্শন পঠন-পাঠন ও অনুশীলন করে সর্বসাধারণের
মধ্যে বুদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। এ ছাড়া সঙ্ঘের সদস্যগণই বহির্বিশ্বে বুদ্ধধর্ম প্রচার-প্রসারে
সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা
ভারতীয়
শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উৎস বৌদ্ধ বিহার বা সঙ্ঘারাম। বৌদ্ধ বিহার মাত্রই এক একটি আবাসিক
শিক্ষা কেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠেছিল। প্রথম পর্যায়ে এগুলো ছিল ভিক্ষু-শ্রামণদের ধর্ম-
বিনয় ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। ক্রমশ তাদের রূপ বদলাতে লাগল। পরিবর্তিত হল
শিক্ষা কেন্দ্রে। আরো পরবর্তীকালে এগুলো পরিবর্ধিত হয়ে বড় বড় বিদ্যা নিকেতনে পরিণত
হল। সে সব বিদ্যা নিকেতনে দেশ-বিদেশের বহু শিক্ষার্থী আসতে লাগলেন বিভিন্ন শাস্ত্রে
জ্ঞান আহরণের জন্য।
তাছাড়া,
বহু দূর-দূরান্ত হতে বহু জ্ঞানী-গুণী মহাপণ্ডিতগণ ধর্ম সম্বন্ধে সন্দেহ নিরসনের জন্য
সেখানে আগমন করতেন। ক্রমান্বয়ে বিদ্যা নিকেতনের পরিসর বৃদ্ধি পেতে লাগল। বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রামণ
ছাড়াও অন্যান্য সমপ্রদায়ের শিক্ষার্থীরাও এমন কি সাধারণ জ্ঞান পিপাসুরাও এই সকল শিক্ষা
নিকেতনে বিদ্যার্জনের সুযোগ পেতেন।
শিক্ষার
বিষয় আর ধর্ম-বিনয়ে সীমাবদ্ধ রইল না; কলা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র,
উপনিষদ, ব্যাকরণ, সাংখ্য, ন্যায়, বেদ, বেদান্ত, আয়ুর্বেদ, জ্যোতিষ ইত্যাদি নানা বিষয়ে
শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা হল। কালে কালে এসব শিক্ষা নিকেতন এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
রূপ পরিগ্রহ করে (বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুকুল চন্দ্ৰ, বৌদ্ধ সাহিত্য ও শিক্ষা-দীক্ষার
রূপরেখা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৮, পৃ. ৬৩-৬৪)।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বলেন, “এই ইউনিভার্সিটির প্রথম প্রতিরূপ
একদিন ভারতবর্ষেই দেখা দিয়েছিল। নালন্দা, বিক্রমশীলা, তক্ষশীলার বিদ্যায়তন কবে প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল তার নিশ্চিত কাল নির্ণয় এখনও হয়নি, কিন্তু ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, উরোপীয়
ইউনিভার্সিটির পূর্বেই তাদের আবির্ভাব (বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ, শিক্ষা, রবীন্দ্র রচনাবলী,
জন্ম শতবার্ষিক সং, একাদশ খণ্ড, পৃ. ৬৮১)।”
এ
সময়ে নালন্দা, তক্ষশীলা, বলভি, সোমপুরী, বিক্রমশীলা, জগদ্দল, ওদন্তপুরী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের
মধ্যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। কথিত আছে, এখানে
দশ সহস্ৰ শিক্ষার্থী প্রায় সহস্রাধিক অভিজ্ঞ বৌদ্ধ ভিক্ষু, অধ্যাপক কর্তৃক শিক্ষা
লাভ করতেন। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল আবাসিক। বিনা বেতনে শিক্ষার্থীরা থাকা-খাওয়ার
সুযোগ পেতেন। এদের ব্যয়ভার বহন করতেন রাজন্যবর্গ, বণিকবর্গ ও বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ।
তৎকালীন
সময়ে প্রচলিত গুরুগৃহে শিক্ষা গ্রহণ আর বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার
মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বৌদ্ধ সঙ্ঘে প্রবেশাধিকার
ছিল যেমন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তেমনি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগও ছিল সকলের জন্য অবারিত
(Altekar, A.S.; Education in Ancient India (5th Edition, 1957, P. 234) |
বৌদ্ধ
যুগেই সর্বপ্রথম শিক্ষা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে সার্বজনীন রূপলাভ করেছিল। এর
রূপকার ছিলো বৌদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘ। তাঁদের যশ ছিল বহু দূরব্যাপী, তাঁদের চরিত্র ছিল পুত-পবিত্র
ও অনিন্দনীয়। তাঁরা সদ্ধর্মের অনুশাসন পরম শ্রদ্ধাসহকারে পালন করতেন, সেই সম্মানকে
উজ্জ্বল করে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তাঁদের উপরে, তাঁরা চরিত্র দ্বারা, তপস্যা দ্বারা
তা রক্ষা করতেন। (রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮১) প্রত্যেক অধ্যাপকগণ স্ব স্ব
কর্ম ও চরিত্রে ছিলেন অতি সচেতন, তাই তাঁরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা
থেকে কখনও বঞ্চিত হননি।
সেখানকার
ধর্ম ও জীবনের আদর্শ সমগ্র ভারত ও ভারতের বাইরে উজ্জ্বল দীপবর্তিকায় প্রভাস্বর হয়ে
ওঠেছিল।
মোটকথা,
বুদ্ধধর্মের আয়ু প্রাণকেন্দ্র ভূমি এই বিহার-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরেই ছিল নির্ভরশীল।
যতদিন বিহার-সঙ্ঘারাম ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের আদর্শ অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছিল ততদিন
বুদ্ধধর্ম ছিল সজীব (জানা, রাধারমণ, পালি ভাষা – সাহিত্য বৌদ্ধদর্শন ও রবীন্দ্রনাথ,
১৯৮৫, পৃ. ১৭৪)। বলা প্রাসঙ্গিক যে, এই বিহার ও সঙ্ঘারাম কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা
ভারতবর্ষে ও বহির্ভারতে বুদ্ধধর্ম প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।-
মিশনারী কার্যাবলী
বুদ্ধ
স্বয়ং মিশনারী কার্যক্রমের উদ্গাতা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বুদ্ধ প্রথম বর্ষান্তে
ভিক্ষুসঙ্ঘকে দিকে দিকে মানব কল্যাণকর ধর্ম প্রকাশ ও প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তখন থেকে ভিক্ষুগণ প্রত্যেকে এক একজন মিশনের কাজ করেছেন।
পরবর্তীকালে
রাজন্যবর্গ ও বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ বুদ্ধধর্মের অনুসারী হলে তাঁদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়
বৌদ্ধ মিশনের কাজ দ্রুত সমপ্রসারিত হতে থাকে। একদিকে বুদ্ধের ব্যক্তিত্ব, ধর্ম মতের
সমতা ও উদারতা অন্যদিকে বৌদ্ধ সঙ্ঘের চারিত্রিক মাধুর্য ও বাস্তবমুখী ধর্ম প্রচার কৌশলতায়
মুগ্ধ হয়ে ভারতের সর্বস্তরের মানুষ বুদ্ধধর্মকে আলিঙ্গন করল, হাজার হাজার নারী-পুরুষ
সঙ্ঘে দীক্ষা নিলেন।
বুদ্ধধর্ম
বিশ্বে ব্যাপক প্রসার লাভ করে খ্রি. পূ. তৃতীয় শতকে মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে।
প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ, কাবুল, পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত অশোকের শাসন বিসতৃত
ছিল। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকার পর তিনি বুদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হন এবং বুদ্ধধর্মের প্রচার,
প্রসার ও সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত
হয় তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি। সঙ্গীতি শেষে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় মৌদ্গলিপুত্র তিষ্য
স্থবির গণপূরক ভিক্ষুসহ নিন্মক্তে ভিক্ষুগণের নেতৃত্বে নিচেলিখিত দেশে ধর্মদূত বা মিশন
প্রেরণ করেছিলেন:
মাধ্যন্তিক
স্থবির কাশ্মীর ও গান্ধার রাজ্যে, মহাদেব স্থবির মহীশূরে, রক্ষিত স্থবির বনবাসী অঞ্চলে,
ধর্মরক্ষিত স্থবির অপরান্ত দেশে, মহারক্ষিত স্থবির যবন রাজ্যে, মধ্যম স্থবির হিমবন্ত
প্রদেশে, সোন ও উত্তর স্থবির সুবর্ণ ভূমিতে (মায়ানমার), মহেন্দ্র, উত্তীয়, সম্বল
ও ভদ্রশাল স্থবির তাম্রপর্ণী (শ্রীলংকা) দ্বীপে।
এই
বৌদ্ধ মিশনগুলো সেই সব দেশে অতি সাফল্যের সাথে বুদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন (সাংকৃত্যায়ন,
রাহুল, ভারতে বুদ্ধধর্ম, জগজ্জ্যোতি, ১৯৯৫, পৃ. ১৭৪)। তখন থেকে বুদ্ধধর্ম বিশ্ব ধর্মে
রূপ পেল। কুষাণ যুগের শ্রেষ্ঠ রাজা কণিষ্কও বুদ্ধধর্ম প্রচারে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর
সময়েও মধ্য এশিয়া ও চীনদেশে ধর্ম প্রচারের জন্য বৌদ্ধ মিশন প্রেরিত হয়েছিল।
আজও সেই সব দেশে বুদ্ধধর্ম শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুশীলিত হচ্ছে। এ কাজ সম্ভব হয়েছিল রাজন্যবর্গ ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা আর সদ্ধর্মে নিবেদিত প্রাণ বৌদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘের ঐকান্তিক প্রয়াসে। এ দুইয়ের সমন্বয়ে বুদ্ধধর্মের বিজয় কেতন সমগ্র বিশ্বব্যাপী
বুদ্ধধর্মের শেষ পরিণতি
বুদ্ধধর্মের
বিকাশকাল বুদ্ধের আবির্ভাব সময় হতে খ্রিষ্টীয় দশম, একাদশ শতক পর্যন্ত। এই ষোল'শ শতকের
মধ্যে কোনো কোনো সময় বুদ্ধধর্ম আক্রান্ত হলেও বিকাশের গতিধারা একেবারে রুদ্ধ হয়ে
যায়নি।
দিব্যাবদান
নামক বৌদ্ধ গ্রন্থ হতে জানা যায় শুংগ বংশের প্রথম রাজা পুষ্যমিত্র বুদ্ধধর্মের উপর
ব্যাপক নির্যাতন করেন। তিনি বহু বৌদ্ধ বিহার ও স্তূপ ধ্বংস এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা
করেন। বিখ্যাত তিব্বতী ঐতিহাসিক তারনাথ, চৈনিক ও জাপানী ঐতিহাসিকবৃন্দ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ
হ্যাভেল এই মত সমর্থন করেন (বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুকুল চন্দ্ৰ; বুদ্ধ ও বুদ্ধধর্ম, ১৯৮৫,
পৃ. ১৬৯)।
গুপ্ত
যুগের শেষের দিকে দুর্ধর্ষ হুন জাতির আক্রমণে ভারতের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনে ঘোরতর
বিপর্যয় নেমে আসে। হুন নায়ক তোরমানের পুত্র মিহিরগুল কর্তৃক বুদ্ধধর্ম ভীষণভাবে আক্রান্ত
হয়। তিনি হাজার হাজার বৌদ্ধ হত্যা ও স্তূপ, চৈত্য, বিহার, মূর্তি ইত্যাদি ধ্বংস করেন।
তখন এত বৌদ্ধ নিহত হয় যে, তাতে শ্বেতী নদীর জল নাকি রঞ্জিত হয়ে ওঠে।
কহলন
প্রণীত রাজতরঙ্গিনী নামক কাশ্মীরের ইতিহাসেও এর সমর্থন মিলে। হিউয়েন সাঙ-এর ভ্রমণ
কাহিনীর বিবরণ মতে রাজা শশাঙ্কও বুদ্ধধর্মের উপর নিপীড়ন চালিয়েছেন। তিনি নিজ হাতে
বোধিবৃক্ষ কর্তন করেন ও অবশিষ্ট যা কিছু ছিল সবই পুড়িয়ে দেন (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭২-৭৩)।
মহামতি
অশোক, কণিষ্ক, হর্ষবর্ধন প্রভৃতি ভারতের পরাক্রমশালী সম্রাটদের এবং বাংলায় পাল রাজাদের
আনুকূল্যে বুদ্ধধর্মের অভ্যুদয় ও বিস্তার হয়েছিল। এঁদের পর বুদ্ধধর্ম আর কোন রাজানুগ্রহ
লাভ করেনি, বরং বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
যখনই
বৌদ্ধ বিদ্বেষী রাজারা ভারতের শাসনভার প্রাপ্ত হয়েছেন তখন গোড়া ব্রাহ্মণ সমাজ তাঁদের
সহায়তায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন। বুদ্ধকে দশম অবতারের
নবম অবতার রূপে স্বীকৃতি দিয়ে বুদ্ধধর্মের বহু দেব-দেবী ও আচার-অনুষ্ঠানকে আত্মসাৎ
করে নিপীড়িত বহু বৌদ্ধকে হিন্দু ধর্মের অন্ত্যজ হিসেবে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেছেন।
ভারতে
হর্ষবর্ধনের এবং বাংলায় পাল রাজাদের রাজত্বের পর বুদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে
আসতে লাগল। বৌদ্ধ এশিয়ার তীর্থভূমি ভারতবর্ষে বুদ্ধধর্ম যেই মাত্র উৎসাদিত হয়েছে,
সেই মুহূর্তেই ইসলাম মধ্য এশিয়ায় তার সুযোগ গ্রহণ করেছে। মধ্য এশিয়া মুসলমান হয়েছে,
সঙ্গে সঙ্গে জাতিভেদে শতধা বিছিন্ন ভারতবর্ষে প্রবেশের পথ ইসলামের উন্মুক্ত হয়েছে
(গোস্বামী, বনবিহারী; জগজ্জ্যোতি, ১৯৯৫, পৃ. ৪৮)।
ভারত
আক্রমণ করে মুসলমানরা বৌদ্ধদের প্রতি বিন্দুমাত্র দয়া করেনি, ওরা বড় বড় বিহার লুঠ
করে সেগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, ভিক্ষুদের সঙ্ঘারাম নষ্ট করে দিয়েছে, বৌদ্ধদের বাসের
স্থানটুকু পর্যন্ত ছিল না। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রঙিন কাপড় তাঁদের মৃত্যুর পরোয়ানা হয়ে
গিয়েছিল। এই কারণে ভারতের বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলোতে খুব তাড়াতাড়ি বৌদ্ধ ভিক্ষু শূন্য
হয়ে পড়েছিল (সংস্কৃত্যায়ন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪)।
এ
ছাড়া বুদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ হতে বিলোপের অন্যতম কারণ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে দলাদলি ও
নৈতিক স্খলন বলে অনেকে মনে করেন। অনেক অধর্মপরায়ণ ব্যক্তি লাভ-যশের প্রত্যাশায় সঙ্ঘে
প্রবেশ করে। এরা সঙ্ঘের পুষ্টি সাধন করার পরিবর্তে কন্টকস্বরূপ হয়েছিল। এ কারণেও বুদ্ধধর্মের
দ্রুত অবনতি ঘটে।
বুদ্ধধর্ম সম্প্রসারণে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
খ্রিষ্টপূর্ব
ষষ্ঠ শতকে বুদ্ধের কণ্ঠে বৈষম্যহীন মহামানবতার বাণী উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে খ্রিষ্টীয়
দশম শতকের শেষ অবধি প্রায় ষোল শতাব্দী ভারতবর্ষ একমাত্র বুদ্ধবাণীকে অনুকরণ করেই মহাভারতে
পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের এমনি পরিহাস যে আড়াই হাজার বছর ধরে জগতে দীপ্তিমান
রয়েছে প্রজ্ঞা, করুণা ও প্রেমে যে অলোক-শিখা, অজ্ঞানতার চক্রান্তে খ্রিষ্টীয় দশম
শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে একটানা প্রায় হাজার বছর ভারতের সমাজদেহ সে আলোকধারার
স্পর্শ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে বাধ্য হয়েছে (বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ.
১৭৩)।
বুদ্ধ
বাণীর অমৃত পরশের অভাবে বিগত হাজার বছর ধরে ভারতের গণ মানসে নেমে এসেছে শুধু অন্ধকার
ও সংকীর্ণতা, জন-জীবনে নেমে এসেছে শুধু দুঃখ আর দুর্ভাগ্য। এই সুদীর্ঘ হাজার বছরের
মধ্যে সাড়ে সাতশত বছর ভারতবর্ষ থেকেছে পর পদানত, হয়েছে হৃত সর্বস্ব (গোস্বামী, প্রাগুক্ত,
পৃ. ৪৬-৪৭)।
ভারতবাসীর
জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ভারতবর্ষ হতে বুদ্ধধর্ম তিরোহিত হলেও এটা এখন পৃথিবীর
প্রায় অর্ধেক মানুষের শরণ, তাই এটা এখন বিশ্ব ধর্ম। নতুন বিশ্বে, বিশেষত জাতিপুঞ্জ
সংগঠনে বিশ্বের শান্তি রক্ষায় এ পেয়েছে এক নতুন ভূমিকা (বিশ্বাস, অনিল; বৌদ্ধ চিন্তা
ব্যাপ্তি, জগজ্জ্যোতি, ১৯৯৫, পৃ. ৬৬)।
বিংশ
শতকের পৃথিবীর মানুষ চায় বুদ্ধের বৈষম্যহীন মহামানবতার অমিয় বাণী, মহাশান্তির অমৃতধারা।
তাই আজ বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে নতুন করে বুদ্ধ চর্চা। ভারতবর্ষের সেই অতীত ঐতিহ্য
ফিরিয়ে আনার জন্য বুদ্ধ চর্চা আজ অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। এজন্য অবশ্যই বাস্তবমুখী
কর্মসূচি গ্রহণ করে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। ড. ভীমরাও আম্বেদকর বুদ্ধধর্ম সমপ্রচারের
জন্য তিনটি প্রধান সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। যেমন : ১) বৌদ্ধ বাইবেল তৈরি
২) ভিক্ষুসঙ্ঘের গড়ন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তন এবং ৩) বিশ্ববৌদ্ধ মিশন স্থাপন
(Ambedkar, B.R.; Ibid, P. 94).
আমাদের
বিশ্বাস, বর্তমানে সমগ্র ভারতবর্ষে এবং যেসব দেশে বৌদ্ধ আছে সেসব দেশে অসংখ্য বৌদ্ধ
সংগঠন রয়েছে, এগুলো খণ্ডিত হওয়ায় বুদ্ধধর্ম সমপ্রচারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম
হচ্ছে না। এজন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করা। আমরা
ফেডারেশন গঠন ও ফেডারেশন আর সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে বুদ্ধধর্মের উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ প্রক্রিয়া
কিরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয় তার কয়েকটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি:
ফেডারেশন গঠন
বুদ্ধধর্মের
উন্নয়ন ও সমপ্রসারণে বর্তমান সংগঠনগুলো একই প্লাটফরমে সমবেত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি
গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ ফেডারেশন আন্তরিকভাবে কাজ করবে। সমগ্র
দেশব্যাপী উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধি
অনুশীলন করবে।
ফেডারেশন
হবে সংগঠনগুলোর সহায়ক এবং ঐক্যসূত্রে এনে কাজ করার নিয়ামক। এটা জাতীয় পর্যায়ে বুদ্ধধর্ম
প্রচার, সমপ্রসারণ ও সংরক্ষণের যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বৌদ্ধদের সামগ্রিক স্বার্থ
সংরক্ষণ ও সরকারি পর্যায়ে অভাব অভিযোগ ও দাবী দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ফেডারেশন সরকারের
সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে।
আন্তর্জাতিক
পর্যায়ে বিশেষ করে বৌদ্ধ দেশ ও বিশ্ব বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর সঙ্গেও ফেডারেশন যোগাযোগ রক্ষা
করবে। ফেডারেশন কাজের সুবিধার জন্য কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলভেদে জোনে ভাগ করে নিতে পারে।
এতে বুদ্ধধর্মের উন্নয়ন ও সমপ্রচারমূলক কর্মসূচির ক্ষেত্রে সংগঠনগুলোর অভিন্ন কর্মসূচির
গ্রহণ করলে বাস্তবায়নে অধিকতর সুবিধা হবে।
ফেডারেশন
জাতীয় পর্যায়ে প্রচারমূলক পত্রিকা বা সাময়িকী প্রকাশ করবে। এ ছাড়া ফেডারেশন ও সংগঠনগুলো
বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় বৌদ্ধ সম্মেলনের আয়োজন করে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার
করবে। মাঝে মধ্যে সেমিনার সিম্পুজিয়াম ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির উপর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা
করবে। ফেডারেশন সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগে নিম্নোক্ত কর্মসূচিসমূহ গ্রহণ করে বুদ্ধধর্মের
সমপ্রসারণের সহায়তা করবে।
১. ত্রিপিটকের সার-সংক্ষেপ ধর্মপদ তৈরি
বৌদ্ধ
সাহিত্য ভাণ্ডার বিশাল। এই বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার মন্থন করে বুদ্ধধর্মের সার উপলব্ধি
করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সাধারণের পক্ষে এটা এক প্রকার অসম্ভব। সর্বজন হৃদয়গ্রাহী
বুদ্ধের বাণীর সংক্ষিপ্তসার সংকলন, তার সঙ্গে বুদ্ধের ছোট্ট একটি জীবনী, বুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ
কথোপকথন, বৌদ্ধ ধর্মানুষ্ঠান, যেমন- জন্ম, দীক্ষা, বিবাহ, মৃত্যু এবং উৎসব পার্বণ ইত্যাদির
গুরুত্ব এবং বিবরণসহ একটি সহজবোধ্য ‘ধর্মপদ’ বা সদ্ধর্ম সংকলন গ্রন্থ সংকলন করতে হবে।
এটা
হবে অনেকটা খ্রিষ্টানদের বাইবেল কিংবা মুসলমানদের কোরানের মতো। এটা এমন একটা গ্রন্থ
হবে যেখানে বুদ্ধধর্মের মূল সারবস্তু সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপন করা হবে। বর্ণনাত্মক বা
নৈতিক ব্যাখ্যান হিসেবে পাঠ্য না হয়ে একে অবশ্যই হতে হবে যাদুমন্ত্র। এর রচনাশৈলী
হবে স্বচ্ছ, মর্মস্পর্শী আর জন্ম দেবে সম্মোহন শক্তির (Ambedkar, B.R.; Ibid, P.
95)|
এটার
ভাষাগত দিকটা সুষ্ঠুভাবে চিন্তা করতে হবে; যে ভাষায় রচিত হবে সেই ভাষা অবশ্যই হতে
হবে জীবন্ত। এ জাতীয় গ্রন্থ বিশ্ব বৌদ্ধ সংগঠনের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় সংকলন করা
যেতে পারে। অতঃপর দেশ ও অঞ্চলভেদে স্ব স্ব দেশ বা অঞ্চলের ভাষায় রূপান্তর করে প্রচার
করা যেতে পারে।
২.
বুদ্ধধর্ম গ্রন্থের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা বা নবায়ন
এখানে
নবায়ন বলতে বুদ্ধধর্ম গ্রন্থের আধুনিক বাস্তববাদী মানুষের গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞানসম্মত
ব্যাখ্যা বোঝাতে চাইছি। এতে যে সকল অবিশ্বাস্য ও অতি প্রাকৃতিক বিষয় যুক্ত হয়েছে
তার থেকে একে মুক্ত করতে হবে। ত্রিপিটকের মূল গ্রন্থগুলোর যুক্তি নির্ভর ও বিজ্ঞানসম্মত
ব্যাখ্যা দিয়ে জনসাধারণের আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। এই গ্রন্থসমূহ স্বল্পমূল্যে
সাধারণের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। এ ছাড়া গ্রন্থগুলো বিভিন্ন ভাষায় রূপান্তর করে সর্বসাধারণের
সহজলভ্য করতে হবে।
৩. ভিক্ষুসঙ্ঘের গড়ন
পূর্বেই
উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভিক্ষুসঙ্ঘ বুদ্ধধর্মের রূপকার, ধারক, বাহক ও প্রচারক। বুদ্ধ
সঙ্ঘ সৃষ্টি করেছিলেন ধর্মের রক্ষণ ও সমপ্রসারণের নিমিত্তে। সেই অতীত সঙ্ঘ তাই করেছিলেন
বলেই বিশ্বব্যাপী বুদ্ধধর্ম প্রসার লাভে সমর্থ হয়েছিল।
অতীতের
সেই সঙ্ঘ আর বর্তমানের সঙ্ঘের মধ্যে বহু পার্থক্য। তাঁরা সকলেই ছিলেন সুপণ্ডিত, ধর্ম,
দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে পারঙ্গম এবং তাঁরা জানতেন যে তাঁদের ধর্মমত
সমপ্রচারে সমাজসেবা জরুরী। আজকের ভিক্ষুসঙ্ঘকে সেই পুরনো আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে।
বর্তমানে সঙ্ঘ যেভাবে সংগঠিত তাতে প্রাকৃতজনের পরিসেবায় অপরাগ এবং তাই জনসাধারণকে
এর দিকে আকৃষ্ট করতে পারছেন না (Ibid, P. 96)|
অতীতের
অনুপাতে বর্তমান ভিক্ষুসঙ্ঘ অনেক কর্মবিমুখ ও অসল। ড. আম্বেদকর বর্তমান ভিক্ষুসঙ্ঘকে
নিষ্কর্মাদের এক বিশাল বাহিনী বলে অভিহিত করেছেন। বর্তমানের অধিকাংশ ভিক্ষু আত্মসেবা
আর পৌরহিত্য কর্মে ব্যাপৃত রয়েছেন। এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরী, অতীতের সেই আদর্শবান
ভিক্ষুসঙ্ঘের মত চরিত্রবান, শিক্ষিত, কর্মক্ষম, নিরলস ও পণ্ডিত ভিক্ষুসঙ্ঘ, তারাই পারেন
একমাত্র বুদ্ধধর্মের সমপ্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে।
ভিক্ষুসঙ্ঘকে
গঠন করার জন্য যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন তা হল- ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে নবীন
ভিক্ষু-শ্রামণকে ধর্ম-বিনয় শিক্ষা দেওয়া। বিনয়ে জ্ঞানের অভাবে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
সূচিত হয় না। আর ধর্ম-দর্শনে জ্ঞান না থাকলে ধর্ম সমপ্রচার করা অসম্ভব। সৎ চরিত্র
আর পাণ্ডিত্য- এ দুইয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি হবে নতুনত্বের, সহায়ক হবে সদ্ধর্ম সম্প্রসারণে।
৪.
বৌদ্ধ মিশন স্থাপন
বুদ্ধধর্ম
সমপ্রচারে মিশনের ভূমিকা অত্যধিক। বুদ্ধ প্রথম থেকেই বৌদ্ধ মিশন বা প্রচারকের বিষয়
চিন্তা করে বৌদ্ধঙ্ঘকে দিকে দিকে সদ্ধর্ম সমপ্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ মিশন
ব্যতীত ধর্মের প্রসার অসম্ভব।
অতীতকালে
মহামতি সম্রাট অশোক ও সম্রাট কণিষ্ক কর্তৃক ভারতবর্ষের ভিতরে ও বাইরে মিশন প্রেরণের
কথা পূর্বে এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের এখনও বহু বৌদ্ধ দেব-দেবী
হিন্দু দেব-দেবীরূপে পূজিত হয়ে আসছে এবং এখনো বহু অঞ্চলে বহু সমাজ রয়েছে যাঁরা বুদ্ধের
পূজা করেন অথচ তাঁরা বৃহত্তর হিন্দু সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। (শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ (৩য় খণ্ড), ১৯৮৪, পৃ. ৩৯৬-৯৭)। এ ছাড়া এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে
বহু বৌদ্ধ যথার্থ দিগ নির্দেশনার অভাবে অন্যান্য মিশনের প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে প্রতিনিয়ত
ধর্মান্তরিত হচ্ছে।
এসব
অঞ্চলে বৌদ্ধ মিশন প্রেরণ করা হলে বুদ্ধধর্মের পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। এখনো বহু প্রত্যন্ত
অঞ্চলে উপযুক্ত প্রচারের অভাবে বুদ্ধধর্ম ক্ষীণপ্রভ হয়ে মৃত্যুর দিন গুনছে, এসব অঞ্চলেও
মিশন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। মিশন অবশ্যই বুদ্ধধর্ম দর্শনের উপর অভিজ্ঞ ভিক্ষুসঙ্ঘ
ও গৃহীসঙ্ঘের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৫.
সঙ্ঘ কাউন্সিল গঠন
বৃহত্তর
ভারতবর্ষে এবং বিশ্বের বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশে রয়েছে অসংখ্য ভিক্ষু সংগঠন, যেগুলো স্ব
স্ব এলাকায় সীমাবদ্ধ, পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এ ছাড়া সংগঠনগুলোর মধ্যে আবার রয়েছে শাখা-
প্রশাখা, দল-উপদল ও মত পার্থক্য। দল-মত নির্বিশেষে সদ্ধর্মের বৃহত্তর কল্যাণে দেশের
সমস্ত সংগঠনগুলোকে এক প্লাটফরমে সমবেত হয়ে সঙ্ঘ কাউন্সিল গঠন করতে হবে।
সঙ্ঘ
কাউন্সিল ঐক্যবদ্ধ হয়ে বুদ্ধধর্ম সমপ্রচারে কাজ করবে। এ ছাড়া বিশ্ববৌদ্ধ সংগঠনগুলোর
সঙ্গেও সঙ্ঘ কাউন্সিল যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে। সঙ্ঘ কাউন্সিল গঠিত হলে দেশ ও বহির্দেশে
বুদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
৬. বিহার-কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন
বিহার-কেন্দ্রিক
শিক্ষা ব্যবস্থা অতীতকালেও ছিল, এখনো বিশ্বের বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশে রয়েছে। বুদ্ধধর্ম
প্রচার ও সংরক্ষণে এ ব্যবস্থা অতি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণত
ছোট ছোট শিশুদের স্থানীয় বিহারে ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা
করতে হবে। এর ফলে বাল্যকালে কোমলমনে যে ধর্মীয় ছাপ পড়বে তা চিরকাল তাদের মাঝে স্থায়ী
হয়ে থাকবে। স্বধর্মের প্রতি আনুগত্যবোধ বিরাজ করবে।
এ
ব্যবস্থায় প্রত্যেক বিহারে প্রতিদিন অথবা কমপক্ষে সপ্তাহে একদিন শিশুরা উপস্থিত হয়ে
ধর্ম বিনয় শিক্ষা করবে, উপাসনা করবে এবং ভিক্ষুর নিকট নৈতিক উপদেশ শ্রবণ করবে। এ ছাড়া
যেখানে সম্ভব আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থাও প্রচলন করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থায় ধর্মীয়
শিক্ষার সাথে সাথে শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরী শিক্ষা গ্রহণ করবে। এরূপ বিহার কেন্দ্রিক
শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে সদ্ধর্মের প্রতি শিশুদের শ্রদ্ধা স্থায়ী রূপ পাবে এবং সদ্ধর্মের
স্থিতি দীর্ঘায়িত হবে।
৭.
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ
বুদ্ধধর্ম
প্রচার ও প্রসারের জন্য ধর্মীয় পুস্তক ও মাসিক পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে
পারে। এজন্য ফেডারেশন বা সংগঠনের উদ্যোগে একটি জাতীয় প্রেস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ
প্রেস থেকে প্রকাশ করা হবে মূল ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ ও বুদ্ধধর্ম বিষয়ক পুস্তক। এ ছাড়া,
একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরী।
এ
পত্রিকায় থাকবে গবেষণামূলক বুদ্ধধর্মবিষয়ক প্রবন্ধ, বৌদ্ধ সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য
বিষয়ক নিবন্ধ এবং গল্প, উপাখ্যান ও কবিতা। এ পত্রিকা ও পুস্তকরাজি স্বল্পমূল্যে সাধারণের
মধ্যে বিতরণ করতে হবে।
ফলে
সাধারণ মানুষ পত্রিকা ও পুস্তকাদির মাধ্যমে বুদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হতে
পারবে। এটা নিঃসন্দেহ যে, প্রচার-প্রসারের জন্য পত্রিকা ও পুস্তকাদি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ
মাধ্যম। প্রতিটি বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে এরূপ ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। সংগঠনের নেতৃবৃন্দের
আন্তরিক প্রচেষ্টায় সমাজের উদার ও বিত্তবান ব্যক্তিদের সহায়তায় একটি জাতীয় প্রেস
প্রতিষ্ঠা করে প্রস্তাবিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা কঠিন নয় বলে আমাদের বিশ্বাস। অত্যন্ত
আনন্দের বিষয় যে, শ্রদ্ধেয় বনভন্তের পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্দেশনায় ইতিমধ্যে রাজবন বিহার
হতে অনুরূপ ধর্মীয় গ্রন্থাদি প্রকাশিত হচ্ছে।
৮.
আর্থিক তহবিল গঠন
প্রত্যেক
সংস্থার নিজস্ব তহবিল থাকবে। তহবিল গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এজন্য উদার সদ্ধর্মানুরাগী
বদান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করতে হবে। সংস্থার বিত্তবান
ব্যক্তিরাও অর্থ যোগান দিতে পারেন। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির
ভিত্তিতে বিশ্বের বৌদ্ধ দেশ ও বৌদ্ধ সংস্থা থেকে আর্থিক সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।
বৌদ্ধ দেশগুলো আন্তরিক হলে আর্থিক সমস্যা সমাধান হওয়া সম্ভব।
উপসংহার
একসময়
ধর্ম ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, ব্রাহ্মণের সন্তান নিৰ্গুণ হলেও ব্রাহ্মণ হবে
আর শূদ্রের সন্তান সদ্গুণ হলেও শূদ্র থাকবে। কালের পরিবর্তন হয়েছে, বিশ্বের বহু লোক
ধর্মের উত্তরাধিকার সম্পর্কে অভূতপূর্ব সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন। মানুষ এখন বৈজ্ঞানিক
দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ধর্মের বিচার করছেন (Ambedkar, B.R.; Ibid, P. 96 ) | যা গ্রহণযোগ্য
তা গ্রহণ ও যা বর্জনীয় তা বর্জন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। সময় এখন বুদ্ধধর্মের
অনুকূলে। সংগঠনগুলো যদি ঐক্যবদ্ধভাবে একটি প্লাটফরমে সমবেত হয়ে বাস্তবমুখী কর্মসূচি
গ্রহণ করে তাহলে বুদ্ধধর্ম সমপ্রচারের কাজ সহজতর হবে।
এজন্যে
যদি বৌদ্ধ দেশগুলোও সদিচ্ছা প্রকাশ বা সহায়তা করে তাহলে তড়িৎগতিতে বুদ্ধধর্মের সমপ্রসারণ
হবে। প্রত্যেক বৌদ্ধকে তার কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বুদ্ধধর্ম অনুশীলনের
সঙ্গে সঙ্গে সমপ্রচারের দায়িত্বও প্রত্যেকের রয়েছে; তাদের অবশ্যই আস্থাশীল হতে হবে
যে, বুদ্ধধর্ম সমপ্রসারণের অর্থ হল মানব জাতির পরিসেবা। আমরা আশাবাদী, সংগঠনগুলোর ঐকান্তিক
ইচ্ছা থাকলে বুদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসার ও সমপ্রসারণ সহজে সম্ভবপর হবে।
টীকা
- ১। যো পাণং অতিপাতেতি মুসাবাদঞ্চ ভাসতি
লোকে
অদিন্নং আদিযতি পরদারঞ্চ গচ্ছতি,
সুরা
মেরেয পানঞ্চ যো নরো অনুযুঞ্জতি
ইধবমেসো
লোকস্মিং মূলং খনতি অত্তনো।- ধম্মপদ: ২৪৬। ২৪৭
অত্থায
হিতায় সুখায দেবমনুস্সানং। মা একেন দ্বে অগমিত্থ। দেসথ
ভিক্খবে
ধম্মং আদি কল্যাণং মঙ্গে কল্যাণং পরিযোসানং কল্যাণং সাং
সব্যঞ্জনং
কেবল পরিপুণ্নং পরিসুদ্ধং ব্রহ্মচরিযং পকাসেথ।
- ৩। A special training was necessary to accustom one of these new ideas and habits, it was, therefore, ordained that the convent should live for the first ten years in absolute dependence upon his Upajjhaya or Acaryia. (Majumder, R.C.; Comparative Life in Ancient India, 1969, P. 282).
তথ্যসূত্র
- ১. মহাবর্গ, অনু, স্থবির, প্রজ্ঞানন্দ, কলিকাতা, ১৯৩৭।
- ২. অঙ্গুত্তর নিকায়, Pali Texts Society, London, 1885-1900.
- ৩. জগজ্জ্যোতি, বুদ্ধ পূর্ণিমা সংখ্যা, কলিকাতা, হেমেন্দু বিকাশ চৌধুরী সম্পাদিত, ১৯৯৫।
- ৪. রবীন্দ্র রচনাবলী (জন্ম শতবার্ষিক সংকলন), একাদশ খণ্ড, কলিকাতা।
- ৫. শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ, হরপ্রসাদশাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, ৩য় খণ্ড, কলিকাতা, ১৯৮৪।
- ৬. বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুকুল চন্দ্র, বৌদ্ধ সাহিত্য ও শিক্ষা-দীক্ষার রূপরেখা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৮।
- ৭. ঐ, বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম, কলিকাতা, ১৯৮৫।
- ৮. জানা, রাধারমণ, পালি ভাষা-সাহিত্য বৌদ্ধ দর্শন ও রবীন্দ্রনাথ, কলিকাতা, ১৯৮৫।
- ৯. Majumder, R.C.; Comparative life in Anciet India, 1969.
- ১০. Altaker, A.S.; Education in Ancient India (5th Edition), 1957. (alert-success)
মূল
লেখক: প্রফেসর দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া, অধ্যাপক, প্রাচ্য ভাষা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।