`সপ্তম অধ্যায়: প্রজ্ঞা ও অন্তরের নিরবতা
#বাচাল
কচ্ছপ - ১২৪
হয়তো আমাদের জীবনের শুরুতেই নিরব থাকতে
শেখা উচিত। এটা পরবর্তীতে অনেক ঝামেলা এড়াতে সাহায্য করতে পারে। যেসব ছেলেমেয়ে আমাদের
বিহারে আসে, আমি তাদেরকে নিরব থাকার গুরুত্বটা বুঝাতে গিয়ে নিজের গল্পটা বলি।
অনেক দিন আগের কথা। কোন এক পাহাড়ের পাদদেশে
এক হ্রদে বাস করত এক বাচাল কচ্ছপ। যখনই তার অন্য কোন প্রাণীর সাথে পরিচয় হতো, সে তাদের
সাথে এত বেশি কথা বলতো, আর এত দীর্ঘ সময় ধরে এবং বিরতিহীনভাবে কথা বলতো, যে তার শ্রোতারা
বিরক্ত হতো, এরপরে অধৈর্য্য হয়ে যেত। তারা প্রায়ই অবাক হত, কী করে এই বাচাল কচ্ছপ কোন
দম না নিয়েই এত দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলে! তারা ভাবত, সে নিশ্চয়ই কান দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়,
কেননা সে কখনোই তার কানগুলোকে শোনার জন্য ব্যবহার করে না। সে এমন বাচাল ছিল যে তাকে
আসতে দেখলেই খরগোশগুলো তাদের গর্তে ঢুকে যেত, পাখিরা গাছের মাথায় উড়ে যেত, মাছেরা পাথরের
আড়ালে লুকিয়ে যেত। তারা জানত যে বাচাল কচ্ছপটা তাদের সাথে কথা বলা শুরু করলে তারা সেখানে
ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে যাবে। বাচাল কচ্ছপটা আসলে কিছুটা একা ছিল।
প্রতি বছর গ্রীস্মে এক জোড়া রাজহাঁস সেই
হ্রদে উড়ে আসত। তারা বেশ দয়ালু ছিল, কারণ তারা কচ্ছপটাকে তার খুশিমত কথা বলতে দিত।
অথবা তারা জানত যে তারা তো মাত্র কয়েকমাস থাকবে এখানে। বাচাল কচ্ছপটা রাজহাঁসদের সঙ্গ
খুব পছন্দ করত। সে তাদের সাথে কথা বলত যতক্ষণ না আকাশের তারারা নিভে যেতো, আর রাজহাঁসরা
ধৈর্য্যসহকারে শুনতো তার কথা।
যখন গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে এল, দিনগুলো ঠান্ডা
হতে শুরু করল, রাজহাঁসেরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। বাচাল কচ্ছপটা কাঁদতে শরু
করল, সে শীতকালকে ঘৃণা করত আর ঘৃণা করত তার বন্ধুদের সঙ্গ হারানোটা।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হায়! আমি যদি
তোমাদের সাথে যেতে পারতাম। মাঝে মাঝে যখন পাহাড়ের ঢাল বরফে ঢেকে যায়, এই হ্রদটাও বরফে
ছেয়ে যায়, আমার তখন এমন ঠান্ডা ও একা লাগে। আমরা কচ্ছপরা তো আর উড়তে পারি না। আর যদি
হাঁটি, তো কিছুটা পথ যাওয়ার পরেই আবার ফিরে আসার সময় হয়ে যাবে, গরমকাল এসে যাবে। কেননা
কচ্ছপরা হাঁটে খুব আস্তে ধীরে।’
দরাজ দিলের অধিকারী রাজহাঁসরা কচ্ছপটির
এমন বিষণœতায় খুব মর্মাহত হলো। তারা তাকে একটা প্রস্তাব দিল। ‘প্রিয় কচ্ছপ, তুমি কেঁদো
না। আমরা তোমাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারি। তোমাকে কেবল আমাদের একটা কথা রাখতে হবে।’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই, আমি কথা দিচ্ছি!’ বাচাল
কচ্ছপটা উত্তেজিত হয়ে বলল, যদিও সে তখনো জানত না কী কথা দিতে হবে। ‘ আমরা কচ্ছপরা সবসময়
আমাদের কথা রাখি। আসলে আমার মনে আছে, খরগোশদেরকে আমি মাত্র কয়েকদিন আগে কচ্ছপদের বিভিন্ন
ধরনের খোলস সম্বন্ধে বলে কথা দিয়েছিলাম যে এবার থেকে নিরব হওয়ার চেষ্টা করবো...’
এক ঘন্টা পরে যখন বাচাল কচ্ছপটা তার কথা
শেষ করল, তখন রাজহাঁসরা আবার কথা বলার সুযোগ পেল এবং তারা বলল, ‘কচ্ছপ, তোমাকে অবশ্যই
শপথ করতে হবে যে, তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাাখবে।’
‘সহজ ব্যাপার!’ বাচাল কচ্ছপটা বলে উঠল,
‘আসলে আমরা কচ্ছপরা আমাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বিখ্যাত। আমরা বলতে গেলে কথাবার্তা
বলিই না। আমি সেদিন এই কথাটাই একটা মাছকে বুঝাতে চাইছিলাম...’
আরো এক ঘন্টা পরে যখন বাচাল কচ্ছপটা দম
নেওয়ার জন্য থামল, রাজহাঁসরা তাকে একটা লম্বা কাঠির মাঝখানে কামড়ে ধরে থাকতে বলল আর
পই পই করে বলে দিল যেন মুখ বন্ধ রাখে। এরপর রাজহাঁস দুটো কাঠির দুই মাথা ঠোঁট দিয়ে
কামড়ে উড়ার জন্য পাখা ঝাপটাল আর ... কিছুই ঘটলো না। বাচাল কচ্ছপটা যে খুব ভারী ছিল।
যারা বেশি কথা বলে, তারা বেশি খায়। আর কচ্ছপটা এমন মোটা ছিল যে, মাঝে মধ্যে নিজের খোলেও
আঁটতো না। তখন রাজহাঁসরা হাল্কা একটা কাঠি বেছে নিল। কাঠির মাঝখানটা কচ্ছপ কামড়ে ধরল,
দুমাথা কামড়ে ধরল দুই রাজহাঁস। তারা এমনভাবে পাখা ঝাপটাল যে জীবনেও এভাবে পাখা ঝাপটায়
নি। এভাবে তারা উপরে উঠে গেল। তাদের সাথে উঠল লাঠি। লাঠির সাথে সাথে উপরে উঠে গেল কচ্ছপটাও।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত কোন
কচ্ছপ আকাশে উড়ল।
তারা উঁচু থেকে উঁচুতে উঠে গেল। বাচাল
কচ্ছপের হ্রদটা ছোট থেকে ছোট দেখাতে লাগল। এমন কী, এত বিশাল পাহাড়টাকেও এত দূর থেকে
খুব ছোট বলে মনে হলো। সে এমন দারুণ দৃশ্য দেখছিল, যা দেখা এর আগে কোন কচ্ছপের ভাগ্যে
জোটে নি। সে সবকিছু মনে রাখার চেষ্টা করছিল। কেননা, বাড়ি ফিরলে সবাইকে এই ভ্রমণের কথা
শোনাতে হবে তো!
তারা উড়ে গেল পাহাড়ের পর পাহাড়, সমভূমির
পর সমভূমি। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল যখন বিকেল প্রায় তিনটার দিকে একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা
হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে এল। একজন ছোট্ট ছেলে কী মনে করে উপরে তাকাল। সে কী দেখল বলে আপনাদের
ধারণা? একটা উড়ন্ত কচ্ছপ!
‘হেই!’ সে চীৎকার করে তার বন্ধুদের ডাকল,
‘ঐ বোকা কচ্ছপটাকে দেখো তো, উড়ে যাচ্ছে!’
কচ্ছপটা আর নিজেকে সামলাতে পারল না।
‘কাকে তুমি বো... কা ... বলছো!’ ধড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল বাচাল কচ্ছপ। সেটাই ছিল তার
অন্তিম বাণী। বাচাল কচ্ছপটার মৃত্যু হয়েছিল,
কারণ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে তার মুখ বন্ধ রাখতে পারে নি।
তাই আপনি যদি যথা সময়ে নিরব থাকতে না
শেখেন, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ সময় আসলেও মুখ বন্ধ রাখতে পারবেন না। আপনি তখন হয়তো বাচাল
কচ্ছপের মতো ছিটকে পড়ে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাবেন।
#স্বাধীন
কথা - ১২৭
আমি
অবাক হয়ে যাই যে, আমাদের এই আধুনিক বাজার চালিত অর্থনীতিতে কথা এখনো স্বাধীন। এটি অবশ্যই
একটি সময়ের ব্যাপার মাত্র যখন টাকা দিয়ে বাঁধা পড়া সরকার কথাকেও একটি পণ্য বলে ভাববে
আর কথার উপর ট্যাক্স বসাবে।
একটু
ভেবে দেখলে, আইডিয়াটা মন্দ নয়। নিরবতা তখন আবার দামী হয়ে উঠবে। কিশোর কিশোরীরা আর কোন
ফোন নিয়ে মেতে থাকবে না। সুপার মার্কেটের লম্বা লাইনগুলো দ্রুত সরে যাবে। বিয়ে টিকবে
দীর্ঘদিন, কেননা নবদম্পতি তর্কাতর্কির খরচটা বহন করতে পারবে না। আর এটা বেশ স্বস্তিদায়ক
যে আপনার পরিচিতদের কারো কারো থেকে যথেষ্ট ট্যাক্স উঠবে, যা দিয়ে কানে শোনার যন্ত্র
বিনামূল্যে বিতরণ করা যাবে সেই সমস্ত বধিরদের কাছে, যারা এতদিনের কথার আক্রমণে কানে
শোনারা ক্ষমতা হারিয়েছে। করের বোঝা তখন কঠোর পরিশ্রমীদের বদলে কঠোর বক্তাদের উপর সরে
যাবে। এমন দারুণ কর আদায় প্রকল্পের সবচেয়ে মহান করদাতা হবে রাজনীতিবিদরা। তারা যত বেশি
সংসদে বক বক করবে, আমাদের হাসপাতাল ও স্কুলগুলোর জন্য তত বেশি টাকা উঠবে। কী স্বস্তিদায়ক
চিন্তা।
সবশেষে, যারা এমন কর আদায়ের পরিকল্পনাকে
অবাস্তব বলে ভাবতে চায়, তাদেরকে বলছি, কে এই প্ল্যানের বিপক্ষে মনে প্রাণে বিতর্ক করতে
চাইবে?
------------সপ্তম অধ্যায় শেষ---------------
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।