হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-৩৩) ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়: কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান


#খারাপ সাপ-১০৯

এই বইয়ের সর্বশেষ সাপের গল্পটি বৌদ্ধ জাতক কাহিনী থেকে নেওয়া। এতে দেখা যায় যে, যত্ন নেওয়া মানে সবসময় নম্র, ভদ্র ও ইতিবাচক হওয়া বুঝায় না।
কোন এক গ্রামের বাইরে জঙ্গলে একটি খারাপ সাপ বাস করত। সাপটি ছিল ক্রুর, হিংস্র ও নীচমনা। সে কেবল মজা করার জন্য লোকজনকে কামড়াতো। যখন এই খারাপ সাপটি বুড়ো হলো, সে ভাবতে লাগলো- মারা গেলে সাপগুলোর কী হয়? তার পুরো হিস হিসের জীবনে সে ধর্মকে তাচ্ছিল্যই করেছে। তার মতে ধর্ম হচ্ছে অর্থহীন প্রলাপ মাত্র। আর যেসব সাপ এই অর্থহীন প্রলাপের ফাঁদে পড়ে সহজ সরল হয়ে রয়েছে, তাদেরকে সে বোকা বলে উপহাস করেছে। কিন্তু এখন এই বুড়ো বয়সে এসে সে বেশ ধর্মকর্মে আগ্রহী হয়ে উঠলো।
তার গর্তের অদূরেই পাহাড়ের চূড়ায় বাস করত এক সাধু সাপ। সকল সাধু লোকজন পাহাড় পর্বতের চূড়ায় বাস করে। এমনকি সাধু সাপও। এটাই চিরাচরিত ঐতিহ্য। আপনি কখনো কোন সাধু লোক জলাভূমিতে বাস করে বলে শুনবেন না।
একদিন খারাপ সাপটা সাধু সাপের সাথে দেখা করবে বলে মনস্থির করল। সে গায়ে একটা রেইনকোট চাপাল, কালো সানগ্লাস পরল আর টুপি দিয়ে মাথা ঢাকল যাতে তার বন্ধুরা তাকে চিনতে না পারে। এরপরে সে পাহাড় বেয়ে বেয়ে সাধু সাপের বিহারে উঠে গেল। সে পৌঁছল একটা ধর্মদেশনার মাঝামাঝি সময়ে। সাধু সাপটা একটা পাথরের উপর বসে ধর্মদেশনা দিচ্ছিল আর শত শত সাপ তার দেশনা নিবিড় মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। খারাপ সাপটি সেই সমবেত সাপগুলোর একপ্রান্তে, দরজার কাছাকাছি গিয়ে দেশনা শুনতে শুরু করলো।
যতই সে দেশনা শুনল, ততই তা তার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো। যুক্তি থেকে বিশ্বাস স্থাপিত হলো, অনুপ্রেরণা এল আর শেষে সে পুরো ধর্মান্তরিত হলো। দেশনা শেষে সে সাধু সাপটার কাছে গেল। অশ্রুভরা চোখে সে তার জীবনের অনেক পাপকর্মের কথা স্বীকার করল আর প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে সে পুরোপুরি বদলে যাবে। সে সাধু সাপের সামনে শপথ নিল, আর কোন মানুষকে কামড়াবে না। সে দয়ালু হয়ে যাবে। সে হবে যত্নশীল। সে অন্য সাপদের শিক্ষা দেবে, কীভাবে ভালো হতে হয়। এমনকি যাবার সময় সে দানবাক্সে কিছু দানও করে গেল। (সেটা অবশ্যই যখন সবাই দেখছিল, তখন।)
যদিও সাপ সাপের সাথে কথা বলতে পারে, মানুষের কাছে তা হিস হিস ছাড়া আর কিছুই নয়। খারাপ সাপ, অথবা বলা যায় প্রাক্তন খারাপ সাপ মানুষদেরকে বলতে পারল না যে সে এখন শান্তিকামী। গ্রামবাসীরা এখনো তাকে এড়িয়ে চলে, যদিও তারা অবাক হয়ে ভাবেসাপের বুকে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যাজ কেন! এরপর একদিন এক গ্রামবাসী ওয়াকম্যানে গান শুনতে শুনতে বেখেয়ালে ঠিক খারাপ সাপের গা ঘেঁষে নাচতে নাচতে চলে গেল। অথচ খারাপ সাপটি তাকে কামড়ালো না। সেটি শুধু ধার্মিক একটা হাসি দিল।
তখন থেকে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারলো যে খারাপ সাপটি আর বিপদজনক নয়। সে যখন তার গর্তের বাইরে কুন্ডলাকার ধারণ করে গোল হয়ে ধ্যানে বসে থাকত, লোকজন নিশ্চিন্তে তার পাশ ঘেঁষে চলে যেত। এরপর গ্রামের কিছু দুষ্ট বালক তাকে উত্যক্ত করতে এল।
‘এই যে, বুকে ভর দিয়ে চলা শুকনো কাঠি!’ তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে বাক্যবাণ ছুঁড়ে দিল, ’তোমার দাঁত দেখাও দেখি, যদি থাকে। এই বড় পোকা, তুমি তো একটা কাপুরুষ, ননীর দলা! তোমার বংশে তুমি একটা কলঙ্ক!’
সে তাকে ‘বুকে ভর দিয়ে চলা শুকনো কাঠি ডাকাটা পছন্দ করলো না, যদিও কথাতে কিছুটা সত্যি আছে। ‘বড় পোকা বলাটাও তার পছন্দ হলো না। কিন্তু সে কীভাবে নিজেকে আত্মরক্ষা করবে? সে তো শপথ নিয়েছে কাউকে কামড়াবে না।
সাপটি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে দেখে বালকেরা আরো সাহসী হয়ে উঠলো আর পাথর এবং মাটির ঢেলা নিক্ষেপ করলো। একটা পাথর গায়ে লাগাতে পারলে তারা হেসে উঠতো। সাপটি জানত, সে বালকগুলোর যে কাউকে দ্রুত ছোবল দিয়ে শেষ করে দিতে পারে, এমনকি আপনি ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল কথাটা পড়ে শেষ করার আগেই। কিন্তু তার শপথ তাকে এমন করা থেকে বিরত রাখল। এতে করে বালকেরা আরো কাছে এসে এবার লাঠি দিয়ে তার পিঠে মারতে শুরু করলো। সাপটি সেই মারের ব্যথা সহ্য করল কিন্তু সে বুঝল যে এই বাস্তব জীবনে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে আপনাকে হীন ও ইতর হতে হবে। ধর্ম আসলেই কোন কাজের নয়। তাই সে গায়ের ব্যথা সহ্য করেও পাহাড় বেয়ে উপরে উঠল সেই ভুয়া সাপের সাথে দেখা করার জন্য আর তার শপথ থেকে মুক্তি লাভের জন্য।
সাধু সাপ তাকে সারা শরীরে ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় আসতে দেখল আর জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
‘এটা তোমার দোষ। খারাপ সাপ তিক্ত স্বরে অভিযোগ করল।
’সব আমার দোষ মানে? কী বলতে চাও তুমি?’ প্রতিবাদ করল সাধু সাপ।
’তুমি আমাকে না কামড়াতে বলেছিলে। এখন দেখ আমার কী অবস্থা! ধর্ম হয়তো এই বিহারে চলতে পারে, কিন্তু বাস্তব জগতে...’
সাধু সাপ তার কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘ওরে মুর্খ সাপ! ওরে হাঁদা সাপ! ওরে বোকা সাপ! এটা সত্যি যে আমি তোমাকে না কামড়াতে বলেছিলাম। কিন্তু আমি তো কখনোই হিস হিস করতে না করি নি, করেছি কি?’
জীবনে মাঝে মধ্যে দয়ার খাতিরে সাধু সন্তদেরও ‘হিস্ হিস্ করতে হয়। কিন্তু কারোরই কামড়ানোর প্রয়োজন নেই।
-----------------ষষ্ঠ অধ্যায় শেষ-----------------
                                                                                                                                 -------------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !