তৃতীয় অধ্যায়: ভয় এবং ব্যথা
#কোন
দুশ্চিন্তা নয়- ৪৮
নিয়ন্ত্রণকারীকে যেতে দেওয়া, বর্তমান
মুহুর্তের সাথে থাকা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার প্রতি [যা হয় হবে এমন] খোলা একটা মনমানসিকতা
নিয়ে থাকা আমাদেরকে ভয়ের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। এটা আমাদেরকে জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে
আমাদের নিজস্ব প্রজ্ঞা দিয়ে মোকাবেলা করতে শেখায় এবং অনেক অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বের
করে নিয়ে যায় নিরাপদে।
শ্রীলঙ্কায় চমৎকার একটা ভ্রমণ শেষে সিঙ্গাপুর
হয়ে অস্ট্রেলিয়া ফেরার সময় পার্থের বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের ছয়টা লাইনের একটাতে দাঁড়িয়েছিলাম
আমি। লাইনটা শম্বুক গতিতে এগোচ্ছিল, তার মানে খুব ভালোমতো চেক করা হচ্ছে সবাইকে।
একজন পুলিশ অফিসার কোত্থেকে উদয় হলো,
সাথে আছে মাদকদ্রব্য ধরার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছোট্ট একটা কুকুর। অফিসারটিকে কুকুর
নিয়ে আসতে দেখে লাইনের লোকজন নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখ করলো, যদিও তাদের কাছে
কোন মাদকদ্রব্য ছিল না। কুকুরটি তাদেরকে শোঁকার পরে যখন পরের জনের কাছে যাচ্ছিল, আপনি
নিশ্চিতভাবেই তাদেরকে দেখে বুঝতে পারবেন যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে তারা। এতক্ষণ কী
টেনশনই না করেছে।
যখন সেই সুন্দর ছোট্ট কুকুরটা আমার কাছে
এসে শুঁকলো, এটি থেমে দাঁড়ালো। এটি তার নাকটা আমার কোমরের কাছে চীবরের ভেতর গুঁজে দিল
এবং দ্রুত বড় বড় করে লেজ নাড়তে লাগলো। কাস্টমস অফিসারটি কোনমতে টেনেহিঁচড়ে কুকুরটিকে
সরিয়ে নিয়ে গেল। লাইনে আমার সামনের লোকজন যারা এতক্ষণ বেশ বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, এখন তারা
এক পা দূরে সরে গেল। আমি নিশ্চিত, আমার পিছনের জুটিও এক পা পিছনে সরে গেল।
পাঁচ
মিনিট পরে, আমি কাউন্টারের বেশ সামনে চলে আসলাম। তারা আবার শোঁক শোঁক করা কুকুরটাকে
নিয়ে আসল। কুকুরটিকে প্রত্যেক লাইনের সামনে থেকে পেছনে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। লাইনের
প্রত্যেককে একটু করে শুঁকে আবার সামনে এগোল কুকুরটি। আমার কাছে এসে এটি আবার থামল।
এটি আমার চীবরে নাক গুঁজে দিয়ে প্রচন্ডভাবে লেজ নাড়তে শুরু করলো। আবারো কাস্টমস অফিসারটিকে
জোর করে কুকুরটিকে সরিয়ে নিতে হলো। আমি অনুভব করলাম, সবার চোখ এখন আমার দিকে। যদিও
অনেকেই এ পর্যায়ে এসে কিছুটা উদ্বিগ্ন হতে পারতো, আমি ছিলাম পুরোপুরি রিলাক্সড। যদি
আমাকে জেলে যেতে হয়, তো ভালো। আমার সেখানে অনেক বন্ধু। আর তারা বিহারের চেয়েও ভালো
করে খাওয়াবে আমাকে।
যখন আমি কাস্টমস চেক পয়েন্টে আসলাম, তারা
আমাকে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করল। আমার কোন ড্রাগস ছিল না। ভিক্ষুরা এমনকি মদও খায়
না, ড্রাগ তো দূরের কথা। তারা অবশ্য আমাকে
ন্যাংটা করে সার্চ করেনি। কারণটা, আমার মনে হয়, আমি কোন ভয় পাওয়ার বা ঘাবড়ে যাওয়ার
চিহ্ন দেখাই নি। তারা কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, আমার কী মনে হয়, কেন কুকুরটি কেবল আমার
কাছে এসে থেমে গেল। আমি বললাম যে ভিক্ষুরা প্রাণীদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। হয়তো
আমাকে শুঁকে কুকুরটি সেটাই বুঝেছে। অথবা হতে পারে, কুকুরটি অতীত জন্মে কোন ভিক্ষু ছিল।
তারা অতঃপর আমাকে ছেড়ে দিল।
আমি একবার খুব ক্রুদ্ধ ও অর্ধমাতাল এক
বিশালদেহী আমেরিকানের ঘুষি খাওয়ার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। নির্ভীক মনোভাব সেদিন
আমাকে ও আমার নাকটাকে বাঁচিয়েছিল।
আমরা সবেমাত্র আমাদের নতুন শহরের বিহারে
চলে এসেছি, পার্থ শহরের সামান্য উত্তরে। নতুন বিহারের জমকালো উদ্বোধন করতে যাচ্ছি আমরা।
অবাক করা খুশির খবর এই যে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন গভর্নর স্যার গর্ডন রীড ও তার
স্ত্রী আমাদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
আমাকে উঠোনের সাজসজ্জা এবং অতিথি ও ভিআইপিদের
চেয়ারগুলো ম্যানেজ করার দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমাদের কোষাধ্যক্ষ পই পই করে বলে দিলেন
সবচেয়ে ভালো জিনিসপত্র জোগাড় করতে। আমরা খুব ভালো একটা বিহার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করতে
চাই।
সামান্য খোঁজাখুঁজির পর খুব ব্যয়বহুল
একটা কোম্পানিকে খুঁজে পেলাম আমি। এটা পার্থের পশ্চিমে ধনী আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।
তারা কোটিপতিদের বাগানে পার্টির জন্য সাজসজ্জা ভাড়া দিয়ে থাকে। আমি তাদেরকে বললাম আমি
কী চাই এবং কেন এটা খুব ভালো হতে হবে। আমি যে মহিলার সাথে কথা বলেছিলাম, সে বললো যে
সে সবকিছু বুঝেছে, তাই অর্ডারটা তাদেরকেই দেওয়া হলো।
শুক্রবার বিকেলে যখন সাজসজ্জা ও চেয়ারগুলো
পৌঁছালো, আমি তখন আমাদের নতুন বিহারের পেছনে একজনকে সাহায্য করছিলাম। যখন মালপত্রগুলো
দেখতে আসলাম, তখন ডেলিভারি দিতে আসা ট্রাক ও লোকজন সব চলে গেছে।
আমি সাজসজ্জার বেহাল দশা দেখে বিশ্বাস
করতে পারছিলাম না। সেগুলো লাল লাল ধুলোয় ঢাকা পড়ে আছে। আমি অসন্তুষ্ট হয়ে গেলাম, তবে
সমস্যাটা ঠিক করা যাবে। আমরা সাজসজ্জাগুলো সাজিয়ে রাখতে শুরু করলাম। এরপর আমি অতিথিদের
চেয়ারগুলো চেক করলাম। সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। চেয়ারের ফুটো দিয়ে ভেতরের ফোম, ছেঁড়া
ন্যাকড়া সব বেরিয়ে এসেছে। আমার অমূল্য ভলান্টিয়াররা সেগুলোর প্রত্যেকটিকে পরিষ্কার
করতে শুরু করলো। অবশেষে আমি ভিআইপিদের জন্য আনা স্পেশাল চেয়ারগুলো দেখলাম। সেগুলো ছিল
আসলেই স্পেশাল। একটা চেয়ারেরও পাগুলো সমান ছিল না! সবগুলো চেয়ার ছিল নড়বড়ে, প্রচুর
নড়বড়ে, একটাও ঠিকমতো বসে না।
অবিশ্বাস্য কান্ড। খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে
এটা। আমি ফোনের কাছে দৌড়ে গেলাম। সেই ভাড়াটে কোম্পানিকে ফোন করলাম এবং সেই মহিলাকে
পেলাম, যে সাপ্তাহিক ছুটিতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি অবস্থাটা ব্যাখ্যা করলাম।
জোর গলায় বললাম যে অনুষ্ঠান চলাকালে আমরা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার গভর্নরকে এমন নড়বড়ে চেয়ারে
দুলতে দিতে পারি না। যদি তিনি পড়ে যান, তো কী হবে? সে ব্যাপারটা বুঝল, ক্ষমা চাইল এবং
আশ্বস্ত করল যে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সে চেয়ারগুলো পাল্টানোর ব্যবস্থা করবে।
এবার আমি ডেলিভারি ট্রাকের অপেক্ষায় রইলাম।
আমি সেটাকে মোড় ঘুরে আসতে দেখলাম। অর্ধেক পথও পেরোয় নি, বিহার থেকে প্রায় ষাট মিটার
দূরে থাকতেই, ট্রাকটা তখনো বেশ দ্রুতগতিতে চলছিল, সেই অবস্থাতেই তাদের একজন ট্রাক থেকে
লাফিয়ে নামল এবং আমার দিকে ঘুষি উঁচিয়ে তেড়ে আসল।
‘এখানকার দায়িত্বে আছে কোন ব্যাটা?’ সে
চিৎকার করল, ‘আমি সেই ব্যাটাকে দেখতে চাই।’
পরে আমি জেনেছিলাম যে আমাদের প্রথম অর্ডারটা
ছিল তাদের জন্য সপ্তাহের শেষ ডেলিভারি। আমাদের মাল ডেলিভারি দেওয়ার পরে তাদের লোকেরা
বাক্স পেটরা গুছিয়ে মদের দোকানে ঢুকে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে শুরু করে দিয়েছিল। তাদের
মদ্যপান নিশ্চয়ই অনেকদূর এগিয়েছিল, যখন কোম্পানির ম্যানেজার এসে তাদেরকে আবার কাজে
ফেরার নির্দেশ দিল। বুড্ডিস্টদের চেয়ারগুলো বদলে দিতে হবে।
আমি সেই লোকটার কাছে এগিয়ে গেলাম এবং
ভদ্রভাবে বললাম, ‘আমিই এখানকার দায়িত্বে থাকা ব্যাটা ছেলে। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে
পারি?’
সে তার মুখটা আমার কাছে নিয়ে এল, তা ডান
হাতের ঘুষি তখনো উদ্যত, আমার নাকের ডগা থেকে সামান্য দূরে। তার চোখগুলো রাগে জ্বলছিল।
কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকা তার মুখ থেকে বিয়ারের তীব্র গন্ধ ভেসে এল। আমি শুধু রিলাক্সড
ছিলাম।
আমার সেই তথাকথিত বন্ধুরা চেয়ার পরিষ্কারের
কাজ ফেলে চেয়ে থাকল শুধু। তাদের একজনও আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল না। অনেক ধন্যবাদ,
বন্ধুরা! আমাদের এই মুখোমুখি থাকাটা কয়েক মিনিট স্থায়ী হলো। যা ঘটছিল তাতে আমি মুগ্ধ
হয়ে গেলাম। সেই রাগী কর্মচারীটা আমার নির্বিকার প্রতিক্রিয়ার সামনে একেবারে ঠণ্ডা হয়ে
গেল। তার চিরাচরিত অভ্যাস শুধু ভয় পেতে বা রুখে দাঁড়াতে দেখতে অভ্যস্ত ছিল। তার মস্তিষ্ক
জানত না এমন একজন ব্যক্তির প্রতি কীভাবে সাড়া দেবে যে তার নাকের সামনে উদ্যত ঘুষি দেখেও
নির্বিকার থাকে। আমি জানতাম, সে আমাকে ঘুষিও মারতে পারবে না, সরে যেতেও পারবে না। আমার
নির্ভীকতা তাকে হতবুদ্ধি করে তুলেছিল। এই কয়েক মিনিটে ট্রাকটা পার্ক করে তার বস আমাদের
দিকে এগিয়ে গেল। সে তার জমে যাওয়া কর্মচারীর কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘এসো, চেয়ারগুলো
নামাই।’ এতে অচলাবস্থা ভাঙলো, উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার
একটা পথ তৈরী হলো তার জন্য।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিও আপনাদেরকে সাহায্য
করব।’ আর আমরা একসাথে চেয়ারগুলো নামালাম।
-------------------তৃতীয় অধ্যায় শেষ-----------------
-----------------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।