অপরাধবোধ ও তা থেকে মুক্তি || হৃদয়ের দরজা খুলে দিন


প্রথম অধ্যায়: পরিপূর্ণতা ও অপরাধবোধ

#অপরাধবোধ ও তা থেকে মুক্তি- ১২
কয়েক বছর আগে এক অস্ট্রেলিয়ান তরুণী পার্থে আমাদের বিহারে আসল আমার সাথে দেখা করতে। ভিক্ষুদেরকে প্রায়ই খোঁজা হয় লোকজনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে পরামর্শ চাওয়ার জন্য, এর কারণ সম্ভবত আমরা খুব সস্তা। আমরা পরামর্শ দিই, কিন্তু বিনিময়ে কোন ফি দাবি করি না। তো, অপরাধবোধে সেই তরুণীর হৃদয় ভারাক্রান্ত ছিল। ছয় সাত মাস আগে, সে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উত্তর প্রান্তে একটি প্রত্যন্ত খনি অঞ্চলে কাজ করত। কাজটি পরিশ্রমের হলেও টাকা ভালোই দিত। তবে কাজের সময়ের পরে করার মতো তেমন কিছু থাকতো না। তাই সে এক রবিবার বিকেলে তার সেরা বান্ধবী এবং তার বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডকে বললো, গাড়িতে করে একটু বের হলে কেমন হয়। তার বান্ধবী যেতে চাচ্ছিল  না, ছেলেটাও নয়, কিন্তু একা গিয়ে তো আর মজা নেই। যতক্ষণ না তারা রাজি হল, ততক্ষণ পর্যন্ত সে মিষ্টি কথায় তাদেরকে ভোলানোর চেষ্টা করল, তর্ক করল, আর প্যানপ্যানানি চালিয়ে গেল। কিন্তু যাওয়ার পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঝুরঝুরে নুড়ি পাথরে গাড়িটি স্লিপ করে গড়িয়ে গেল। তার বান্ধবী মারা গেল আর বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডটি পঙ্গু হয়ে গেল। বেড়াতে যাওয়ার বুদ্ধিটা ছিল তরুণীটির, কিন্তু তার কিছু হয় নি। সে আমাকে বেদনাভরা চোখে বললো ‘আমি যদি তাদেরকে যাওয়ার জন্য জোর না করতাম, তাহলে সে এখনো এখানে বেঁচে থাকতো। তার বয়ফ্রেন্ডের এখনো পা থাকতো। আমার তাদেরকে জোর করা উচিত হয় নি। আমার খুব খারাপ লাগে। আমি নিজেকে এমন অপরাধী বলে বোধ করি।

আমার মনে যে প্রথম চিন্তাটা আসলো তা ছিল তাকে আশ্বস্ত করা যে এটা তার দোষ নয়। সে তো আর দুর্ঘটনার পরিকল্পনা করে নি। তার বন্ধুদেরকে আহত করারও কোন ইচ্ছে তার ছিল না। এমন ঘটনা ঘটে। এটাকে যেতে দাও। নিজেকে অপরাধী ভেবো না। কিন্তু আরেকটা চিন্তা মাথায় আসল, ‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে এই কথাটা সে এর আগে শতবার শুনেছে, আর দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতে কাজ হয় নি। তাই আমি একটু সময় নিলাম, তার অবস্থাকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলাম, এরপর আমি তাকে বললাম, ভালো যে তুমি নিজেকে অপরাধী মনে করছো।
তার মুখের চেহারায় বেদনা থেকে বিস্ময় দেখা দিল, আর বিস্ময়ের পরে এল স্বস্তি। নিজেকে অপরাধী ভাবা উচিত- এমন কথা সে এর আগে শোনেনি। আমার অনুমান ঠিক ছিল। তার অপরাধবোধের জন্য সে নিজেকে অপরাধী ভাবত। অথচ অন্যরা তাকে বলতো, নিজেকে অপরাধী ভেবো না। এতে সে দ্বিগুণ ‘অপরাধী মনে করত নিজেকে: যার একটা হচ্ছে দুর্ঘটনার জন্য, আরেকটা হচ্ছে নিজেকে অপরাধী ভাবার জন্য। আমাদের জটিল মন এভাবেই কাজ করে।
আমরা যখন প্রথম স্তরের অপরাধবোধ নিয়ে কাজ করলাম আর নিজেকে অপরাধী ভাবাটাই সঠিক বলে মেনে নিলাম, কেবল তখনই সমাধানের দ্বিতীয় ধাপে এগোনো গেল: এবার এটা নিয়ে কী করা যায়?
একটা বৌদ্ধ প্রবাদ আছে: ‘অন্ধকার নিয়ে অভিযোগ না করে বরং একটা মোমবাতি জ্বালাও।
মন খারাপ করার বদলে সবসময়ই আমরা একটা কিছু করতে পারি, সেই একটা কিছু যদি হয় অভিযোগ না করে শুধু শান্তভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকা, সেটাও সঠিক একটা কাজ। অনুশোচনা থেকে অপরাধবোধ যথেষ্ট ভিন্ন। আমাদের সংস্কৃতিতে ‘অপরাধী হচ্ছে আদালতের বিচারকের দ্বারা শক্ত কাঠের উপরে হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে বের করা রায়। আর যদি কেউ আমাদেরকে শাস্তি না দেয়, আমরা নিজেদেরকে শাস্তি দেওয়ার পথ খুঁজি, এক পথে না হয় অন্য পথে। অপরাধবোধ হচ্ছে আমাদের মনের গভীরের শাস্তি।
তাই তরুণীটির অপরাধবোধ থেকে মুক্তির জন্য দরকার ছিল প্রায়শ্চিত্ত। ভুলে যেতে বলা আর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বলাতে কাজ হতো না। আমি পরামর্শ দিলাম যে সে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর পুনর্বাসন শাখায় স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে পারে, গাড়ি দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা করতে পারে। আমি চিন্তা করেছিলাম, সেখানে কঠোর শ্রম দিয়ে সে তার অপরাধবোধকে ক্ষয় করতে পারবে আর সেই সাথে, স্বেচ্ছাশ্রমে সাধারণত যেমন হয়, সে যাদের সাহায্য করতে সেখানে কাজ করবে, তারাই উল্টো তাকে নিজেকে ফিরে পেতে বেশি করে সাহায্য করবে।

--------------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !