ষষ্ঠ অধ্যায়: কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান
#সাপ,
মেয়র এবং ভিক্ষু - ১০৭
আমি থাইল্যান্ডে ভিক্ষু হিসেবে আট বছরেরও
বেশি সময় কাটিয়েছি। বেশির ভাগ সময় আমি ছিলাম জঙ্গলের মধ্যে থাকা বিহারগুলোতে, যেখানে
বসবাস করতে হতো সাপদের মাঝে।
১৯৭৪ সালে আমি সেখানে প্রথম যাই। আমাকে
বলা হয়েছিল যে থাইল্যান্ডে একশ জাতের সাপ আছে। তাদের মধ্যে ৯৯টি প্রজাতি বিষধর- তাদের
কামড়ে আপনি সোজা মারা যাবেন। আর অন্য একটি সাপ কামড়ায় না, তবে পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে
মারে।
সেই সময়ে প্রায় প্রত্যেকদিন সাপ দেখতাম
আমি। একবার আমার কুটিরে ছয় ফুট লম্বা এক সাপের উপর পা দিয়েছিলাম। আমরা উভয়েই চমকে উঠে
লাফ দিয়েছিলাম, তবে সৌভাগ্যবশত দুজনে দুদিকে। এমনকি এক সকালে এক সাপের উপরে প্রস্রাব
করে দিয়েছিলাম, আমি ভেবেছিলাম ওটা একটা কাঠি। অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম আমি। (সম্ভবত
সাপটি ভেবেছিল, তাকে পবিত্র পানি ছিটিয়ে আশীর্বাদ করা হচ্ছে।) একবার এক অনুষ্ঠানে সূত্র
পাঠের সময় একটা সাপ আমাদের এক ভিক্ষুর পিঠ বেয়ে উঠতে লাগল। যখন এটি কাঁধের উপরে উঠে
গেল, কেবল তখন ভিক্ষুটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। সাপটিও তার দিকে ফিরে তাকাল। আমি সূত্র পাঠ
বন্ধ করে দেখলাম, কয়েকটা সেকেন্ড যেন ভিক্ষু ও সাপটা পরস্পর চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইল। এরপর
ভিক্ষুটি আস্তে করে তার চীবর ঝাঁকালো। সাপটি নিরবে নেমে গেল আর আমরা সূত্র পাঠ শুরু
করলাম আবার।
বনভিক্ষু হিসেবে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া
হয়েছিল যাতে আমরা সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী জাগিয়ে তুলি, বিশেষ করে সাপদের প্রতি। আমরা
তাদের ভালোমন্দ খেয়াল রাখতাম, যত্ন নিতাম। একারণেই সেই দিনগুলোতে কোন ভিক্ষুকেই সাপে
কামড়ায় নি।
থাইল্যান্ডে থাকার সময় আমি দুটো বিরাট
সাপ দেখেছিলাম। প্রথমটা ছিল কমপক্ষে সাত মিটার লম্বা একটা অজগর আর দেহটা ছিল আমার উরুর
মতো মোটা। এত বড় আকারের কোন কিছু দেখলে আপনি অবিশ্বাসে দাঁড়িয়ে যাবেন। কিন্তু এটা ছিল
সত্যি। আমি এটাকে আরো কয়েকবছর পরে আরেকবার দেখেছিলাম। বিহারের আরো অনেক ভিক্ষুই সেটাকে
দেখেছিল। আমাকে পরে জানানো হয়েছে যে এটি নাকি এখন মরে গেছে।
অন্য যে বড় সাপটি দেখেছিলাম, সেটা ছিল
শঙ্খচূড়। থাই গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গলে থাকাকালীন সময়ে যে তিনবার আমি অনুভব করেছিলাম যে,
আবহাওয়ায় যেন বিদ্যুৎ বয়ে যাচ্ছে, আমার ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে গেছে আর আমার ইন্দ্রিয়গুলো
তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছে, সেই সময়টা ছিল এমনই একটি সময়।
জঙ্গলের বুনো পথে মোড় ঘুরতেই চোখে পড়লো
একটা কালো সাপ দেড় মিটার চওড়া রাস্তাটা রোধ করে আছে। এর মাথা বা লেজ কোনটাই দেখা যাচ্ছিল
না, দুটোই ছিল ঝোপের আড়ালে। আর এটা সামনে এগোচ্ছিল। এর নড়াচড়া দেখে আমি সাপটার দৈর্ঘ্যকে
পথের প্রস্থ দিয়ে গুণলাম। সাত প্রস্থ গোণার পরে তবেই লেজের দেখা পেলাম। সাপটি ছিল লম্বায়
১০ মিটারেরও বেশি। আমি এটাকে দেখে গ্রামবাসীদের বললাম। তারা আমাকে বললো যে এটি ছিল
শঙ্খচূড়, বড় জাতের।
আজান চাহ্ এর এক থাই শিষ্য, যে এখন নিজ
গুণে বিখ্যাত এক আচার্য হয়ে উঠেছে, সে একবার অনেকজন ভিক্ষু সাথে নিয়ে থাইল্যান্ডের
জঙ্গলে ধ্যান করছিল। কোন প্রাণী আসার শব্দ শুনে তারা চোখ খুলতে বাধ্য হল। তারা দেখল
একটা শঙ্খচূড় সাপ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। থাইল্যান্ডের কোন কোন জায়গায় শঙ্খচূড়কে বলা
হয় ‘এক পদক্ষেপের সাপ’। কারণ এটা আপনাকে কামড়ানোর পরে আপনি
কোনমতে এক পদক্ষেপ এগোতে পারবেন, এরপরে মৃত্যু! শঙ্খচূড় সোজা সিনিয়র ভিক্ষুটার কাছে
এগিয়ে গেল, ভিক্ষুটার মাথার সমান করে তার মাথাটা উঁচু করল আর ফণা বের করে শব্দ করতে
লাগল, ‘হিস্ হিস্! হিস্ হিস্!’
আপনি তখন কী করতেন? দৌড় দেওয়াটা হতো সময়ের
অপচয় মাত্র। এই বড় সাপগুলো আপনার থেকে অনেক দ্রুত দৌড়াতে পারে।
থাই ভিক্ষুটা করলো কী, সে হাসলো, আস্তে
করে ডান হাতটা তুললো এবং শঙ্খচূড়ের মাথায় আলতো করে চাপড় দিয়ে থাই ভাষায় বললো, ‘আমাকে
দেখতে আসার জন্য ধন্যবাদ।’সমস্ত ভিক্ষুরা দেখলো ঘটনাটা।
এই ভিক্ষুটা ছিল বিশেষ এক ভিক্ষু যার
ছিল ব্যতিক্রমী মৈত্রীভাব। শঙ্খচূড় হিস হিস বন্ধ করল, ফণা গুটিয়ে নিল, মাথাটা মাটিতে
নামিয়ে কাছের আরেক ভিক্ষুর কাছে গেল, ‘হিস্ হিস্! হিস্ হিস্!’
দ্বিতীয় ভিক্ষুটি পরে বলেছিল যে কোনমতেই
সে শঙ্খচূড়ের মাথায় হাত বুলাতে যেত না। সে ভয়ে বরফের মতো জমে গিয়েছিল। নিরবে সে প্রার্থনা
করছিল যেন শঙ্খচূড়টা তাড়াতাড় চলে যায় আর অন্য কোন ভিক্ষুর সাথে দেখা করে।
শঙ্খচূড়ের মাথায় চাপড় দেওয়া সেই ভিক্ষুটি
অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের বিহারে কয়েকমাস ছিল। আমরা সেসময় আমাদের মূল দেশনালয় নির্মাণ করেছিলাম।
আরো কয়েকটা ভবন নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় স্থানীয় কাউন্সিল অফিসে জমা ছিল।
স্থানীয় কাউন্সিলের মেয়র এখানে এসেছিল আমরা কী করছি তা দেখতে।
মেয়র নিঃসন্দেহে জেলার সবচেয়ে প্রভাবশালী
ব্যক্তি। সে এই এলাকায় বড় হয়েছে আর সফল একজন কৃষক। সে আবার আমাদের প্রতিবেশিও। সে এসেছিল
সুন্দর একটা স্যুট পরে, যা মেয়রের পক্ষেই মানানসই। জ্যাকেটের বোতাম ছিল খোলা। ফলে বড়,
অস্ট্রেলিয়া মাপের বিশাল ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছিল। শার্টের বোতামগুলো খুব টানটান হয়ে গিয়েছিল
আর পেটটা তার সেরা প্যান্টের কিনারা ছাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। থাই ভিক্ষুটি এক ফোঁটা
ইংরেজি জানতো না। সে মেয়রটির ভুঁড়িটা দেখল। আমি তাকে থামানোর আগেই সে মেয়রের কাছে পৌঁছে
গেল আর ভুঁড়িটাকে চাপড় দিতে শুরু করল। ‘সেরেছে!’ আমি ভাবলাম, ‘আপনি মেয়রের ভুঁড়িটাকে
এভাবে চাপড়াতে পারেন না। আমাদের ভবনের প্রকল্পগুলো আর অনুমোদন পাবে না। আমরা শেষ! আমাদের
বিহার নির্মাণের এখানেই ইতি!’
সেই থাই ভিক্ষুটি মৃদু হাসি নিয়ে যতই
মেয়রের ভুঁড়িটিকে চাপড়ালো আর হাত বুলিয়ে দিল, ততই মেয়র হাসতে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডের
মধ্যে এমন রাশভারি মেয়র শিশুর মতো খিলখিল করে হাসতে লাগল। সে সত্যিই এই অসাধারণ থাই
ভিক্ষুর ভুঁড়ি চাপড়ানো ও হাত বুলানোর প্রত্যেকটি মুহুর্তকে উপভোগ করেছিল।
আমাদের সবগুলো ভবনের প্লান অনুমোদন হয়ে
গেল। মেয়র আমাদের সেরা বন্ধু ও সহায়তাকারীদের একজন হয়ে উঠলো।
যত্ন নেওয়ার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশটা হলো,
এর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা কোত্থেকে আসছে তা দেখা। সেই থাই ভিক্ষুটার প্রতিটি কাজের উৎস
ছিল এমন বিশুদ্ধ হৃদয় যে, সে শঙ্খচূড়ের মাথায় চাপড় দিতে পারে, মেয়রের ভুঁড়িতে হাত বুলাতে
পারে, আর সবচেয়ে বড় কথা, তারা দুজনেই এটা পছন্দ করেছিল। আমি আপনাকে এমন কিছু করতে যাওয়ার
পরামর্শ দেব না, অন্ততপক্ষে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি একজন সাধুসন্তের ন্যায় যত্ন নিতে না
পারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত।
-------------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।