চতুর্থ অধ্যায়: রাগ ও ক্ষমা
#ক্ষমা
দিয়ে ঠান্ডা করা- ৬৭
যখন কেউ আমাদেরকে আঘাত দেয়, তখন তাকে
শাস্তি দেওয়ার কাজটা যে আমাদেরকেই করতে হবে, এমন নয়। আমরা যদি খ্রিস্টান, মুসলিম বা
ইহুদি হই, তাহলে আমরা কি নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি না যে, সৃষ্টিকর্তা তাকে যথেষ্ট
শাস্তি দেবেন? যদি আমরা বুড্ডিস্ট, হিন্দু বা শিখ হই, আমরা জানব যে, কর্ম নিশ্চয়ই আক্রমণকারীকে
তার কর্ম অনুসারে ফল দেবে। আর যদি আপনি আধুনিক মনোবিজ্ঞানের অনুসারী হন, তাহলে তো জানেন
যে আক্রমণকারীকে তার অপরাধবোধের চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক ব্যয়বহুল থেরাপি নিতে হবে প্রতি
বছর।
তাই ‘তাদেরকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া’টা
কেন আমরা করতে যাব? ভালোমতো বিচার বিবেচনা করলে দেখব যে আমাদের তা করার কোন দরকার নেই।
যখন আমরা রাগকে যেতে দিই, আর ক্ষমা দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিই, তখনো কিন্তু আমরা জনগণের প্রতি
আমাদের কর্তব্যগুলো পালন করে যাই প্রতিনিয়ত।
আমার দুজন পশ্চিমা বন্ধু তর্কাতর্কি করছিল।
এক ভিক্ষু ছিল প্রাক্তন ইউএস মেরিন সেনা, যে ভিয়েতনামে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং
গুরুতর আহত হয়েছিল। অন্যজন ছিল খুব সফল একজন ব্যবসায়ী, যে অল্প বয়সেই এত টাকা কামিয়েছিল
যে পঁচিশের কোঠায় এসে কাজকর্ম থেকে ‘অবসর’ নিয়েছিল। তারা দুজনই ছিল খুব চালাক,
শক্তসমর্থ, অত্যন্ত কঠিন চরিত্রের লোক।
ভিক্ষুদের তর্কাতর্কি করার কথা নয়, কিন্তু
তারা করছিল। ভিক্ষুদের ঘুষি মারামারি করার কথা নয়, কিন্তু তারা তা করতে যাচ্ছিল। তাদের
একজনের চোখ আরেকজনের চোখে স্থির, একজনের নাক আরেকজনের নাক স্পর্শ করছে, আগুনঝরা দৃষ্টি
দুজনেরই। এমন একটি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মাঝখানে প্রাক্তন মেরিন হঠাৎ করে হাঁটু গেড়ে
মাথা নিচু করে পরম শ্রদ্ধার সাথে সালাম করল বিস্মিত প্রাক্তন ব্যবসায়ী ভিক্ষুকে। এরপরে
সে মাথা তুলে বলল,
‘আমি দুঃখিত, আমাকে ক্ষমা করো।’
এটি
ছিল সেই দুর্লভ সদাচারগুলোর একটি যা আসে সরাসরি হৃদয় থেকে। যা কোন পরিকল্পনামাফিক নয়,
বরং সবসময় স্বতঃস্ফুর্ত ও অনুপ্রেরণাদায়ী। এ ধরনের কাজ দেখামাত্র চেনা যায় আর সেগুলো
হয় সম্পূর্ণ অপ্রতিরোধ্য।
প্রাক্তন ব্যবসায়ী ভিক্ষু কেঁদে ফেলল।
কয়েক মিনিট পরে তাদেরকে একসাথে বন্ধু হিসেবে হাঁটতে দেখা গেল। ভিক্ষুদের সেটাই করার
কথা।
#ইতিবাচক
ক্ষমা- ৬৮
আমি
আপনাদেরকে বলতে শুনি, ক্ষমা দিয়ে হয়তো বৌদ্ধ বিহারে কাজ হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে
এমন ক্ষমা দিলে আমাদের কাছ থেকে সুযোগ সন্ধানীরা সুবিধা আদায় করে নেবে। লোকজন আমাদেরকে
পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যাবে, তারা ভাববে আমরা দুর্বল। আমি এ বিষয়ে একমত। এমন ক্ষমায় কদাচিৎ
কাজ হয়। সেই প্রবাদটা আছে না, ‘একটা গালে চড় খেলে যে আরেকটা গাল এগিয়ে দেয়, তাকে একবার
নয়, দু দুবার ডেন্টিস্টের কাছে যেতে হয়।’
আগের গল্পে থাই সরকার নিঃশর্ত ক্ষমার
মাধ্যমে শুধু ক্ষমা নয়, এর থেকে বেশি কিছু করেছিল। এটি মূল কারণ দারিদ্র্যতাকেও খুঁজে
নিয়ে এটিকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছিল। একারণেই এমন ক্ষমায় কাজ হয়েছিল। আমি এমন
ক্ষমাকে বলি ‘ইতিবাচক ক্ষমা’। ‘ইতিবাচক’
মানে হচ্ছে, আমরা যে ভালো গুণগুলো দেখতে চাই, সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলা। ‘ক্ষমা’
মানে হচ্ছে , সমস্যার অংশ হিসেবে যে খারাপ গুণগুলো, সেগুলোকে যেতে দেওয়া, সেগুলো নিয়ে
পড়ে না থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, বাগানে শুধু আগাছাতে পানি দেওয়া মানে
সমস্যাগুলোকে বাড়ানো, পানি না দেওয়া মানে ক্ষমা প্র্যাকটিস করা, শুধুমাত্র ফুলগুলোতে
পানি দেওয়া কিন্তু আগাছাগুলো বাদে- এটি হচ্ছে ইতিবাচক ক্ষমা।
প্রায় দশ বছর আগে পার্থে এক শুক্রবার
সন্ধ্যায় ধর্মদেশনা শেষে একজন মহিলা আমার সাথে কথা বলতে এগিয়ে এল। আমি যতদূর মনে করতে
পারি, আমাদের সবগুলো সাপ্তাহিক দেশনাতেই তার নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এই প্রথম
সে আমার সাথে কথা বললো। সে বললো যে সে একটা বড় ধন্যবাদ দিতে চায়, কেবল আমাকে নয়, আরো
অন্যান্য ভিক্ষুদেরকেও, যারা এই বিহারে দেশনা দিয়েছে। এরপরে সে এর কারণ ব্যাখ্যা করল।
সে আমাদের বিহারে আসা শুরু করে সাত বছর আগে থেকে। সে স্বীকার করল যে বৌদ্ধ ধর্ম বা
ধ্যান সম্পর্কে তার মোটেও কোন আগ্রহ ছিল না। তার এখানে আসার প্রধান কারণ ছিল বাসা থেকে
বের হওয়ার একটা অজুহাত দেখানো।
মহিলাটি ভীষণ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার
ছিল। তার স্বামী তাকে বাসায় প্রচন্ড নির্যাতন করত। সেই সময়ে এ ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের
শিকার যারা, তাদেরকে সাহায্য করার মতো কোন সহায়ক প্রতিষ্ঠান ছিল না। এমন পরিবেশে সে
বেরিয়ে আসার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই সে আমাদের বুড্ডিস্ট সেন্টারে আসতো এই ভেবে
যে, এখানে দুই ঘন্টা কাটালে সেই দুই ঘন্টা অন্তত নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচা যাবে।
আমাদের বিহারে এসে সে যা শুনলো, তা তার
জীবনটাকে বদলে দিল। সে ভিক্ষুদের কাছ থেকে শুনল ইতিবাচক ক্ষমার কথা। সে এটা তার স্বামীর
উপর চেষ্টা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। সে আমাকে বলেছিল যে, প্রতিবার যখন তার স্বামী
তাকে মারত, সে তাকে ক্ষমা করে যেতে দিত। কীভাবে সে এটা করত, কেবল সেই জানে। প্রত্যেক
বারে তার স্বামীর যে কোন সদয় কাজ ও কথায়, তা যতই নগণ্য হোক না কেন, সে তাকে জড়িয়ে ধরতো,
চুমু দিতো অথবা এমন কোন ইশারা করে তাকে জানিয়ে দিতো এমন দয়া তার কাছে কতটুকু বিশাল।
সে কোনকিছুকেই নিয়তি বলে মেনে নেয় নি।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে বলেছিল
যে, দীর্ঘ সাত বছর লেগেছে তার এ কাজে সফল হতে। এ পর্যায়ে তার চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে এসেছিল।
আমারও চোখ ভিজে গিয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল, ‘সাতটি দীর্ঘ বছর। এখন আপনি তাকে চিনতেও
পারবেন না। সে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমাদের মাঝে এখন খুব মূল্যবান ভালোবাসার সম্পর্ক
বিরাজ করছে, আর আছে দুটো ফুটফুটে সন্তান।’ তার মুখ সন্ন্যাসীদের মতো আভা ছড়াচ্ছিল।
আমার মনে হচ্ছিল হাঁটু গেড়ে তাকে সম্মান জানাই। সে আমাকে থামিয়ে বললো, ‘এই টুলটা দেখেছেন?
এই সপ্তাহে সারপ্রাইজ হিসেবে সে আমাকে এই কাঠের টুলটা বানিয়ে দিয়েছে ধ্যান করার জন্য।
সাত বছর আগে হলে সে এটা দিয়ে আমাকে পেটাতো।’ আমরা একসাথে হেসে উঠলাম।
আমি এই মহিলার প্রশংসা করি। সে তার নিজের
সুখ নিজেই অর্জন করেছে। যা তার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে অসামান্য-ই বলতে হয়। সে একটা
দানবকে যত্নশীল মানুষে পরিণত করেছে। সে আরেকজন মানুষকে সাহায্য করেছে, দারুণভাবে সাহায্য
করেছে। এটা ইতিবাচক ক্ষমার একটা চরম উদাহরণ। যারা সাধুসন্তের পথ ধরেছে, তাদের জন্য
আমি এমনই করার সুপারিশ করি। এত কিছু বাদেও, এটি আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়, যখন ক্ষমার সাথে
ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণাও যুক্ত হয়, তখন কী অর্জন করা যায়।
-------------------চতুর্থ
অধ্যায় শেষ-----------------
---------------চলমান
---------------চলমান
Good collection
উত্তরমুছুনধন্যবাদ, আপনার গুরুত্বপূর্ণ কমেন্টের জন্য
উত্তরমুছুনআমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।