হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-৩৭) সপ্তম অধ্যায়


`সপ্তম অধ্যায়: প্রজ্ঞা ও অন্তরের নিরবতা

#যা প্রজ্ঞা নয়- ১২০
কয়েক বছর আগে থাই ভিক্ষুদের নিয়ে কয়েকটি কেলেঙ্কারির কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছিল। নিয়ম অনুসারে, ভিক্ষুদেরকে কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। আমি যে ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত, তাতে ভিক্ষুরা কোন মহিলাকে শারীরিক স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারে না। কৌমার্যব্রত সম্পর্কে যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ না থাকে। ভিক্ষুণীদেরও কোন পুরুষকে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। সংবাদ মাধ্যমে যে সমস্ত কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোতে বলা হয়েছিল যে কিছু কিছু ভিক্ষু তাদের নিয়ম রক্ষা করে নি। তারা ছিল দুষ্ট ভিক্ষু। সংবাদমাধ্যমগু লো জানত যে তাদের পাঠকরা দুষ্ট ভিক্ষুদের সম্বন্ধে আগ্রহী। বিরক্তিকর, নিয়ম পালনকারী ভিক্ষুদের সম্বন্ধে নয়।
এসব ঘটনার সময় আমি মনে করলাম, আমার নিজেরও এই বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেওয়া উচিত। তাই এক শুক্রবার সন্ধ্যায় পার্থে আমাদের বিহারে প্রায় তিনশত লোকের সামনে, তাদের অনেকেই ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের সমর্থক, তাদের সামনে এই সত্যটা তুলে ধরার সাহস সঞ্চয় করলাম।
‘আমার একটা স্বীকারোক্তি দেওয়া দরকার,’ আমি শুরু করলাম, ‘যদিও কথাটা সহজ নয়। কয়েক বছর আগে...’ আমি বলতে গিয়ে ইতস্তত করলাম।
‘... কয়েক বছর আগে,’ আমি কোনমতে বলতে লাগলাম, ‘আমি আমার জীবনের কয়েকটা সবচেয়ে সুখময় মুহুর্ত কাটিয়েছি..’ আমাকে আবার একটু থামতে হলো, ‘আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় মুহুর্তগুলো কাটিয়েছিলাম... অন্য এক লোকের স্ত্রীর ভালেবাসাময় আলিঙ্গনের মধ্যে। আমি সেটা বলে ফেললাম। আমি স্বীকারোক্তি দিলাম।
‘আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আদর দিয়েছিলাম, চুমু দিয়েছিলাম।‘ আমি কথা বলা শেষ করে মাথা হেঁট করে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম বিস্ময়ে শ্রোতাদের মুখ দিয়ে বাতাস টেনে নেয়ার শব্দ। হতবাক হয়ে যাওয়া মুখে হাত চাপা দেওয়ার অস্ফুট শব্দ। কয়েকটা ফিসফিস কথা শুনলাম, ‘না! না! আজান ব্রাহ্ম হতে পারেন না। আমি কল্পনা করলাম অনেক দীর্ঘদিনের সমর্থকও দরজার দিকে হাঁটা ধরেছে, আর কখনো ফিরবে না তারা। গৃহী বৌদ্ধরাও তো অন্যজনের স্ত্রীর সাথে যায় নি। এ যে রীতিমত ব্যভিচার! আমি মাথা তুলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম।
‘সেই মহিলা,’ আমি কেউ দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ব্যাখ্যা করলাম, ‘সেই মহিলাটি ছিল আমার মা। আমি তখন শিশু ছিলাম। আমার শ্রোতারা হাসিতে ফেটে পড়ল আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
এটা সত্যিই তো!’ আমি হই হুল্লোড়ের মাঝে মাইক্রোফোনে চিৎকার করলাম, ‘সে ছিল অন্যজনের স্ত্রী। আমার বাবার স্ত্রী। আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আদর দিয়েছিলাম, চুমু দিয়েছিলাম। সেগুলো ছিল আমার জীবনের কয়েকটা সুখী মুহুর্ত!’
শ্রোতাদের চোখের পানি মোছার পালা শেষ হলে আর হাসির পর্ব সমাপ্ত হলে আমি দেখিয়ে দিলাম যে তাদের প্রায় সবাই আমাকে বিচার করেছে, ভুলভাবে বিচার করেছে। যদিও তারা আমার নিজের মুখ থেকেই শুনেছে কথাগুলো। আর কথাগুলো ব্যাখ্যাতীতভাবে সুস্পষ্ট ছিল। তবুও তারা ভুল সিদ্ধান্তটাকেই গ্রহণ করেছিল। সৌভাগ্যবশত, অথবা বলা যায়, খুব প্ল্যান মাফিক বলেছি বলেই, আমি তাদেরকে ভুলটা ধরিয়ে দিতে পেরেছি। ‘কত বার,’ আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘কতবার আমাদের এমন সৌভাগ্য হয় নি আর সরাসরি এমন সব  উপসংহারে পৌঁছে গেছি, যা পরিস্থিতি দেখে খুব সত্যি বলে মনে হলেও আসলে কেবল ভুল, মারাত্মকভাবে ভূল একটা উপসংহার ছিল?’
এটাই সঠিক, বাকি সব ভুল,’ এভাবে সবকিছু বিচার করাটা প্রজ্ঞা নয়।

#খোলা মুখের বিপদ - ১২২
আমাদের রাজনীতিবিদদের খোলাখুলি হওয়া নিয়ে বেশ খ্যাতি আছে। বিশেষ করে তাদের নাক ও থুতনির মাঝখানের অংশটা খোলাই থাকে। এটা বহু শতাব্দী ধরেই একটা ঐতিহ্য হিসেবে চলে আসছে। বৌদ্ধ জাতক কাহিনী থেকে আমরা নিচে এমন একটা গল্পের নমুনা পাই।
বহু শতাব্দী আগে এক রাজা তার এক মন্ত্রীকে নিয়ে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। রাজদরবারে যখনই কোন বিষয়ে আলোচনা শুরু হতো, এই মন্ত্রী সেখানেই তার বক্তৃতা শুরু করে দিতো, যা মনে হতো এই জনমেও শেষ হবার নয়। তার কথার মাঝে কেউই কথা বলার সুযোগ পেত না, এমনকি স্বয়ং রাজাও নয়। অধিকন্তু মন্ত্রী যা বলতো তা এমন নিরস ছিল যে পিংপং বলের ভেতরটা দেখাও এর থেকে অনেক মজার বলে মনে হতো।
এমন একটা বিফল আলোচনার পরে, রাজা তার রাজদরবার থেকে দূরে শান্তিতে থাকার জন্য একটা বাগানে চলে গেলেন। বাগানের একটা জায়গায় একদল ছোট ছেলেমেয়ে উৎসাহভরে একটা মধ্যবয়স্ক পঙ্গু লোকের চারপাশে জড়ো হয়েছিল। ছেলেমেয়েরা তাকে কয়েকটা পয়সা দিয়ে একটা পাতাবহুল গাছ দেখিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে মুরগী চাইল। লোকটি তার ব্যাগ থেকে গুলতি ও নুড়ি পাথর বের করে গাছটির দিকে গুলতি ছুঁড়তে শুরু করল।
সে দ্রত গুলতি ছুঁড়ে গাছের পাতাগুলো ছেঁটে দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে গাছটিকে দেখতে মুরগীর মতো করে ফেলল। ছেলেমেয়েরা তাকে আরো কয়েকটা পয়সা দিল। একটা বড় ঝোপ দেখিয়ে দিয়ে হাতি চাইল। লোকটি গুলতি ছুঁড়ে দ্রুত ঝোপটিকে হাতির আকৃতি দিয়ে দিল। ছেলেমেয়েরা খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল আর রাজা একটা আইডিয়া পেয়ে গেলেন।
রাজা পঙ্গু লোকটার কাছে গিয়ে তাকে প্রস্তাব দিলেন, তিনি তাকে স্বপ্নেরও অতীত ধনী বানিয়ে দেবেন যদি সে একটা ছোট্ট বিরক্তিকর সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। রাজা লোকটার কানে কানে ফিসফিস করে বলে দিলেন কী করতে হবে। লোকটি রাজি হয়ে মাথা ঝাঁকাল। রাজার মুখে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মতো হাসি ফুটে উঠল।
পরের দিন সকালে স্বাভাবিক নিয়মেই রাজদরবারের কাজ আরম্ভ হলো। একপাশের দেয়ালে যে নতুন পর্দা ঝোলানো হয়েছে তা কেউ লক্ষ করলো না। সরকার করের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। রাজা যেই না আলোচ্য বিষয়টি বলে দিলেন, অমনি সেই মুখ চালু মন্ত্রী তার একক বক্তব্য শুরু করলো। বলার জন্য মুখ খুলতেই সে অনুভব করলো ছোট ও নরম কী যেন একটা গলায় ঢুকে গেল, আর পাকস্থলীতে নেমে গেল। সে তার বক্তব্য চালিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে নরম ও ছোট্ট কী যেন আবার মুখে ঢুকে গেল। সে এটাকে গিলে ফেলে আবার তার বক্তব্য শুরু করল। বক্তব্যের মাঝে মাঝে সে এভাবে বার বার গিলতে বাধ্য হলো কিন্তু তাতে তার বলা থামলো না। আধা ঘন্টা ঝাড়া বক্তৃতার পরে কয়েক সেকেন্ড পর পর কী যেন গিলতে গিলতে সে খুব, খুব বমি বমি ভাব অনুভব করলো। কিন্তু এমন একগুঁয়ে ছিল সে, যে তবুও তার বক্তৃতা থামল না। কয়েক মিনিট পরে তার মুখ রোগগ্রস্ত সবুজ রঙের হয়ে উঠলো। তার পেট বমির জন্য মোচড় দিয়ে উঠলো এবং অবশেষে সে তার বক্তৃতা শেষ করতে বাধ্য হলো। একহাতে পেট, আরেক হাতে মুখ চেপে ধরে সে ছুটলো কাছাকাছি কোন বাথরুমের খোঁজে।
আনন্দিত রাজা পর্দাটা টেনে দিয়ে পঙ্গু লোকটিকে বের করে আনলেন যে গুলতি ও এক ব্যাগ গোলাবারুদ নিয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। রাজা সেই বিরাট ও প্রায় খালি ব্যাগটি দেখে অদম্য হাসিতে ফেটে পড়লেন। ব্যাগটা ছিল মুরগীর বিষ্ঠাতে পূর্ণ যা বেচারা মন্ত্রীর খোলা মুখ লক্ষ্য করে নিখুঁতভাবে গুলতির সাহায্যে ছুঁড়ে মারা হয়েছে পর্দার আড়াল থেকে।
সেই মন্ত্রী দরবারে কয়েকসপ্তাহ ধরে আসলো না। তার অবর্তমানে অনেক অসমাপ্ত আলোচনা শেষ করা গেল। যখন সে ফিরল, তখন সে বলতে গেলে একটা শব্দও বলল না। আর যখন তাকে বলতে হতো, সে সবসময় তার ডান হাতটা মুখের সামনে ধরে রাখতো।
সম্ভবত, এই যুগের সংসদগুলোতে এমন নিখুঁত গুলতি নিক্ষেপকারী থাকলে অনেক কাজ হয়ে যেতো।
                                                                                                                              -------------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !