ষষ্ঠ অধ্যায়: কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান
#সম্রাটের
তিনটা প্রশ্ন- ৯৯
আমি পার্থের একটি শিক্ষা সম্পর্কিত আলোচনা
সভায় মূল বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমি একটু অবাক হলাম। পরে
যখন সভাস্থলে পৌঁছলাম, এক মহিলা, যার নাম লেখা ব্যাজ দেখে বুঝা গেল, সেই এই সেমিনারের
উদ্যোক্তা, সে আমাকে দেখে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল। ‘আমাকে মনে আছে আপনার?’ সে জিজ্ঞেস
করল।
উত্তর দেওয়ার জন্য চুড়ান্ত রকম বিপদজনক
প্রশ্নগুলোর মধ্যে এটি একটি। আমি সোজাসাপটা উত্তর দিতে মন স্থির করে বললাম, ‘না।’
সে হেসে আমাকে বললো যে, সাত বছর আগে আমি
একটা স্কুলে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। সে ছিল সেই স্কুলের অধ্যক্ষ। তার স্কুলে আমি একটা গল্প
বলেছিলাম যা তার জীবনের গতিপথকে বদলে দিয়েছিল। সে অধ্যক্ষের পথ থেকে ইস্তফা দিল। এরপরে
সে নিরন্তর পরিশ্রম করে গেল ঝরে পড়া শিশুদের জন্য একটা কর্মসূচী তৈরী করার কাজে। সেই
বাচ্চারা, যারা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়েছে- রাস্তার টোকাইদের দল, অপ্রাপ্তবয়স্ক
যৌনকর্মী, নেশাখোর- তাদেরকে জীবনের আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য, তাদের উপযোগী করে একটা
কর্মসূচী হাতে নিল সে। সে আমাকে বললো যে, তার এই কর্মসূচীর মূল দর্শনই হচ্ছে আমার বলা
গল্পটা। গল্পটা ছিল লিও টলস্টয়ের ছোট গল্পের একটা বই থেকে ধার করা। আমি সেটা ছাত্র
থাকাকালীন সময়ে পড়েছিলাম।
অনেক আগে, এক সম্ররাট জীবনের একটা দর্শন
খুঁজতে লাগলেন। রাজ্য শাসন আর নিজেকে শাসন, এই উভয় কাজেই তার দরকার ছিল প্রজ্ঞাময় দিকনির্দেশনা।
সমসাময়িক ধর্ম ও দর্শন তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। তাই তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে
তার দর্শন হাতড়ে বেড়ালেন।
অবশেষে তিনি উপলদ্ধি করলেন যে, তার কেবল
তিনটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দরকার। এগুলোর উত্তর পেলে তিনি তার প্রজ্ঞাময় দিকনির্দেশনা
পেয়ে যাবেন। সেই তিনটি প্রশ্ন ছিল:
১. কখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়?
২. কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি?
৩. কোন জিনিসটা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
মূল গল্পের প্রায় সবটুকু জুড়ে ছিল এই
তিনটা প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের দীর্ঘ কাহিনী। অবশেষে তিনি এক সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে
সেই তিনটি উত্তর পেয়ে গেলেন। উত্তরগুলো কী ছিল বলে আপনার মনে হয়? দয়া করে প্রশ্নগুলো
আরেকবার দেখুন। আবার পড়া শুরু করার আগে একটু বিরতি নিয়ে ভাবুন।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি,
কিন্তু বেশির ভাগ সময় ভুলে যাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টি অবশ্যই ‘এখন’।
একমাত্র এই সময়টাই আমাদের কাছে আছে। তাই আপনি যদি আপনার বাবা মাকে বলতে চান, আপনি তাদেরকে
সত্যিই কতখানি ভালোবাসেন, তাদেরকে বাবা মা হিসেবে পেয়ে আপনি কতখানি কৃতজ্ঞ, এখুনি বলে
ফেলুন সেটি। আগামীকাল নয়। পাঁচ মিনিট পরে নয়। এখনই। পাঁচ মিনিট হয়তো অনেক দেরি হয়ে
যাবে।
যদি সঙ্গি বা সঙ্গিনীর কাছে দুঃখ প্রকাশের
কোন কিছু থাকে, তো এতদিন কেন করেন নি, তার অজুহাতের তালিকা নিয়ে ভাবতে বসবেন না যেন।
অজুহাত বাদ দিয়ে এখুনি তা প্রকাশ করুন। সুযোগ আর নাও মিলতে পারে। এই মুহুর্তকে ধরে
ফেলুন।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা খুবই গভীর।
খুব কম লোকই সঠিক উত্তরটা ধরতে পারে। যখন আমি ছাত্র অবস্থায় উত্তরটা পড়েছিলাম, এটি
অনেকদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল। আমি কল্পনাও করি নি, এই প্রশ্নের উত্তরটা এত
গভীর হবে। উত্তরটা হচ্ছে, আপনি যার সাথে আছেন সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
আমার মনে পড়ে, আমি কলেজের প্রফেসরদেরকে
অনেক প্রশ্ন করেছি, কিন্তু আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে নি কেউই। তারা বাইরে শোনার ভাব
দেখাচ্ছিল বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা চাচ্ছিল আমি যেন চলে যাই। নিজেকে তখন খুব পচা
মনে হয়েছিল। আমার আরো মনে পড়ে, সাহস নিয়ে এক বিখ্যাত লেকচারারকে প্রশ্ন করতে গিয়েছিলাম,
তাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার জন্য। রীতিমত অবাক ও খুশি হয়ে দেখলাম যে, তিনি আমার
প্রতি তার পুরো মনোযোগ ঢেলে দিয়েছেন। অন্য প্রফেসরেরা তার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা
করছিলেন, আর আমি ছিলাম লম্বা ঝাঁকড়া চুলের সামান্য এক ছাত্র। অথচ তিনি আমাকেই গুরুত্বপূর্ণ
ভাবতে দিলেন। পার্থক্যটা ছিল বিশাল।
যোগাযোগ ও ভালোবাসা ভাগাভাগি করা যায়
কেবল তখনই, যখন সেই মুহুর্তের জন্য আপনার সাথে থাকা ব্যক্তি, সে যেই হোক না কেন, সারা
পৃথিবীতে আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠে। তারা এটা অনুভব করে। তারা
এটা জানে। তারা এতে সাড়া দেয়।
বিবাহিত দম্পতিরা প্রায়ই অভিযোগ করে যে
তাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনী তাদের কথা আর মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। তারা যা বুঝাতে চায় তা
হলো, তাদের সঙ্গীরা আর তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অনুভূতিটা এনে দেয় না। পারস্পরিক
সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই
সম্রাটের
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা স্মরণ রাখা উচিত, আর সেটাকে কাজে লাগানো উচিত। আমরা যতই ক্লান্ত
বা ব্যস্ত থাকি না কেন, যখন আমরা সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সাথে থাকি, তখন তাদের সাথে এমন
আচরণ করা উচিত, যেন সেই মুহুর্তে তারাই আমাদের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
প্রত্যেকেই যদি এমন করতো, তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের উকিলদেরকে তাদের উকিলগিরি বাদ দিয়ে
অন্য পেশা দেখতে হতো।
ব্যবসাতে যখন আমরা কোন সম্ভাব্য ক্রেতার
সাথে থাকি, তখন যদি আমরা তাদের সাথে সেই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ব্যবহার
করি, তাহলে আমাদের বিক্রি আরো বাড়বে, সেই সাথে বাড়বে আমাদের বেতনও।
মূল গল্পে সম্রাট সেই সন্ন্যাসীর সাথে
দেখা করতে যাওয়ার পথে, একটা ছোট্ট বালকের উপদেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে আততায়ীর হাত থেকে
বেঁচে গিয়েছিলেন। এমন পরাক্রমশালী সম্রাট যখন একজন সামান্য বালকের সাথে থাকেন, সেই
বালক তখন তার জন্য জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর সেটাই সম্রাটের জীবন বাঁচিয়েছিল।
যখন দীর্ঘদিন পরে বন্ধুরা তাদের সমস্যাগুলো বলার জন্য আমার কাছে আসে, আমি সম্রাটের
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা স্মরণ করি আর তাদেরকে পূর্ণ গুরুত্ব দিই। এটাই নিঃস্বার্থতা।
দয়া ও মৈত্রী এতে শক্তি যোগায় এবং এতে কাজ হয়।
সেইশিক্ষাবিষয়ক সেমিনারের আয়োজক মহিলা,
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সে যে শিশুদেরকে সাহায্য করতে চাচ্ছিল তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল,
আর চর্চা করেছিল সেই নীতি, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, আপনি এখন যার সাথে
আছেন।’ সেই শিশুদের অনেকের জন্য সেটাই ছিল প্রথমবার, যখন তারা নিজেকে
গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে, বিশেষ করে তাও একজন প্রভাবশালী প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সামনে।
তাদেরকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে সে তখন পুরোপুরি
তাদের কথা শুনেছিল। তাদেরকে বিচার করছিল না। শিশুদের কথা শোনা হলো। এবার পুরো কর্মসূচীটা
তাদের উপযোগী করে গড়ে তোলা হলো। শিশুরা নিজেদেরকে সম্মানিত ভাবলো আর কর্মসূচীটি সফল
হলো। আমার বক্তৃতাই মূল বক্তৃতা ছিল না। আমার পরে এক শিশু উঠে দাঁড়ালো বলার জন্য। সে
আমাদেরকে শোনালো তার পরিবারের ঝামেলার কথা, নেশা ও অপরাধজগতের কথা, কীভাবে এই কর্মসূচী
তার জীবনের আশা ফিরিয়ে এনেছে তার কথা। আর জানালো কীভাবে সে শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে
যাচ্ছে। শেষের দিকে আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল। ছেলেটার বক্তৃতাই হয়েছিল মূল বক্তৃতা।
আপনার জীবনের বেশিরভাগ সময় আপনি নিজেকে
নিয়েই থাকেন। অতএব, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যার সাথে আপনি থাকেন, সেটা হচ্ছে
আপনি নিজে। আপনার নিজেকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রচুর সময় আছে। সকালে ঘুম থেকে জেগে প্রথম
কাকে নিয়ে আপনি সচেতন হন? আপনার নিজেকে! আপনি কি কখনো বলেন, ‘শুভ সকাল আমি! ভালো একটা
দিন কাটুক!’? আমি কিন্তু বলি। ঘুমাতে যাওয়ার সময় কে সেই সর্বশেষ ব্যক্তি যার বিষয়ে
আপনি সচেতন থাকেন? সে তো আপনিই! আমি নিজেকে নিজে শুভরাত্রি জানাই। আমি আমার দিনের অনেক
ব্যক্তিগত সময়ে নিজেকে গুরুত্ব দিই। এটা কাজে দেয়।
সম্রাটের
তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, ‘কোন জিনিসটা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?’ এর উত্তর হচ্ছে যত্ন নেওয়া।
যত্ন নেওয়া মানে হচ্ছে সতর্ক হওয়া আর যত্নশীল হওয়া। উত্তরটা বুঝিয়ে দেয় যে, আমাদের
কাজের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা আসছে কোথা থেকে, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যত্ন নেওয়ার
মানেটা কয়েকটা গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে বলার আগে আমি সম্রাটের তিনটি
প্রশ্নোত্তর
একসাথে সংক্ষিপ্তাকারে লিখে নেব:
১. কখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়?- এখন।
২. কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি?-
আপনি যার সাথে আছেন সেই ব্যক্তি।
৩. কোন জিনিসটি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?-
যত্ন নেওয়া।
--------------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।