হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-২৮) ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়: কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান


#জীবনের জন্য উপদেশ- ৯৪
উপরের গল্পে বাঘ ও সাপ যখন উভয়েই মরে গেল, এখন লোকটার কিছু একটা করার সময়। সে মধুর উপভোগ করা থামিয়ে, চেষ্টা চালিয়ে কুয়োর উপরে উঠে এল, আর নিরাপদে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। জীবনটা যে সবসময় শুধু কিছু না করে মধু উপভোগ করার, তাও নয়।
সিডনির একজন তরুণ আমাকে বলেছিল যে, সে একবার থাইল্যান্ডে গিয়ে আমার গুরু আজান চাহ্-র সাথে দেখা করেছিল আর জীবনের সেরা উপদেশটি লাভ করেছিল তার কাছ থেকে। বৌদ্ধ ধর্মে আগ্রহী অনেক পশ্চিমা তরুণ ১৯৮০ সালের দিকে আজান চাহ্-র নাম শুনেছিল। এই তরুণটি থাইল্যান্ডে একটা লম্বা ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিল। উদ্দেশ্য একটাই, সেই মহান ভিক্ষুর সাথে দেখা করবে এবং তাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে।
এটা ছিল দীর্ঘ সফর। সিডনি থেকে ব্যাংককে পৌঁছাতে তার আট ঘন্টা লাগলো। সেখান থেকে রাতের ট্রেনে আরো দশ ঘন্টা লাগলো উবন শহরে পৌঁছাতে। সেখানে পৌঁছে সে আজান চাহ্-র বিহার ওয়াট পাহ্ পং এ যাওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সি ভাড়া করল। ক্লান্ত কিন্তু উজ্জীবিত, সে অবশেষে আজান চাহ্র কুটিরে পৌঁছল।
গুরু হিসেবে আজান চাহ্ ছিলেন বিখ্যাত। তিনি বরাবরের মতোই তার কুটিরে বসে ছিলেন। তার চারপাশে ঘিরে ছিল অনেক ভিক্ষু ও জেনারেল, গরীব কৃষক ও ধনী ব্যবসায়ী, গ্রামের ছেঁড়া কাপড় পরা মেয়ে ও ব্যাংককের সুন্দর পোশাকের মহিলা, সবাই পাশাপাশি বসা। আজান চাহ্-র কুটিরে কোন বৈষম্য নেই।
অস্ট্রেলিয়ানটা সেই বিরাট জনতার একধারে বসে পড়ল। দুঘন্টা কেটে গেল। আজান চাহ্ তাকে খেয়ালও করেন নি। তার সামনে আরো অনেক লোক। হতাশ হয়ে সে উঠে চলে গেল সেখান থেকে।
বিহারের প্রধান গেটে যাওয়ার সময় সে দেখল ঘন্টা বাজানোর মন্দিরে কিছু ভিক্ষু উঠোন ঝাড় দিচ্ছে। গেটে তাকে নিতে আসবে যে ট্যাক্সিটা, সেটা আসতে আরো ঘন্টাখানেক বাকি। তাই সেও হাতে একটা ঝাড় তুলে নিল এই ভেবে যে অন্তত কিছু পুণ্যকর্ম করে যাই।
প্রায় আধা ঘন্টা পরে, সে যখন ঝাড় দিতে ব্যস্ত, অনুভব করলো যে কেউ একজন তার কাঁধে হাত রাখলো। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক ও যারপরনাই খুশি হয়ে দেখলো যে হাতের মালিক আজান চাহ্ তার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আজান চাহ্ এই পশ্চিমা তরুণটিকে দেখেছিলেন আগেই, কিন্তু তাকে সেটা বলার কোন সুযোগ তখন ছিল না। এখন তিনি আরেকটা কাজে বিহারের বাইরে চলে যাচ্ছেন, তাই তিনি এত কষ্ট করে সিডনি থেকে আসা এই তরুণের সামনে একটু দাঁড়ালেন তাকে একটা উপহার দেওয়ার জন্য। তিনি থাই ভাষায় দ্রুত কিছু একটা বলে তার কাজে চলে গেলেন।
এক অনুবাদক ভিক্ষু তাকে বলে দিল, ‘আজান চাহ্ বলেছেন যে, যদি তুমি ঝাড় দাও, তো তোমার যা কিছু আছে, তার সবকিছু নিয়েই ঝাড় দাও। এরপর সেই অনুবাদক ভিক্ষুও গিয়ে আজান চাহ্র সাথে যোগ দিল।
তরুণটি অস্ট্রেলিয়া ফেরার দীর্ঘ যাত্রায় সেই ছোট্ট শিক্ষাটা নিয়ে ভাবলো। সে নিশ্চিত বুঝতে পারলো যে, আজান চাহ্ তাকে শুধু কীভাবে ঝাড় দিতে হয় তা শেখান নি, বরং এর থেকে ঢের বেশি শেখাতে চেয়েছেন। এর অর্থটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
‘তুমি যাই করো না কেন, তোমার সবকিছু নিয়েই সেটি করো।
সে অস্ট্রেলিয়া ফেরার কয়েক বছর পরে আমাকে বলেছিল যে, এই ‘জীবনের উপদেশ ছিল এমন শতবার দীর্ঘ সফরের মূল্যের সমান। এটাই এখন সে মেনে চলে এবং এটা তাকে সুখ ও সফলতা এনে দিয়েছে। যখন সে কাজ করত, সে তার সবকিছু ঢেলে দিত তার কাজে। সে যখন বিশ্রাম নিত, তার সবকিছু নিয়েই সে বিশ্রাম নিত।
যখন সে সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকত, সে তার সবকিছু সমাজের কাজে ঢেলে দিত। এটা ছিল সফলতার মন্ত্র। আর আরেকটা কথা, যখন সে কিছুই করতো না, সে তার যা কিছু আছে, কোনকিছুই সেখানে দিত না।

#কোন সমস্যা?- ৯৬
ফরাসি দার্শনিক গণিতজ্ঞ ব্লেইস প্যাসকেল (১৬২৩-৬২) একবার বলেছিলেন: ‘মানুষের যত ঝামেলা আসে কীভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকতে হয় তা না জানা থেকে। আমি এর সাথে আরো যোগ করব: ‘... আর কখন শান্ত হয়ে বসে থাকতে হয় তা না জানা থেকে।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল তখন মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। সেই যুদ্ধ, যা পরবর্তীকালে ‘ছয়দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করে, তার মাঝামাঝি সময়ে এক সাংবাদিক প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলানকে জিজ্ঞেস করেছিল যে মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাটা সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন।
কোন ইতস্তত ছাড়াই, এই বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিক উত্তর দিলেন- ‘মধ্যপ্রাচ্যে কোন সমস্যা নেই। সাংবাদিক তো হতভম্ব। ‘মধ্যপ্রাচ্যে কোন সমস্যা নেই মানে কী বলতে চান আপনি?’ সে জানতে চাইল। ‘আপনি কী জানেন না সেখানে এখন ঘোরতর যুদ্ধ চলছে? আপনি কী বুঝতে পারছেন না, এই যে আমরা কথা বলছি, ঠিক এসময়ে সেখানে আকাশ থেকে বোমা পড়ছে, ট্যাঙ্কগুলো বোমা মেরে একটা আরেকটাকে উড়িয়ে দিচ্ছে, সৈন্যরা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে? ইতিমধ্যে অনেক লোক হতাহত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে কোন সমস্যা নেই বলতে আপনি কী বুঝাতে চান?’
অভিজ্ঞ রাজনীতিক ধৈর্য্য সহকারে ব্যাখ্যা করলেন, ‘স্যার, সমস্যা হচ্ছে এমন একটা কিছু, যার সমাধান আছে। মধ্যপ্রাচ্যের কোন সমাধান নেই। অতএব এটা কোন সমস্যাই হতে পারে না।
আমাদের জীবনে আমরা কত সময় নষ্ট করি সেসব জিনিসের কথা ভেবে ভেবে, যেগুলোর আসলে সেই মুহুর্তে কোন সমাধান নেই, তাই সেগুলো কোন সমস্যাই নয়?


                                                                                                                                   -------------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !