হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-২৭) ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়: কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান


#স্রোতের সাথে চলা-৯১
একজন জ্ঞানী ভিক্ষুকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। সে একবার তার এক পুরনো দোস্তকে নিয়ে কোন বৈচিত্র্যময় জঙ্গলে ঘুরতে বেরিয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলে তারা একটা নির্জন সাগরতীরে পৌঁছল। যদিও ভিক্ষুদের নিয়ম আছে, মজা বা উপভোগের জন্য সাঁতার কাটা যাবে না, কিন্তু নীল সাগর যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। জঙ্গলে এতক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি করে এখন তার দরকার ছিল শরীরটাকে জুড়ানো। তাই সে কাপড়চোপড় খুলে সাঁতার কাটতে নেমে গেল।
ভিক্ষু হওয়ার আগে, তরুণ বয়সে, সে ছিল একজন দক্ষ সাঁতারু। অনেক বছর হলো সে ভিক্ষু হয়েছে, সর্বশেষ সাঁতার কেটেছে সেই কোন আমলে। ঢেউয়ের মাঝে দু’এক মিনিট সাঁতার কাটার পরে সে একটা চোরা স্রোতের কবলে পড়ল। সেই স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল সাগরের দিকে। সে পরে আমাকে বলেছিল যে, এটা ছিল খুব বিপদজনক একটা সৈকত, কেননা এর স্রোত গুলো ছিল সাংঘাতিক।
প্রথমে ভিক্ষুটি স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার চেষ্টা করল। কিন্তু শীঘ্রই সে বুঝতে পারল, স্রোতের শক্তির সাথে পেরে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব। ভিক্ষুর ট্রেনিং এখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। সে রিল্যাক্সড হল আর স্রোতের সাথে ভেসে গেল। এমন পরিস্থিতিতে রিল্যাক্সড হয়ে সাগরে ভেসে যাওয়াটা ছিল রীতিমত দুঃসাহসিক ব্যাপার, বিশেষ করে যখন সে দেখছিল যে সাগরের তীর দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বহু শত মিটার ভাসিয়ে নিয়ে তবেই জোয়ারের স্রোতে মিলিয়ে গেল। কেবল তখনই সে জোয়ারের স্রোত থেকে দূরে সরে গিয়ে তীরের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল।
সে আমাকে বলেছিল যে, সাঁতার কেটে তীরে ফিরে আসতে তাকে শক্তির প্রতিটি বিন্দু খরচ করতে হয়েছিল। সে তীরে এসে পৌঁছাল পুরো বিধ্বস্ত হয়ে। সে নিশ্চিত ছিল যে, স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করলে নির্ঘাত পরাজিত হতো সে। সে সাগরে গিয়ে পড়তোই, কিন্তু লড়াই করে শক্তিহীন হওয়াতে আর তীরে ফিরে আসা সম্ভব হতো না তার। যদি সে যেতে না দিয়ে, স্রোতের সাথে ভেসে না যেতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ডুবে মরতো।
এমন ঘটনা সেই প্রবাদটিকে মনে করিয়ে দেয়, ‘যেখানে কিছু করার থাকে না, সেখানে কিছু করো না। এটা কোন কাল্পনিক তত্ত্ব নয়, বরং বিপদের সময় জীবন বাঁচানোর মতো প্রজ্ঞার জন্ম দেয়। যখন স্রোত আপনার চেয়ে শক্তিশালী হয়, তখনই স্রোতের সাথে চলার সময়। যখন আপনি কাজ করতে সক্ষম, তখনই আপনার প্রচেষ্টা চালানোর সময়।

#বাঘ ও সাপের মাঝে আটকে পড়া- ৯৩
একটা প্রাচীন বৌদ্ধ কাহিনী আছে যা জীবন মরণের সংকট থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পেতে পারি, তার শিক্ষা দেয়। কোন এক জঙ্গলে এক ব্যক্তিকে একটি বাঘ তাড়া করছিল। বাঘ মানুষের চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারে, আর তারা মানুষ খায়। বাঘটি যেহেতু ক্ষুধার্ত ছিল, তাই লোকটি বেশ বিপদে পড়ে গেল। বাঘটি তাকে প্রায় ধরে ফেলেছে, এসময় সে দেখল পথের পাশে একটা কুয়ো। সাত পাঁচ না ভেবে সে দিল কুয়াতে লাফ। কিন্তু লাফ দেয়ার আগমুহুর্তে দেখল কত বড় ভুল করল সে। কুয়োটি ছিল শুকনো, আর তার তলায় কুন্ডলী পাকিয়ে ছিল বিশাল এক কালো সাপ।
নিজের অজান্তেই সে হাত দিয়ে কুয়োর দেয়াল ধরে পতন রোধের চেষ্টা করল। এসময় তার হাতে ঠেকল একটা গাছের শেকড়। শেকড়টা ধরে সে কোনমতে কুয়োর তলায় পড়ে যাওয়াটা রোধ করল। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে নিচে তাকিয়ে দেখল, সাপটি তার ফণা তুলে তার পায়ে ছোবল দেয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু একটুর জন্য নাগাল পাচ্ছে না। উপরে তাকিয়ে দেখল বাঘটি কুয়োর ভেতরে ঝুঁকে থাবা চালিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু একটুর জন্য নাগাল পাচ্ছে না। এই চরম বিপদের মুহুর্তে সে দেখলো একটা গর্ত থেকে একটা কালো ও একটা সাদা রঙের ইঁদুর বের হয়ে শেকড়টাকে কামড়ানো শুরু করেছে।
বাঘটি যখন কুয়োর ভেতর থাবা চালিয়ে লোকটিকে ধরার চেষ্টা করছিল, তখন তার শরীরটা ঘষা খাচ্ছিল কুয়োর পাড়ের একটা ছোট গাছের সাথে। ফলে গাছটি ঝাঁকুনি খাচ্ছিল একটু একটু। সেই গাছের একটা ডাল কুয়োর উপরে ঝুলে ছিল, যাতে ছিল একটা মৌচাক। ঝাঁকুনির ফলে বিন্দু বিন্দু মধু পড়ছিল কুয়োর মধ্যে। লোকটি জিহ্বা বের করে কয়েক ফোঁটা চেখে দেখল।
‘উমম! দারুণ স্বাদ তো!’ সে মনে মনে ভাবল এবং হাসল।
এই গল্পের এখানেই শেষ। এজন্যই এটা আমাদের জীবনেও সত্যি। আমাদের জীবনেরও কোন সুস্পষ্ট পরিসমাপ্তি নেই। বরং এই সমাপ্তির প্রক্রিয়াটি অনন্তকাল ধরে প্রবাহমান। অধিকন্তু আমাদের জীবনটা যেন ক্ষুধার্ত বাঘ ও বিশাল কালো সাপের মাঝে আটকা পড়ে আছে। মৃত্যু এবং তার চেয়েও খারাপ কিছুর মধ্যে। যেখানে রাত ও দিন (ইদুর দুটি) আমাদের জীবনের আয়ুকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে প্রতিনিয়ত। এমন চরম সংকটেও সবসময় কিছু মধু ঝরে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়। আমরা জ্ঞানী হলে আমাদের জিহ্বা বের করে সেই মধুর স্বাদ কিছুটা নিতে পারি। কেন নয়? করার যখন কিছু নেই, তখন কিছুই করবেন না। বরং জীবনের মধুর স্বাদ কিছুটা উপভোগ করুন।
গল্পটা বৌদ্ধ ঐতিহ্য মতে এখানেই শেষ। তবে আরো অর্থবহ করে তোলার জন্য আমি সাধারণত এর একটা সত্যিকারের পরিসমাপ্তি টেনে দিই। পরে যা ঘটে তা এরকম। লোকটা যখন মধুর স্বাদ আস্বাদনে ব্যস্ত, ইঁদুরগুলো দাঁত দিয়ে কেটে কেটে শেকড়টাকে আরো পাতলা করছে, সাপটি ফণা উচিয়ে লোকটির পায়ের আরো কাছাকাছি চলে আসছে, বাঘটি আরো ঝুঁকে পড়ছে, আরেকটু হলেই লোকটির নাগাল পেয়ে যাবে। কিন্তু বাঘটা একটু বেশিই ঝুঁকল, ফলে এটি কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল। লোকটাকে নাগালে না পেয়ে সে সোজা সাপটির উপর পড়ে গিয়ে নিজেও মরল, সাপটিকেও মেরে ফেলল।
জ্বি হ্যাঁ, এমনটা ঘটতেই পারে! সাধারণত অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে থাকে জীবনে। আমাদের জীবনটা এমনই। তাই মধুর ক্ষণগুলোকে কেন নষ্ট করা, এমনকি দিশেহারা কোন বিপদের সময়েও? ভবিষ্যৎ অনিশ্চিৎ। আমরা কখনোই নিশ্চিত নই, এরপরে কী আসছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !