হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-২৬) ষষ্ঠ অধ্যায়


ষষ্ঠ অধ্যায়: কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান

#কর্ম নিয়ম- ৮৯
বেশিরভাগ পশ্চিমা লোক কর্ম নিয়মটাকে ভুলভাবে বোঝে। তারা এটাকে অদৃষ্টবাদের সাথে ভুল করে, যারা মনে করে কোন ব্যক্তি তার ভুলে যাওয়া অতীত জন্মের কোন অজানা অপরাধের জন্য নিশ্চিত শাস্তি পাবে। ব্যাপারটা যে সেরকম নয়, তা আমরা নিচের গল্প থেকে বুঝতে পারি।
দুজন মহিলা প্রত্যেকেই একটা করে কেক বানাচ্ছিল।

প্রথম মহিলার মালমশলা ছিল খুব খারাপ মানের। তার সাদা পুরনো ময়দা থেকে সবুজ ছত্রাকের টুকরোগুলো বেছে নিয়ে ফেলে দিতে হলো। কোলেস্টেরলে ভরা মাখন পঁচে দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। সাদা চিনির দানাগুলো থেকে বাদামী দলাগুলো ফেলে দিতে হলো (কারণ, কেউ ওখানে কফির চামচ ডুবিয়েছিল)। আর তার ফলমূল বলতে ছিল পুরনো হয়ে যাওয়া কিসমিস, সেগুলো এমন শক্ত হয়ে গিয়েছিল যেন ক্ষয় হয়ে যাওয়া ইউরেনিয়ামের অবশিষ্ট অংশ। আর তার রান্নাঘরের সরঞ্জামগুলোও ছিল বিশ্বযুদ্ধের আগের আমলের স্টাইলের- তবে সেটা কোন বিশ্বযুদ্ধ, তা অবশ্য তর্কের বিষয়।
দ্বিতীয় মহিলাটির সব মালমশলা ছিল সবচেয়ে ভালোটা। তার ছিল প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সম্পূর্ণ খাঁটি এবং গ্যারান্টিযুক্ত গমের ময়দা। মাখন হিসেবে ছিল কোলেস্টেরলমুক্ত মাজারিন। সাথে ছিল কাঁচা চিনি আর নিজস্ব বাগানে জন্মানো রসালো ফল। তার রান্নাঘরটাও ছিল অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো।
কোন মহিলা সবচেয়ে ভালো কেক বানিয়েছিল? যার মালমশলা ভালো, সে প্রায়ই ভালো কেক প্রস্তুতকারী হয় না। কেক বানানোতে মালমশলার চেয়েও বেশি কিছু লাগে। মাঝে মাঝে এমন হয়, খারাপ মালমশলা হলেও কেক প্রস্তুতকারী সেগুলোর সাথে এত শ্রম, যত্ন ও ভালোবাসা ঢেলে দেয় যে, তার কেকগুলোই সবচেয়ে সুস্বাদু হয়। মালমশলা দিয়ে আমরা কী করি, সেটাই এর কারণ।
আমার কয়েকজন বন্ধু আছে যাদের জীবনের মালমশলাগুলো ছিল খুব শোচনীয়: তারা দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল, শিশু হিসেবে নির্যাতিত হয়েছিল, স্কুলে তেমন চালাক চতুর ছিল না, হয়তো বিকলাঙ্গ এবং খেলাধুলাও করতে পারতো না। কিন্তু কয়েকটা গুণ, যা তাদের মধ্যে ছিল, তারা সেগুলোকে এমনভাবে কাজে লাগিয়েছে যে, তারা সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো একটা কেক বানিয়েছে। আমি তাদেরকে খুব প্রশংসা করি। আপনি কি এমন লোকদের চেনেন?
আমার অন্যান্য বন্ধুরাও আছে যাদের জীবনের জন্য চমৎকার মালমশলা ছিল। তাদের জন্ম হয়েছিল সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারে, স্কুলে তারা ছিল খুব বুদ্ধিমান, খেলাধুলায় তুখোড়, চেহারাও সুন্দর, সবার কাছে জনপ্রিয়, কিন্তু তাদের তরুণ জীবন তারা নষ্ট করেছে নেশা বা মদে। আপনি কি এমন কাউকে চেনেন?
কর্মের অর্ধেকটা হচ্ছে সেই মালমশলাগুলো, যেগুলো দিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। আর বাকি অর্ধেকটা, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে আমরা কী করি এই জীবনে।

 #বেরোবার কোন পথ না থাকলে চা খান- ৯০
আমাদের দিনের মালমশলাগুলো নিয়ে আমরা সবসময়ই কিছু না কিছু করতে পারি, তা যদি হয় শুধু বসে থাকা, আর শেষ চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া, তাও আমরা করতে পারি। নিচের গল্পটা [আমার স্কুলটিচার থাকাকালীন সময়ে] আমাকে বলেছিল এক সহকর্মী শিক্ষক, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করেছিল।
সে তখন বার্মার জঙ্গলে তার দলের সাথে ঘুরে ঘুরে শত্রুর গতিবিধি অনুসন্ধান করছিল। তখন সে ছিল বয়সে তরুণ, বাড়ি থেকে অনেক দূরে, আর খুব ভীত। তার দলের স্কাউট তাদের ক্যাপ্টেনকে একটা সাংঘাতিক খবর দিল। তাদের ছোট্ট অনুসন্ধানী সেনাদল বিশাল সংখ্যক জাপানি সেনার মুখে পড়েছে। জাপানি সৈন্যদের সংখ্যার তুলনায় তাদের ছোট্ট দলটা কিছুই নয়, তদুপরি আবার চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়েছে। তরুণ ব্রিটিশ সৈন্য নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করল।
সে আশা করেছিল, তাদের ক্যাপ্টেন তার লোকদেরকে লড়াই করে এই ঘেরাও অবস্থা থেকে বেরোবার একটা পথ বানাতে বলবে, সেটাই বীরত্বের কাজ। তাতে অন্তত কেউ কেউ বেরিয়ে যেতে পারবে। যদি না হয়, তো ঠিক আছে। মরার সময় কয়েকজন শত্রুসেনাকে নিয়ে মরবে। সেটাই তো সৈন্যরা করে। কিন্তু ক্যাপ্টেন এমন সৈন্য ছিল না। সে তার লোকদেরকে চুপ করে বসে থাকতে বললো আর এক কাপ করে চা বানাতে বললো। এতকিছু সত্ত্বেও তারা ব্রিটিশ সৈন্য কিনা!
তরুণ সৈন্যটি ভাবলো তার কমান্ডিং অফিসারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শত্রু চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, পালাবার কোন পথ নেই, মরতে বসেছে, এমন অবস্থায় কীভাবে কোন লোক এক কাপ চায়ের কথা ভাবতে পারে? আর্মিতে, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়, অর্ডার মানতে হয়। তারা সবাই তাদের শেষ চা বানালো এক কাপ করে। চা খেয়ে শেষ করার আগেই স্কাউট আবার ফিরে এলো আর ক্যাপ্টেনের কানে কানে ফিস ফিস করলো। ক্যাপ্টেন তার লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ‘শত্রুরা সরে গেছে। বেরোনোর একটা পথ পাওয়া গেছে। তোমাদের জিনিসপত্র গুছাও তাড়াতাড়ি এবং নিঃশব্দে। এবার চলো, যাওয়া যাক!’
তারা সবাই নিরাপদে বেরিয়ে এল। একারণেই সে বহু বছর পরে এই গল্পটা আমাকে বলতে পেরেছিল। সে বলেছিল যে তার জীবন তার ক্যাপ্টেনের প্রজ্ঞার কাছে ঋণী, কেবল সেই বার্মার যুদ্ধে নয়, তখন থেকে আরো অনেক বার। তার জীবনে অনেক বার এমন হয়েছে যেন সে চারদিক থেকে শত্রু দ্বারা বেষ্টিত, তাদের সংখ্যা অনেক, বেরোবার পথ নেই, মরণ সন্নিকটে। শত্রু বলতে সে বুঝিয়েছিল মারাত্মক কোন অসুস্থতা, ঘোর বিপদ এবং নিদারুণ  শোক, আপাতদৃষ্টিতে যার মাঝখান থেকে বের হওয়ার কোন পথ নেই। বার্মার অভিজ্ঞতা না হলে, সে এসব সমস্যার সাথে লড়াই করে বেরোবার চেষ্টা করত, কিন্তু কোন সন্দেহ নেই, সমস্যাটা তখন আরো জটিল হয়ে উঠতো। তার বদলে মৃত্যু বা মারাত্মক ঝামেলা এসে যখন তাকে ঘিরে ধরেছে, সে তখন বসে বসে এক কাপ চা বানিয়েছে।
এই পৃথিবী সবসময় বদলে যাচ্ছে। জীবন নিয়ত প্রবাহমান। সে তার চা খেয়েছে, তার শক্তিগুলোকে সুসংহত করেছে, আর সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছে, যা সবসময়ই এসেছে। তখন সে কার্যকর কিছু একটা করেছে, যেমন - পালিয়েছে।
যারা চা পান করেন না, তারা এই প্রবাদটা মনে রাখুন: ‘যখন করার কিছু নেই, তখন কিছুই করো না।
এটা হয়তো খুব সরল মনে হতে পারে। কিন্তু এটা হয়তো আপনার জীবনকে বাঁচাতে পারে।

                                                                                                  -----------------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !