হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-৩৫) সপ্তম অধ্যায়


`সপ্তম অধ্যায়: প্রজ্ঞা ও অন্তরের নিরবতা

#প্রজ্ঞা কী? - ১১৬
আমি যখন ছাত্র ছিলাম, সেই সময়ে বেশির ভাগ গ্রীষ্মের ছুটিগুলো কাটাতাম স্কটল্যান্ডের পাহাড়ী এলাকায় হেঁটে বেড়িয়ে এবং ক্যাম্পিং করে। স্কটিশ পাহাড়গুলোর নির্জনতা, সৌন্দর্য ও প্রশান্তি আমাকে আনন্দিত করতো।
এক স্মরণীয় বিকেলে আমি সাগর পাড় ঘেঁষে চলে যাওয়া এক ছোট্ট রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, যা এঁকেবেঁকে বহু দূরে পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গেছে। উজ্জ্বল সূর্যালোক একটা স্পটলাইটের মতো আমার চারপাশের অসাধারণ সৌন্দর্যকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ জুড়ে ছেয়ে আছে বসন্তের কোমল সতেজ সবুজ ঘাস। খাড়া পাহাড়ের ঢালগুলো যেন সাগর ফুঁড়ে উঠে যাওয়া গির্জার চুড়া, পড়ন্ত বিকেলে সাগর তখন নীল, এটি যেন সূর্যরশ্মিতে ঝিকিমিকি করে ওঠা তারার মেলা। ছোট ছোট সবুজ ও বাদামী পাথরের দ্বীপগুলো দিগন্তের পাড়ে হারিয়ে যাওয়া ঢেউয়ের সাথে খেলায় মেতেছে। সী গাল এবং টার্ন নামের সামুদ্রিক পাখিগুলোও উড়ছে আর ডিগবাজি খাচ্ছে- সেটা যে তুমুল খুশিতে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এটি ছিল এক রোদেলা দিনে আমাদের এই পৃথিবীর সেরা দর্শনীয় জায়গাগুলোর একটাতে প্রকৃতির অপূর্ব শোভার এক অনুপম প্রদর্শনী।
পিঠে আমার ভারী ব্যাকপ্যাক থাকা সত্ত্বেও খুশিতে আমি যেন লাফাচ্ছিলাম। প্রকৃতির ছোঁয়ায় আমি ছিলাম আনন্দে ভরপুর। আমার সামনে রাস্তার ধারে পার্ক করা ছিল একটা ছোট গাড়ি। আমি কল্পনা করলাম, এর ড্রাইভারও নিশ্চয়ই চারপাশের এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে বিমোহিত, তাই গাড়ি থামিয়ে এর সৌন্দর্যসুধা পানে ব্যস্ত। একটু কাছে গিয়ে আসল ব্যাপার দেখে আমি মনে মনে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলাম। গাড়িটার একজন মাত্র যাত্রী, সে একটা সংবাদপত্র পড়ছে।
সংবাদপত্রটা এত বড় যে এটি তাকে তার চারপাশের দৃশ্য থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সাগর, পাহাড়, দ্বীপ ও দিগন্তবিস্তৃত তৃণভূমির বদলে লোকটা কেবল দেখছিল যুদ্ধ, রাজনীতি, কেলেঙ্কারি ও খেলাধুলা। সেই সংবাদপত্রটা বড় হতে পারে, কিন্তু খুব পাতলা, মাত্র কয়েক মিলিমিটার পুরু। কালো শুষ্ক নিউজপ্রিন্টের ওপাশে ছড়িয়ে আছে রঙধনুর রঙে ঝলমল করা প্রকৃতির উল্লাস। আমি ভাবলাম, ব্যাগ থেকে কাঁচি বের করে তার কাগজে ছোট একটা ফুটো করে দিলে কেমন হয়, যাতে করে সে দেখতে পারে, অর্থনীতির সেই নিবন্ধ, যেটা সে পড়ছিল, তার ওপাশে কী আছে। কিন্তু সে ছিল বড়সড় লোমশ স্কটসম্যান, আর আমি একজন রোগাপটকা হাড্ডিসার ছাত্র। তাকে জগত সম্পর্কে পড়তে দিয়ে আমি নেচে নেচে এগিয়ে গেলাম।
আমাদের বেশির ভাগ অংশই সংবাদপত্রের মতো এমন বিষয় নিয়ে ভর্তি থাকে: সম্পর্কে টানাপোড়েন, পরিবার এবং কাজের ক্ষেত্রে রাজনীতি, ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি, আর পাশবিক আনন্দের খেলাধুলা। যদি আমরা আমাদের মনের এই সংবাদপত্রটাকে সময়ে সময়ে নামিয়ে রাখতে না জানি, আমরা যদি তা নিয়েই মেতে থাকি, আমরা যদি সেটাই জানি- তাহলে আমরা কখনোই প্রকৃতির সেই অকৃত্রিম ও খাঁটি সুখ শান্তি উপভোগ করতে পারবো না। আমরা কখনোই প্রজ্ঞাকে চিনতে পারবো না।

#বিজ্ঞতার সাথে খাওয়া - ১১৮
আমার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন বাইরে খাওয়া পছন্দ করে। কোন কোন সন্ধ্যায় তারা খুব দামী কোন রেস্তোঁরায় যায়, যেখানে তারা অসাধারণ সব খাবারের জন্য প্রচুর টাকা ঢালতে প্রস্তুত। কিন্তু খাবারের স্বাদ উপভোগ না করে সঙ্গী সাথীদের সাথে কথাবার্তায় মন দিয়ে তারা খাবারের মজাটাই নষ্ট করে।
দারুণ কোন অর্কেস্ট্রা চলাকালে কে কথা বলবে?
আপনার বকবকানি এমন সুমধুর সঙ্গীত উপভোগের পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে আর খুব সম্ভবত আপনাকে বাইরে বের করে দেবে। এমনকি কোন দারুণ মুভি দেখার সময়ও আমরা চাই না কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করুক। তাহলে লোকেরা খাওয়ার সময় কেন বাজে আলাপে ব্যস্ত থাকে?
যদি রেস্তোরাটা সাধারণ মানের হয়, তাহলে নিরস খাবার থেকে মন সরিয়ে নেওয়ার জন্য কথাবার্তা শুরু করা একটা ভালো বিকল্প হতে পারে। কিন্তু যখন খাবারটা খুব সুস্বাদু হয় আর খুব দামী হয়, তখন আপনার সঙ্গীকে চুপচাপ থাকতে বলাটা আপনার পুরো টাকাটা উসুল করে নেওয়ার জন্য মঙ্গলদায়ক।
নিরবে খাওয়ার সময়ও আমরা প্রায়ই খাওয়ার আনন্দদায়ক মুহুর্তটাকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হই। খাবার চিবানোর সময়ে আমাদের মন পড়ে থাকে এরপরে কী খাবো, কোনটা খাবো তা নিয়ে। কেউ কেউ তো পরবর্তী দুই তিন গ্রাসের খাওয়ার প্লান করে বসে থাকে- এক গ্রাস নিজের মুখে, আরেক গ্রাস হাতে ধরা, আরেক গ্রাস তখন প্লেটে রেডি, আর মন তখন ভাবনায় ব্যস্ত, তৃতীয় গ্রাসের পরে কী খাবে তা নিয়ে।
আমাদের খাবারের স্বাদ উপভোগের জন্য আর জীবনের পূর্ণতাকে জানতে আমাদের একবারে একেক মুহুর্ত নিরবে উপভোগ করা উচিত। তাহলেই আমরা জীবন নামের এই ফাইভ স্টার হোটেলে টাকার যথাযথ মূল্যের সেবা পেতে পারি।
                                                                                                   ----------------চলমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !