হৃদয়ের দরজা খুলে দিন। (পর্ব-২৩) পঞ্চম অধ্যায়


পঞ্চম অধ্যায়: সুখ সৃষ্টি করা

#এক ট্রাক গোবর- ৮০
আমরা চাই না এমন অনেক খারাপ জিনিস, যেমনটা হচ্ছে ক্লাসে সবচেয়ে নিচে থাকা, এমন ঘটনা জীবনে ঘটে। প্রত্যেকের জীবনেই ঘটে। সুখী মানুষ ও হতাশ মানুষের মধ্যে এখানে পার্থক্যটা কেবল হচ্ছে তারা এমন দুর্যোগে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
কল্পনা করুন আপনি সাগর সৈকতে এক বন্ধুর সাথে বিকেলটা চমৎকার কাটিয়েছেন। যখন ঘরে ফিরলেন, দেখলেন বিরাট এক ট্রাকে করে এক ট্রাক গোবর ঢেলে দেওয়া হয়েছে ঠিক আপনার ঘরের দরজার সামনে। এখানে তিনটি বিষয় জানেন আপনি:
            প্রথমত, আপনি কোন গোবরের অর্ডার দেন নি। এটা আপনার দোষ নয়।
দ্বিতীয়ত, আপনি এটা নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেছেন। কেউই দেখে নি কে এটা ওখানে ঢেলে দিয়ে গেছে। তাই কাউকে ডেকেও এটাকে সরিয়ে নিতে বলতে পারছেন না।
তৃতীয়ত, এমন নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত সেই গোবর, যার জন্য ঘরে টেকা দায় হয়ে পড়েছে।
এই রূপক গল্পে ঘরের সামনের সেই গোবরের স্তুপ হচ্ছে জীবনে আমাদের উপর ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনাগুলো। সেই গোবরের স্তুপের মতোই, আমাদের জীবনের দুঃখজনক ঘটনাগুলোতেও তিনটি জিনিস জানা আছে:
১। আমরা এগুলো অর্ডার দিয়ে ডেকে আনি নি। আমরা বলি, ‘আমাকে কেন এত দুঃখ পোহাতে হচ্ছে?’
২। আমরা ঝামেলায় পড়ে গেছি। কেউ না, এমনকি আমাদের সেরা বন্ধুরাও এই ঝামেলাকে দূর করে দিতে পারবে না (যদিও তারা তা চেষ্টা করতে পারে)।
৩। এটা এমন জঘন্য, আমাদের সুখকে এমনভাবে ধ্বংস করে যে, আমাদের সারা জীবনটাকে দুঃখে ভরিয়ে দেয়। এটা সহ্য করাও দায় হয়ে পড়েছে।
এমন এক ট্রাক গোবরের ব্যাপারে আমাদের দুটো পথ খোলা আছে। প্রথম পথ হচ্ছে গোবরটা সাথে করে ঘুরে বেড়ানো। পকেটে কিছু, ব্যাগে কিছু, জামাতে কিছু, এমনকি প্যান্টেও কিছু গোবর লাগিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই। আমরা দেখি যে, যখনই আমরা গোবর সাথে নিয়ে ঘুরি, তখন আমরা অনেক বন্ধু হারাই! এমনকি সেরা বন্ধুরাও তখন আশেপাশে কম আনাগোনা করে।
গোবর বয়ে নিয়ে বেড়ানো হচ্ছে হতাশা, নাবোধক চিন্তাভাবনা ও ক্রোধে ডুবে যাওয়ার মতো। এটা হচ্ছে প্রতিকুল পরিস্থিতিতে আমাদের স্বাভাবিক ও বোধগম্য প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আমরা অনেক বন্ধু হারাই, কারণ এটাও স্বাভাবিক এবং বোধগম্য যে, যখন আমরা হতাশার মধ্যে থাকি, তখন আমাদের বন্ধুরা আমাদের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে না। তাছাড়া, গোবরের স্তুপ তো কমেই না, বরং যতই দিন যায়, ততই এর দুর্গন্ধ আরো তীব্র হয়।
সৌভাগ্যবশত, দ্বিতীয় আরেকটা পথ আছে। যখন এমন ট্রাকভর্তি গোবর আমাদের ঘরের সামনে ফেলে রাখা হয়, তখন কী আর করা। আমরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠেলাগাড়ি, বেলচা ও কোদাল বের করে কাজে নেমে পড়ি। বেলচা দিয়ে গোবরগুলো ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে ঘরের পেছনে যে বাগান আছে, সেখানে পুঁতে ফেলি। ক্লান্তিকর ও পরিশ্রমের একটা কাজ। কিন্তু আমরা জানি, আর কোন বিকল্প নেই আমাদের। মাঝে মাঝে এমনো হয়, দিনে কোনমতে অর্ধেক ঠেলাগাড়ি পরিমাণ গোবর সরাতে পারি। আমরা তখন কিন্তু হতাশা নিয়ে অভিযোগ করছি না। বরং সমস্যাটার সমাধানের ব্যাপারে কিছু একটা করছি। দিনের পর দিন আমরা গোবরের স্তুপে কোদাল চালিয়ে যাই। দিনের পর দিন গোবরের স্তুপ ছোট থেকে ছোট হতে থাকে। মাঝে মাঝে হয়তো কয়েক বছরও লেগে যায়। কিন্তু কোন এক সকাল আসে যখন আমরা দেখি যে বাড়ির সামনের গোবরের স্তুপ আর নেই। আর বাড়ির অন্যপাশে তখন যেন যাদুর ছোঁয়া লেগেছে। আমাদের বাগানের ফুলগুলো ঝলমলে রঙ নিয়ে ফুটেছে সারা এলাকা জুড়ে। তাদের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়ও। যাতে প্রতিবেশিরা তো বটেই, রাস্তার পথচারিরাও আনন্দে হেসে উঠছে। বাড়ির কোণাটায় ফলের গাছটা তো ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা, এত ফল ধরেছে সেখানে। আর ফলগুলো এত মিষ্টি। এমনটি আপনি কোথাও কিনতে পাবেন না। এত বেশি ফল ধরেছে যে আমরা সেখান থেকে প্রতিবেশিদেরও দিতে পারি। এমনকি পথচারিরাও এই যাদুর ফলের অপূর্ব স্বাদ নিতে পারে।
‘গোবরের স্তুপে কোদাল চালানো হচ্ছে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলোকে জীবনের জন্য সার হিসেবে স্বাগত জানানোর রূপকীয় কথা। এই কাজটা আমাদের একাই করতে হয়। আমাদের সাহায্য করার মত কেউ নেই এখানে। কিন্তু আমাদের হৃদয়ের বাগানে দিনের পর দিন এটাকে একটু একটু করে পুঁতে ফেলার ফলে দুঃখের ভার কমতে থাকে। এতে হয়তো কয়েক বছরও লেগে যায়। কিন্তু কোন এক সকাল আসে যখন আমরা আমাদের জীবনে আর কোন দুঃখ দেখি না। আর আমাদের হৃদয় যেন যাদুর ছোঁয়া পায়। তার পুরোটা জুড়ে দয়ার ফুল ফুটে থাকে। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সৌরভ তখন ছড়িয়ে পড়ে রাস্তাতে, প্রতিবেশিদের কাছে। ঘরের কোণায় সেই জ্ঞানের বৃক্ষ নুয়ে পড়ে আমাদের দিকে। জীবনের স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহে মিশে থাকা মিষ্টি প্রজ্ঞার ফল দিয়ে এটি ভরা থাকে। আমরা সেই সুস্বাদু ফলগুলো মুক্ত হস্তে বিলিয়ে যাই, এমনকি পথচারিদেরকেও এর ভাগ দিই নির্বিচারে।
যখন আমরা এমন হৃদয়ভাঙা ব্যথাকে জানি, এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের বাগানকে গড়ে তুলি। তখন আমরা আরো গভীর ব্যথাকে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে পারি আর নরম সুরে বলতে পারি, ‘আমি জানি। তারা উপলদ্ধি করে যে আমরা সত্যিই বুঝি। মৈত্রী জেগে ওঠে। আমরা তাদেরকে ঠেলাগাড়ি, বেলচা ও কোদাল দেখাই, অপরিসীম উৎসাহ দেখাই। আমাদের বাগানকে যদি আমরা এখনো গড়ে না তুলি, তাহলে এমনটি ঘটতে পারবে না।
আমি অনেক ভিক্ষুকে চিনি যারা ধ্যানে অত্যন্ত দক্ষ। প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও তারা থাকে শান্ত, সংযত এবং অটল। কিন্তু তাদের মধ্যে কেবল কয়েকজনই মহান আচার্য্য হয়েছে। আমি প্রায়ই অবাক হতাম, কেন এমন হয়।
এখন আমার কাছে মনে হয় যে, যেসব ভিক্ষুরা তুলনামূলকভাবে সহজ জীবন কাটিয়েছে, যাদের খোঁড়ার মত গোবর অল্পই ছিল, তারাই সেসব ভিক্ষু যারা আচার্য্য হয় নি। যেসব ভিক্ষু অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু নিরবে খুঁড়ে গেছে, তারা সমৃদ্ধশালী এক বাগান গড়েছে, যাতে করে তারা মহান আচার্য্য হয়ে উঠেছে। তাদের সবারই প্রজ্ঞা, প্রশান্তি ও মৈত্রী ছিল। কিন্তু যাদের গোবর বেশি ছিল, তাদের এই জগতে ভাগাভাগি করার জিনিসও বেশি ছিল। আমার শিক্ষক আজান চাহ্, যিনি আমার জন্য সবার সেরা আচার্য্য, তার জীবনের প্রথম দিকে নিশ্চিতই ট্রাক কোম্পানির সমস্ত ট্রাকগুলো লাইন ধরে তার ঘরের দরজায় গোবর ঢেলে দিয়ে এসেছিল।
সম্ভবত এই গল্পের উপদেশ হচ্ছে যে, যদি আপনি এই জগতের কোন কাজে নিজেকে লাগাতে চান, যদি মৈত্রীর পথ অনুসরণ করতে চান, তাহলে পরের বার আপনার জীবনে কোন হৃদয়ভাঙা ঘটনা ঘটলে আপনি বলতে পারেন, ‘বাঃ! আমার বাগানের জন্য আরো সার!’
                                                                                               -------------------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !