হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-১৫) চতুর্থ অধ্যায়


চতুর্থ অধ্যায়: রাগ ও ক্ষমা
#রাগ- ৫৫
রাগ কোন ভালো প্রতিক্রিয়া নয়। জ্ঞানী লোকেরা সুখী, আর সুখী লোকেরা রাগ করে না। প্রথমত, রাগ করা অযৌক্তিক। একদিন আমাদের বিহারের গাড়িটা রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের লাল সিগন্যালে থেমে গেল। পাশের একটা প্রাইভেট কারের গাড়ির চালক ট্রাফিক লাইটকে এভাবে গালাগালি করছিল:

’নরকে যাও, হে ট্রাফিক লাইট! তুমি জানতে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ এপয়েন্টমেন্ট আছে। তুমি জানতে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আর সেই তুমি কিনা অন্যান্য গাড়িকে আমার আগে আগে চলে যেতে দিলে, শুয়োর কোথাকার! তোমার এধরনের কাজ কিন্তু এটাই প্রথম নয়, আগেও ...’
সে ট্রাফিক লাইটগুলোকে গালি দিচ্ছিল যেন তাদের কোন কিছু করার আছে। সে ভেবেছিল যে ট্রাফিক লাইট উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে ঝামেলায় ফেলেছে: ‘আহা! এই যে আসছে সে। আমি জানি তার দেরী হচ্ছে। আমি অন্যান্য গাড়িগুলোকে আগে যেতে দিই। আর ... লাল! থামো! পেয়েছি তাকে!’ ট্রাফিক লাইটগুলোকে হিংসুটে মনে হতে পারে, কিন্তু তারা শুধু ট্রাফিক লাইট মাত্র, আর কিছু না। আপনি ট্রাফিক লাইটের কাছ থেকে আর কীইবা আশা করতে পারেন?
আমি কল্পনা করলাম সে বাসায় দেরী করে পৌঁছেছে এবং তার স্ত্রী তাকে দুষছে, ‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই স্বামী! তুমি জানতে আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ এপয়েন্টমেন্ট আছে। তুমি জানতে দেরি করা যাবে না। আর তুমি কিনা আমার চেয়ে অন্য কাজগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিলে। শুয়োর কোথাকার! তোমার এরকম কিন্তু এটাই প্রথমবার নয়...’
সে তার স্বামীকে দুষছে যেন তার স্বামীর কোনকিছু করার ছিল। সে ভেবেছে তার স্বামী ইচ্ছে করেই তাকে মনে দুঃখ দিয়েছে: ‘আহা! আমার তো স্ত্রীর সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি একটু দেরি করে যাব। আমি প্রথমে এই লোকটার সাথে দেখা করব। দেরি হয়ে গেছে? খুব ঠিক হয়েছে!’ স্বামীরা হয়তো হিংসুটে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তারা তো স্বামীই। সেটাই তো সব। স্বামীদের থেকে আপনি আর কীইবা আশা করতে পারেন?
রাগজনক বেশিরভাগ পরিস্থিতির মোকাবেলায় এই গল্পের চরিত্রগুলো বদলে নেওয়া যেতে পারে।

#বিচার- ৫৬
রাগ দেখাতে চাইলে প্রথমে সেটা নিজে নিজে বিচার করে দেখতে হবে। আপনার নিজেকে বুঝাতে হবে যে রাগটা ন্যায্য, যথার্থ। রাগের এই মানসিক প্রক্রিয়ায় যেন আপনার মনের মধ্যেই একটা বিচার সভা বসে।
এই বিচার সভায় আপনার মনের আদালতের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দাঁড়ায়। আপনি অভিযোগকারী, আপনি জানেন তারা দোষী। কিন্তু সেটা বিচারকের কাছে, আপনার বিবেকের কাছে আগে প্রমাণ করতে হবে। আপনি আপনার বিরুদ্ধে করা সেই অপরাধের একটা সচিত্র ভিডিও দেখিয়ে দেন।
আপনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাজের পেছনে যে সমস্ত বিদ্বেষ, ছলচাতুরী ও আপাত নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে তার সবগুলো তুলে ধরেন। অতীত থেকে খুঁড়ে আনেন তাদের অন্যান্য অপরাধগুলোকেও। আপনার বিবেককে এগুলো দেখিয়ে বুঝিয়ে দেন যে তারা ক্ষমার অযোগ্য।
বাস্তবের আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তির একজন উকিল থাকে, যাকে তার পক্ষ হয়ে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এই মানসিক বিচারে আপনি আপনার রাগকে ন্যায়সঙ্গত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আপনি কোন মর্মান্তিক অজুহাত শুনতে চান না, অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যাও আপনার দরকার নেই, ক্ষমা করে দেওয়ার কাতর মিনতিও আপনি শুনতে চান না। এখানে অভিযুক্তের উকিলকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। আপনার একপেশে যুক্তি দিয়ে আপনি বিশ্বাসযোগ্য একটা মামলা সাজান। সেটাই যথেষ্ট। বিবেক তার হাতুড়ি দিয়ে দমাদম বাড়ি দেয় আর তারা দোষী সাব্যস্ত হয়। এখন তাদের সাথে রাগ করাটা যুক্তিযুক্ত।
বহু বছর আগে আমি যখন রেগে যেতাম তখনই আমার মনের মধ্যে এই বিচার প্রক্রিয়াটা ঘটতে দেখতাম। এটা খুবই অন্যায্য দেখাতো। তাই পরের বারে যখন আমি কারো সাথে রাগ করতে চাইতাম, আমি এক মুহুর্ত থেমে তাদের কী বলার আছে, তা বিবাদী পক্ষের উকিলকে বলতে দিতাম। আমি তাদের আচরণের সম্ভাব্য অজুহাতগুলো এবং যুতসই ব্যাখ্যাগুলো ভেবে ভেবে বের করতাম। আমি ক্ষমার সৌন্দর্যকেই গুরুত্ব দিতাম। আমি দেখতাম যে বিবেক আর অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে দোষী বলে রায় দিচ্ছে না। অন্যদের আচরণকে বিচার করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে গেল। রাগ ন্যায়সঙ্গত না হওয়ায় তার আহার না পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গেল।


                                                                                                                                      -----------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !