দ্বিতীয় অধ্যায়: ভালোবাসা ও অঙ্গীকার
#কৃতজ্ঞতা
২৭
কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের
পরে কনের বাবা নতুন জামাইকে একপাশে ডেকে নিল, বিয়েকে দীর্ঘস্থায়ী ও সুখময় করা যায় কীভাবে,
সে বিষয়ে কিছু উপদেশ দেওয়ার জন্য। সে যুবকটিকে বললো, ‘তুমি সম্ভবত আমার মেয়েকে অনেক
ভালোবাসো।’
‘ও হ্যাঁ, তা তো বটেই!’ যুবকটি গভীর আবেগে
বলে উঠলো।
‘আর তুমি সম্ভবত মনে করো যে সে এই পৃথিবীর
সবচেয়ে চমৎকার এক মেয়ে।’বুড়ো বলে চললো।
‘যখন তুমি বিয়ে করো, তখন এমনই লাগে।’
বুড়ো বলল, ‘কিন্তু কয়েক বছর পরে তুমি আমার কন্যার দোষ ত্রুটিগুলো দেখতে শুরু করবে।
আমি চাই, যখন তুমি তার দোষ ত্রুটিগুলো দেখতে শুরু করবে, তখন যেন এই কথাগুলো স্মরণ কর।
গোড়া থেকে যদি তার ঐ দোষগুলো না থাকত, তাহলে হে জামাইবাবু, তোমার চেয়েও ঢের ভালো অন্য
একজনকে সে বিয়ে করতে পারতো।’
তাই আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দোষত্রুটির
জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কারণ শুরু থেকেই যদি তাদের মধ্যে সেই দোষ ত্রুটিগুলো
না থাকত, তারা আমাদের থেকেও অনেকগুণ ভালো এমন কাউকে বিয়ে করতে পারত।
#প্রেম-
২৮
যখন আমরা প্রেমে পড়ি, তখন আমরা আমাদের
সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দেয়ালে কেবল ভালো ইটগুলো দেখি। আমরা কেবল সেগুলোই দেখতে চাই, আর
তাই সেগুলোই কেবল দেখে থাকি। আর অন্যগুলোকে অস্বীকার করি। পরে যখন উকিলের কাছে যাই
বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা নিয়ে, তখন আমরা আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দেয়ালে কেবল খারাপ
ইটগুলো দেখি। আমরা তার ভালো গুণগুলোর প্রতি অন্ধ হয়ে যাই। আমরা ওগুলো দেখতে চাই না,
তাই সেগুলো আর দেখি না। আমরা আবার অন্যগুলোকে অস্বীকার করি।
কেন এমন হয় যে প্রেম ঘটে নাইট ক্লাবের
আলো আঁধারে, অথবা কোন মোমবাতির আলোয় সারা কোন সান্ধ্যভোজে অথবা কোন পূর্ণিমা রাতে?
কারণ এসব অবস্থায় আপনি তার তিলগুলো দেখেন না। তার নকল দাঁতগুলো দেখেন না। আমরা তখন
মোমবাতির আলোয় আমাদের কল্পনার রঙে স্বাধীনভাবে কল্পনা করে নিতে পারি যে অপর পাশে বসা
মেয়েটি একটি সুপার মডেল, অথবা ছেলেটি দেখতে সিনেমার নায়কের মতো। আমরা কল্পনা করতে পছন্দ
করি, আর আমরা কল্পনা করি প্রেম-ভালোবাসায় ভরা জীবন। অন্ততপক্ষে আমাদের জানা উচিত, আমরা
কী করছি।
ভিক্ষুরা এমন মোমবাতির আলোর প্রেমের মধ্যে
নেই। তারা আলো ফেলে চলে বাস্তবতার উপরে। যদি আপনি স্বপ্ন চান, কল্পনা চান, তাহলে বৌদ্ধ
বিহারের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবেন না। উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডে আমার ভিক্ষু হওয়ার প্রথম
বছরে, একবার আমি গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। আমি বসেছিলাম গাড়ির পিছনের সিটে, আরো দুজন পশ্চিমা
ভিক্ষুর সাথে। আজান চাহ, আমার গুরু, তিনি বসেছিলেন সামনের সিটে। তিনি হঠাৎ পিছনে ফিরে
আমার পাশে বসা নতুন ভিক্ষুটির দিকে তাকালেন আর থাই ভাষায় কিছু একটা বললেন। তৃতীয় পশ্চিমা
ভিক্ষুটা থাই ভাষায় পারদর্শী ছিল। সে আমাদেরকে তা অনুবাদ করে দিল, ‘আজান চাহ্ বলেছেন
যে তুমি লস এঞ্জেলসে ফেলে আসা তোমার প্রেমিকার কথা ভাবছো।’
বিস্ময়ে সেই আমেরিকান ভিক্ষুটির চোয়াল
ঝুলে পড়ল। আজান চাহ্ তার চিন্তাগুলো পড়তে পেরেছেন নিখুঁতভাবে। আজান চাহ্ হাসলেন, তার
পরের কথাগুলো অনুবাদিত হলো এভাবে, ‘চিন্তা করো না। আমরা সেটার একটা ব্যবস্থা করতে পারি।
পরের বারে চিঠি লিখলে তাকে বলো সে যেন তোমাকে তার খুব ব্যক্তিগত, তার সাথে গভীরভাবে
সম্পর্কযুক্ত এমন একটা কিছু পাঠায়। যখনই তুমি তাকে মিস করবে, সেটা বের করে তার কথা
মনে করতে পারবে।’
‘সেরকম কোন কিছু কি কোন ভিক্ষু রাখতে পারে?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ভিক্ষুটি।
‘অবশ্যই।’
জবাব দিলেন আজান চাহ।
বোধহয় ভিক্ষুরাও প্রেম ভালোবাসা বোঝে।
আজান চাহ্ এরপরে যা বললেন তা অনুবাদ করতে
অনেক সময় লেগে গেল। কারণ আমাদের অনুবাদককে জোর করে হাসি থামিয়ে নিজেকে আগে সংযত করে
নিতে হয়েছিল।
‘আজান চাহ বলেছেন...’ সে হাসির চোটে বেরিয়ে
আসা চোখের পানি মুছে শব্দগুলো বের করার চেষ্টা চালাল, ‘আজান চাহ্ বলেছেন তুমি তোমার
প্রেমিকাকে বলো, সে যেন তার এক
বোতল
ঘু পাঠায়। এরপর যখনই তুমি তাকে মিস করবে, সেই বোতলটা বের করে খুলে দেখবে!’
সত্যিই তো, ঘু হচ্ছে খুব ব্যক্তিগত একটা
জিনিস। যখন আমরা আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কাছে আমাদের ভালোবাসাকে প্রকাশ করি, তখন
কি আমরা বলি না যে আমরা তার সবকিছুকেই ভালোবাসি? একই উপদেশ দেওয়া যায় কোন ভিক্ষুণীর
ক্ষেত্রে, যে তার প্রেমিককে মিস করছে।
যেমনটি বলেছিলাম, যদি আপনি প্রেম ভালোবাসা
নিয়ে কল্পনার জাল বুনতে চান, আমাদের বৌদ্ধ বিহার থেকে পরিষ্কার দূরে থাকুন।
#সত্যিকারের
ভালোবাসা- ৩০
প্রেমের ঝামেলাটা হচ্ছে যখন কল্পনার জাল
ছিঁড়ে যায়, তখন হতাশা ও অসন্তোষ আমাদেরকে ভীষণ দুঃখ দিতে পারে। প্রেমের যে ভালোবাসা,
তাতে আমরা আসলে আমাদের সঙ্গীকে ভালোবাসি না। আমরা কেবল ভালোবাসি তারা আমাদেরকে যে অনুভূতি
জাগিয়ে দেয় সেটাকে। তারা কাছে থাকলে যে এক আবেশ বা ভালোলাগার অনুভূতি হয়, সেটাকেই আমরা
ভালোবাসি। এজন্যই যখন তারা কাছে থাকে না, আমরা তাদেরকে মিস করি আর এক বোতল ... পাঠাতে
বলি (আগের গল্পটি দেখুন)। যে কোন আবেশ বা ঘোরের মতোই এমন ভালোলাগার অনুভূতি কিছু সময়
পরে কেটে যায়।
সত্যিকারের ভালোবাসা হচ্ছে নিঃস্বার্থ
ভালোবাসা। আমরা তখন অপর লোকটার ভালোমন্দ নিয়ে ভাবি। আমরা তাদের বলি, ‘আমার হৃদয়ের দরজা
তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে, তুমি যাই করো না কেন।’ আর আমরা সেটা মন থেকেই বলি। আমরা শুধু
চাই তারা সুখী হোক। এমন সত্যিকারের ভালোবাসা দুর্লভ।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাবতে পছন্দ করে,
আমাদের যে বিশেষ সম্পর্ক, তা হচ্ছে সত্যিকারের ভালোবাসা, কোন প্রেমের ভালোবাসা নয়।
এখানে একটা পরীক্ষা দেওয়া হলো আপনার জন্য, যা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন, কোন ধরনের ভালোবাসা
এটা।
আপনার সঙ্গীর কথা ভাবুন। আপনার মনে তার
একটি ছবি কল্পনা করুন। সেই দিনের কথা মনে করে দেখুন, যেদিন আপনাদের প্রথম দেখা হয়েছিল
আর এরপর থেকে কী চমৎকার সময়ই না কাটিয়েছেন আপনারা।
এখন কল্পনা করুন, আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে
একটা চিঠি এসেছে আপনার কাছে। চিঠিতে লেখা আছে, সে আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধুর সাথে গভীর প্রেমে
জড়িয়ে পড়েছে আর তারা দুজন পালিয়ে গেছে। আপনার অনুভূতিটা কেমন হবে?
যদি এটা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়, তাহলে
আপনি খুব রোমাঞ্চিত হবেন যে আপনার সঙ্গী আপনার থেকেও ভালো একজনকে খুঁজে পেয়েছে আর সে
এখন আরো সুখী। আপনি আনন্দিত হবেন যে আপনার সঙ্গী ও আপনার সেরা বন্ধু দুজনে খুব ভালো
সময় কাটাচ্ছে। আপনি খুশিতে উল্লসিত হয়ে উঠবেন যে তারা প্রেমে পড়েছে। সত্যিকারের ভালোবাসায়
আপনার সঙ্গীর সুখই কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়?
এমন সত্যিকারের ভালোবাসা দুর্লভ।
এক রাণী তার প্রাসাদের জানালা দিয়ে বুদ্ধকে
পিন্ডচারণ করতে দেখছিল। রাজা তা দেখতে পেলেন। এই মহান সন্ন্যাসীর প্রতি রাণীর যে ভক্তি,
তা রাজার অন্তরে ঈর্ষা জাগিয়ে তুলল। তিনি তার রাণীকে ডেকে জানতে চাইলেন কাকে সে সবচেয়ে
বেশি ভালোবাসে, বুদ্ধকে না স্বামীকে? রাণী ছিল বুদ্ধের পরম ভক্ত। কিন্তু সেই আমলে আপনার
স্বামী যদি হয় রাজা, তাহলে খুব সতর্ক হতে হবে। তখন বুদ্ধি হারানো মানে মাথাটা হারানো।
সে তার মাথাকে বাঁচিয়েছিল নিখাঁদ সত্যের জবাব দিয়ে, ‘আমি তোমাদের দুজনের চেয়েও বেশি
ভালোবাসি নিজেকে।’
-----------দ্বিতীয়
অধ্যায় শেষ-----------
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।