ষষ্ঠ অধ্যায়: কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান
#যে
গরুটি কেঁদেছিল- ১০২
নিরাপত্তাব্যবস্থা অত কড়াকড়ি নয়, এমন
একটা জেলখানায় আমি বেশ আগেভাগে পৌঁছে গেলাম, ধ্যানের ক্লাস করানোর জন্য। একজন কয়েদি,
যাকে আগে কখনো দেখিনি, সে আমার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে ছিল মানুষরূপী
দৈত্য, ঝোপঝাড়ের মতো লম্বা চুল দাড়ি আর বাহুতে উল্কি আঁকা। মুখে প্রচুর কাটাকুটির দাগ
আমাকে বলে দিল, এই ব্যক্তি ভয়ংকর মারপিট করে এসেছে অনেকবার। তার চেহারাটা এমন ভয়ংকর
ছিল যে, আমি অবাক হলাম কেন সে ধ্যান শিখতে এসেছে। সে তো এ লাইনের লোক নয়। অবশ্যই আমার
এমন মনে করাটা ভুল ছিল।
সে আমাকে বললো যে, কয়েকদিন আগে একটা ঘটনা
ঘটেছে, যাতে তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড়। কথার শুরুতেই তার আলস্টার এলাকার
কথাবার্তা ধরা পড়ল আমার কাছে। পটভূমি হিসেবে জানালো, সে বড় হয়েছে বেলফাস্টের নির্মম
রাস্তাগুলোর একটাতে। তার প্রথম ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে যখন তার বয়স সাত। স্কুলের মাস্তান
ছোকরা তার কাছ থেকে দুপুরের খাবারের টাকা দাবি করেছিল। সে না বলে দিল। বয়সে বড় সেই
বালকটি একটা লম্বা ছুরি বের করে দ্বিতীয়বারের মতো টাকা চাইল। সে ভাবল মাস্তানটি ধাপ্পা
দিচ্ছে মাত্র। তাই সে আবারো না বলল। তৃতীয়বার আর মাস্তানটি জিজ্ঞেস করলো না, শুধু ছুরিটা
সেই সাত বছরের বালকের হাতে ঢুকিয়ে দিল, বের করে আনল আর হেঁটে চলে গেল।
সে আমাকে বলেছিল যে, সে হতভম্ব হয়ে স্কুলের
মাঠ থেকে দৌড় দিল কাছেই তার বাবার বাড়িতে, হাত বেয়ে তখন রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে । তার বেকার
পিতা ক্ষতটার দিকে একবার তাকাল মাত্র, আর তাকে নিয়ে গেল রান্নাঘরে। ক্ষত ব্যান্ডেজ
করে দিতে নয়। একটা ড্রয়ার খুলে বড় একটা ছুরি বের করল তার পিতা। সেটি তার ছেলের হাতে
দিয়ে স্কুলে ফিরে যেতে এবং মাস্তানটিকে কোপাতে আদেশ দিল। এভাবেই সে বড় হয়েছিল। সে যদি
এমন বিশালদেহী ও শক্তিশালী না হতো, অনেক আগেই সে মরে ভুত হয়ে যেত।
এই জেলখানাটা ছিল একটা জেলখানার খামার।
এটা ছিল মূলত স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কয়েদি, যাদের মুক্তির সময় হয়ে এসেছে, তাদের
জন্য। তারা এখানে থেকে খামারের কাজ শিখত, খামারের ব্যবসার কাজও শিখত। এখান থেকে উৎপন্ন
দ্রব্যাদি পার্থের আশেপাশের জেলখানাগুলোতে কম দামে সরবরাহ করা হতো, এতে করে জেলখানা
পরিচালনার খরচ কমতো।
অস্ট্রেলিয়ান খামারগুলো শুধু গম আর শাকসবজিই
নয়, গরু, ভেড়া আর শুকরও পালতো এবং জেলখানার খামারেও তাই হতো। কিন্তু অন্যান্য খামারগুলো
থেকে এটি একটু ভিন্ন ছিল যে, এই খামারে নিজস্ব কসাইখানা ছিল।
জেলখানার খামারে প্রত্যেক কয়েদিকে যে
কোন একটা চাকরি করতে হতো। আমি অনেক কয়েদির কাছ থেকে শুনেছি, যে চাকরিগুলো সবচেয়ে খোঁজা
হতো, সেগুলো হলো কসাইখানার চাকরি। এই চাকরিগুলো বিশেষ করে জনপ্রিয় ছিল নিষ্ঠুর অপরাধীদের
মধ্যে। আর সবচেয়ে যে চাকরিটি খোঁজা হতো, যার জন্য আপনাকে লড়তে হতো, সেটা ছিল কসাইয়ের
চাকরি। সেই বিশালদেহী আর ভয়ংকর আইরিশ লোকটিই ছিল কসাই।
সে আমাকে কসাইখানার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছিল।
কসাইখানার প্রবেশপথটা চওড়া, দুপাশে সুদৃঢ় ইস্পাতের রেলিং। বিল্ডিংয়ের মধ্যে গিয়ে সেই
প্রবেশপথটা আস্তে আস্তে সংকীর্ণ হয়ে গেছে ফানেলের মতো, দুপাশের রেলিংগুলো এমনভাবে পথের
উপর চেপে বসেছে যে, পথের শেষমাথায় একবারে কেবল একটা পশু যেতে পারে। পথের শেষ মাথায়
একটা পাটাতনের উপর সে দাঁড়িয়ে থাকত, হাতে বৈদ্যুতিক বন্দুক। গরু, শুয়োর অথবা ভেড়ার
পালকে কুকুর ও অন্যান্য রাখালদের দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেই ইস্পাতের রেলিং ঘেরা পথে ঢোকানো
হতো। যে বলেছিল যে তারা সবসময়ই নিজ নিজ স্বরে চীৎকার করতো, পালানোর চেষ্টা করতো। তারা
মৃত্যুর গন্ধ পেতো, মৃত্যুর শব্দ শুনতো, মৃত্যুকে অনুভব করতো। যখন কোন পশু সেই পথ বেয়ে
তার পাটাতনের পাশে আসতো, এটি দেহ মোচড়াতো আর তীব্র স্বরে ডেকে উঠতো। যদিও এই বৈদ্যুতিক
বন্দুক দিয়ে একটা মাত্র গুলিতেই একটা বড়সড় ষাঁড় মারা সম্ভব, কিন্তু সব পশুই এখানে এসে
অস্থির হয়ে উঠতো, লক্ষ্য স্থির করার সময়টা
পর্যন্ত দিতো না। তাই তাকে দু’বার গুলি করতে হতো, প্রথম গুলিটা স্থির
হওয়ার জন্য, দ্বিতীয় গুলিটা মারার জন্য। প্রথম গুলিতে স্থির, দ্বিতীয় গুলিতে মৃত্যু।
পশুর পর পশু। দিনের পর দিন।
আইরিশ লোকটা এবার আসল ঘটনায় আসলো আর উত্তেজিত
হতে শুরু করলো। ঘটনাটি ঘটেছিল মাত্র কয়েকদিন আগে, যা তাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। সে শপথ
করতে শুরু করলো। বার বার সে বলছিল, ‘এটা ঈশ্বরের ... সত্যি’।
সে ভেবেছিল, আমি তার কথা বিশ্বাস করবো না।
সেদিন পার্থের আশেপাশের জেলখানাগুলোতে
গরুর মাংস দেওয়ার কথা ছিল। তাই তারা গরু জবাই করছিল। এক গুলিতে গরুটাকে স্থির করে পরের
গুলিতে মেরে ফেলা। অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে গরু জবাইয়ের কাজ চলছিল। একসময়
একটা গরু আসলো যার মতো সে আগে কখনো দেখে নি। গরুটা ছিল নিরব, অন্যান্যদের মতো কোন দেহ
মোচড়ানো নেই, হাম্বা হাম্বা নেই, ফোঁস ফোঁস
নেই। এর মাথা নোয়ানো ছিল এমনভাবে যেন এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে, স্বেচ্ছায়, ধীরে ধীরে তার
পাটাতনের পাশে এসে দাঁড়ালো। এটি দেহ মোচড়ালো না, বা পালানোর চেষ্টাও করলো না।
সেইস্থানে এসে এবার গরুটি মাথা তুলে নিরবে
তার ঘাতকের দিকে তাকালো, একদম স্থির হয়ে।
আইরিশ লোকটা এমন ব্যাপার তো দূরে থাক,
এর কাছাকাছি কোন ঘটনাও দেখে নি এর আগে। তার মনটা কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল। সে না পারছিল
বন্দুকটা তুলে ধরতে, না পারছিল গরুটার চোখগুলো থেকে নিজের চোখকে সরিয়ে নিতে। গরুটা
সরাসরি তার ভেতরে তাকিয়েছিল।
সে যেন সময়ের অতীত কোন শূণ্যতায় ডুবে
গেল। কতক্ষণ এমন ছিল তা সে আমাকে বলতে পারে নি। কিন্তু যখন গরুটা তার চোখে চোখ রাখলো,
সে যা দেখলো, তাতে সে আরো ভীষণ নাড়া খেল। সে দেখল যে গরুটার বাম চোখে, নিচের চোখের
পাতার উপরে পানি জমতে শুরু করল। পানির পরিমাণ বাড়তে বাড়তে চোখের পাতা আর ধরে রাখতে
পারলো না। এটি ধীরে ধীরে গরুটার গাল বেয়ে উজ্জ¦ল এক অশ্রুরেখা সৃষ্টি করে গড়িয়ে পড়তে
শুরু করলো। তার হৃদয়ের দীর্ঘ দিনের বদ্ধ দরজাগুলো যেন খুলে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।
অবিশ্বাসের সাথে সে গরুটার ডান চোখে তাকিয়ে
দেখল, নিচের চোখের পাতার উপরে পানি জমতে জমতে এখান থেকেও দ্বিতীয় একটা অশ্রুধারা মুখ
বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ধীরে। লোকটি ভেঙে পড়ল। গরুটা কাঁদছিল।
সে আমাকে বলেছিল যে সে তার বন্দুক ছুঁড়ে
ফেলে দিয়েছিল আর চীৎকার করে জেলখানার পুলিশ অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা তাকে
যা খুশি করতে পারে, কিন্তু এই গরুটাকে কেউ মারতে পারবে না। সে তার কথা শেষ করলো এই
বলে যে, সে এখন নিরামিষভোজী।
গল্পটা সত্যি ছিল। জেলখানার অন্যান্য
কয়েদিরাও আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যে গরুটি কেঁদেছিল, সে সবচেয়ে নিষ্ঠুর লোকটিকে
শিখিয়েছিল যত্ন নেওয়া মানে কী।
#ছোট্ট
মেয়েটি ও তার বন্ধু- ১০৫
আমি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমের
একটা গ্রাম্য শহরে এক দল বয়স্ক লোকের কাছে যে গরুটি কেঁদেছিল তার গল্প বলেছিলাম। তাদের
মধ্যে এক বুড়ো লোক আমাকে এমন একটা গল্প শোনালো। সেটি তার তরুণ বয়সের ঘটনা। গত শতাব্দীর
প্রথমদিকের সময়কাল।
তার বন্ধুর কন্যার বয়স ছিল তখন চার কি
পাঁচ বছর। এক সকালে সে তার মায়ের কাছে ছোট্ট পিরিচে করে দুধ চাইলো। তার ব্যস্ত মা তো
খুশি, তার মেয়ে দুধ খেতে চাচ্ছে। তাই সে খুব একটা ভাবলো না, কেন সে দুধ চাচ্ছে পিরিচে
করে, কোন গ্লাসে নয়। পরেরদিনও একই সময়ে ছোট্ট মেয়েটি আবার এক পিরিচ দুধ চাইলো। মাও
খুশিমনে দিয়ে দিল। বাচ্চারা এমনিতেই তাদের খাবার নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। মা শুধু খুশি
যে তার মেয়েটি স্বাস্থ্যকর কোন কিছু খেতে চাচ্ছে। পরের কয়েকদিনও একই ব্যাপার ঘটলো,
একই সময়ে। মা আসলে কখনোই দেখে নি যে তার মেয়েটা পিরিচে করে দুধ খাচ্ছে, তাই সে ভেবে
কুলকিনারা পেল না, বাচ্চাটা কী নিয়ে মেতেছে। সে চুপিচুপি মেয়েটাকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত
নিল।
তখনকার দিনে প্রায় সব ঘরই বানানো হতো
খুঁটির উপরে, মাটি থেকে উপরে। ছোট্ট মেয়েটি ঘরের বাইরে গেল, ঘরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল
আর দুধের পিরিচটি নামিয়ে রেখে ঘরের নীচের অন্ধকার জায়গাটা লক্ষ্য করে নরম সুরে ডাকলো।
কয়েক মুহুর্ত পরে বিশাল এক কালো সাপ বেরিয়ে এল। এটি পিরিচ থেকে দুধ খেতে শুরু করলো,
মেয়েটির হাসিমাখা মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। তার মা কিছুই করতে পারলো না, কারণ
বাচ্চাটি সাপটির খুব কাছাকাছি ছিল। বুকভরা আতঙ্ক নিয়ে তার মা দেখলো যে সাপটি দুধ খেয়ে
শেষ করে ঘরের নিচে চলে গেল।
সেদিন সন্ধ্যায় তার স্বামী কাজ থেকে ঘরে
ফিরলে ব্যাপারটা তাকে জানালো সে। তার স্বামী তাকে বললো, যদি মেয়েটি পরেরদিনও এক পিরিচ
দুধ চায়, সে যেন তা দেয়। এর পরের ব্যবস্থা সে করবে।
পরের দিন একই সময়ে ছোট্ট মেয়েটি তার মাকে
এক পিরিচ দুধ দিতে বললো। সে দুধের পিরিচটি নিয়ে বরাবরের মতোই বাইরে গেল, বাড়ির পাশে
নামিয়ে রাখলো, আর তার বন্ধুকে ডাকল। বিশাল সেই কালো সাপটা অন্ধকার থেকে দেখা দেওয়া
মাত্র বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা গেল কাছেই। গুলির আঘাতে সাপটি একটি খুঁটির গায়ে আছড়ে
পড়ল, তার মাথাটা দেহ থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল মেয়েটির চোখের সামনে। তার বাবা ঝোপের
আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ালো আর বন্দুকটা একপাশে রেখে দিল।
তখন থেকে ছোট্ট মেয়েটি কোন কিছু খেতে
অস্বীকৃতি জানালো। বৃদ্ধ লোকটির ভাষায়, ‘সেছটফটানি শুরু করলো।’
তার বাবা-মা কিছুতেই কোন কিছু খাওয়াতে পারলো না। অগত্যা জেলা হাসপাতালে ভর্তি করাতে
হলো তাকে। কিন্তু তারাও কোন সাহায্য করতে পারলো না। ছোট্ট মেয়েটি মারা গেল।
সেই পিতা যখন তার মেয়ের চোখের সামনে তার
বন্ধুকের গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল, সে যেন গুলি করেছিল তার মেয়েটিকেও। যে বয়স্ক
লোকটি আমাকে এই গল্পটা বলেছিল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই কালো সাপটি ছোট্ট মেয়েটিকে
ক্ষতি করবে, এমনটা সে কখনো ভেবেছে কিনা?
‘সেরকম সম্ভাবনা আমি দেখি নি!’ জবাব দিয়েছিল
বুড়ো। আমিও তেমনই ভেবেছি, তবে একটু ভিন্ন সুরে।
------------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।