শাস্তা জেতবনে অবস্থিতিকালে স্থবির লালুদায়ীর সম্বন্ধে এই কথা বলিয়াছিলেন। এই সময়ে মল্ল জাতীয় স্থবির দব্বো ভিক্ষুসংঘের ভক্তোদ্দেশক ছিলেন। তিনি প্রাতঃকালে যে শলাকা দিতেন তাহা দেখাইয়া স্থবির উদায়ী কোন দিন উৎকৃষ্ট, কোনদিন বা নিকৃষ্ট তণ্ডুল পাইতেন। উদায়ী যে যে দিন নিকৃষ্ট তণ্ডুল পাইতেন, সেই সেই দিন শলাকাগারে গণ্ডগোল করিতেন। তিনি বলিলেন, ‘দব্বে ভিন্ন কি আর কেহ শলাকা বিতরণ করিতে জানে না? আমরা কি এ কাজ করিতে পারি না?’ এক দিন তাঁহাকে এইরূপ গণ্ডগোল করিতে দেখিয়া, অন্য সকলে তাঁহার সম্মুখে শলাকার ঝুড়ি রাখিয়া বলিল, ‘বেশ কথা, আজ আপনিই শলাকা বিতরণ করুন। তদবধি উদায়ীই সংঘের মধ্যে শলাকা বিতরণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বন্টন করিবার সময় তিনি কোন তণ্ডুল উৎকৃষ্ট, কোন তণ্ডুল নিকৃষ্ট তাহা বুঝিতে পারিতেন না; কত দিনের ভিক্ষু হইলে উৎকৃষ্ট তণ্ডুল পায়, কত দিনের ভিক্ষুকে নিকৃষ্ট তণ্ডুল দিতে হয়, তাহাও তাঁহার জানা ছিল না। শলাকাগৃহে ভিক্ষুদিগের নাম ডাকিবার সময়েও কাহাকে অগ্রে ডাকিতে হইবে, কাহাকে পশ্চাতে ডাকিতে হইবে, তাহা তিনি জানিতেন না। কাজেই ভিক্ষুরা যখন শলাকাগৃহে উপবেশন করিতেন, তখন উদায়ী ভূমিতে বা ভিত্তিতে দাগ দিয়া স্থির করিয়া লইতেন এখানে অমুক দল ছিল, এখানে অমুক দল ছিল ইত্যাদি। কিন্তু পর দিন হয়ত এক দলের অল্প লোক ও অন্য দলের অধিক লোক উপস্থিত হইত। এরূপ ঘটিলে দাগ অল্প দলের জন্য নিম্নে এবং অধিক দলের জন্য উপরে পড়িবার কথা; কিন্তু উদায়ী তাহা গ্রাহ্য করিতেন না। তিনি পূর্ব্বদিনের দাগ দেখিয়াই শলাকা বন্টন করিতেন। অপিচ কোন দলকে কি দিতে হইবে তাহাও তিনি বুঝিতেন না।
ভিক্ষুরা বলিতেন, ‘ভাই উদায়ী, দাগটা বড় উপরে উঠিয়াছে অথচ ভিক্ষুর সংখ্যা কমা,’ কিংবা ‘দাগটা বড় নীচে আছে, অথচ ভিক্ষুর সংখ্যা বেশী’ কিংবা ‘এত বৎসরের ভিক্ষুদিগকে ভাল চাউল দিতে হইবে; এত বৎসরের ভিক্ষুদিগকে মন্দ চাউল দিতে হইবে’ ইত্যাদি। কিন্তু উদায়ী তাঁহাদের কথায় কাণ দিতেন না। তিনি বলিতেন, ‘যেখানকার দাগ সেখানেই আছে। আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করিব, না আমার দাগ বিশ্বাস করিব?’
এইরূপে জ্বালাতন হইয়া একদিন বালক ভিক্ষু[ ও শ্রামণেরগণ উদায়ীকে শলাকাগার হইতে বাহির করিয়া দিল। তাহারা বলিল, ‘ভাই লালুদায়ী, তুমি শলাকা বিতরণ করিলে ভিক্ষুরা স্ব স্ব প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হয়। তুমি এ কাজের অনুপযুক্ত; অতএব এখান হইতে চলিয়া যাও। ইহাতে শলাকাগারে মহা কোলাহল উপস্থিত হইল। শাস্তা স্থবির আনন্দকে জিজ্ঞাসা করিলেন, শলাকাগারে কোলাহল হইতেছে কেন?
আনন্দ তথাগতকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানাইলেন। তাহা শুনিয়া তথাগত বলিলেন, ‘উদায়ী নির্ব্বুদ্ধিতাবশতঃ এখনই যে কেবল অপরের প্রাপ্যহানি করিতেছে তাহা নহে; পূর্ব্বেও সে ঠিক এইরূপ করিয়াছিল।’
আনন্দ বলিলেন, প্রভু, দয়া করিয়া ইহার অর্থ বুঝাইয়া দিন। তখন ভগবান ভাবান্তর-প্রতিচ্ছন্ন সেই অতীত কথা প্রকট করিলেন :
পুরাকালে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। বোধিসত্ত্ব তাঁহার অর্ঘকারকের কাজ করিতেন। তিনি হস্তী, অশ্ব, মণি, মুক্তা প্রভৃতি মূল্য নির্দ্ধারণ করিয়া বিক্রেতাদিগের, যাহার যাহা প্রাপ্য, তাহা চুকাইয়া দিতেন।
রাজা ব্রহ্মদত্ত অতি অর্থলোলুপ ছিলেন। একদিন তাঁহার মনে হইল এই অর্ঘকারক যেভাবে মূল্য নিরূপণ করিতেছে, তাহাতে অচিরে আমার ভাণ্ডার শূন্য হইবে। আমি ইহাকে পদচ্যুত করিয়া অপর কোন ব্যক্তিকে অর্ঘকারকের কাজ দিব।’ অনন্তর তিনি জানালা খুলিয়া দেখিলেন একটা পাড়াগেঁয়ে লোক উঠান দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছে। ঐ ব্যক্তি নিতান্ত নির্ব্বোধ অথচ লোভী ছিল। কিন্তু ব্রহ্মদত্ত তাহা জানিতেন না; তিনি ভাবিলেন এইরূপ লোককেই অর্ঘকারক করা উচিত। তিনি তাহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি আমার অর্ঘকারকের কাজ করিতে পারিবে কি? সে বলিল, হাঁ মহারাজ, আমি এ কাজ করিতে পারিব। ব্রহ্মদত্ত তদ্দণ্ডেই সেই লোকটাকে নিযুক্ত করিয়া ভাণ্ডাররক্ষা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইলেন। অতঃপর সে, যখন যেমন খেয়াল হইত, হস্তী, অশ্ব প্রভৃতির মূল্য নির্দ্ধারণ করিত, কোন দ্রব্যের প্রকৃত মূল্য কত হইতে পারে তাহা একবারও ভাবিত না। কিন্তু রাজার অর্ঘকারক বলিয়া কেহই তাহার প্রতিবাদ করিতে সাহসী হইত না; সে যে মূল্য অবধারণ করিয়া দিত, বিক্রেতাদিগকে তাহাই লইতে হইত।
একদিন উত্তরাঞ্চল হইতে এক অশ্ব-বণিক পাঁচশত অশ্ব লইয়া বারাণসীতে উপনীত হইল। রাজা নূতন অর্ঘকারককে সেই সকল অশ্বের মূল্য নির্দ্ধারণ করিতে বলিলেন। সে গিয়া স্থির করিল পাঁচশ ঘোড়ার দাম এক পালি চাউল, এবং অশ্ব-বণিককে ঐ মূল্য দিয়াই ঘোড়াগুলিকে রাজার আস্তাবলে লইয়া যাইতে হুকুম দিল। অশ্ব-বণিক হতবুদ্ধি হইয়া বোধিসত্ত্বের নিকট গেল এবং যেরূপ ঘটিয়াছিল সমস্ত বলিয়া এখন কি কর্ত্তব্য জিজ্ঞাসা করিল। বোধিসত্ত্ব বলিলেন, ‘যাও, উহাকে কিছু ঘুষ দাও এবং বল যে, ‘মহাশয়, পাঁচশ ঘোড়ার দাম যে এক পালি চাউল তাহা ত আপনি স্থির করিয়া দিলেন; কিন্তু এক পালি চাউলের কত দাম, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। দয়া করিয়া রাজার সাক্ষাতে এই কথাটা বুঝাইয়া দিবেন কি?’ যদি ইহার উত্তরে সে বলে, ‘হাঁ, বুঝাইয়া দিব’, তবে তাহাকে সঙ্গে লইয়া রাজসভায় যাইবে। আমিও সেখানে উপস্থিত থাকিব।’
অশ্ব-বণিক কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ না করিয়া এই পরামর্শ মত কাজ করিল। লোভী অর্থকারক ঘুষ পাইয়া বড় খুশী হইল এবং এক পালি চাউলের দাম কত তাহা রাজার নিকট বলিতে অঙ্গীকার করিল। অশ্ব-বণিক তখনই তাহাকে রাজসভায় লইয়া গেল। সেখানে বোধিসত্ত্ব এবং অমাত্যগণ উপস্থিত ছিলেন। অশ্ব-বণিক প্রণাম করিয়া বলিল, মহারাজ, পাঁচ শত ঘোড়ার দাম যে এক পালি চাউল এ সম্বন্ধে আমি আপত্তি করিতেছি না; কিন্তু দয়া করিয়া আপনার অর্ঘকারক মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করুন যে একপালি চাউলের দাম কত? বণিকের অভিসন্ধি বুঝিতে না পারিয়া রাজা বলিলেন, বলত অর্ঘকারক, পাঁচ শ ঘোড়ার দাম কত? সে উত্তর দিল, মহারাজ, পাঁচ শ ঘোড়ার দাম এক পালি চাউল। রাজা আবার জিজ্ঞাসিলেন, বেশ কথা; এখন দেখ ত পাঁচ শ ঘোড়ার দাম এক পালি চাউল হইলে এক পালি চাউলের দাম কত হয়? সে উত্তর দিল, মহারাজ, এক পালি চাউলের দাম সমস্ত বারাণসী শহর ও সহরতলি।
এই কথা শুনিয়া অমাত্যগণ অট্টহাস্য করিয়া করতালি দিতে দিতে বলিলেন, ‘আমরা এত কাল জানিতাম পৃথিবী ও রাজ্যের কোন মূল্য অবধারণ করা যায় না; এখন শিখিলাম বারাণসীরাজ্য ও বারাণসীর রাজা উভয়ের মূল্য এক পালি চাউল মাত্র। আহা! অর্ঘকারকের কি অদ্ভুত বুদ্ধি! কি কৌশলে যে এ অপদার্থ এতকাল এই পদ ভোগ করিয়া আসিতেছে তাহা আমাদের বুদ্ধির অগোচর। অথবা রাজা যেমন, তাঁহার অর্ঘকারকও তেমন-যোগ্যং যোগেন যোজয়েৎ।
তখন বোধিসত্ত্ব এই গাথা করিলেন :
উপকণ্ঠসহ বারাণসীধাম, মূল্য তার কত হয়?
নালীকা পূরিতে যে তণ্ডুল চাই; তার বেশী কভু নয়।
আশ্চর্য্য ব্যাপার শুন আর বায়, পঞ্চশত অশ্ব-মূল্য :
তাও নাকি ঠিক সেই মত এক তণ্ডুলনালিকা তুল্য!
সর্ব্বসমক্ষে এইরূপ অপদস্থ হইয়া রাজা তন্মুহূর্ত্তেই সেই পাড়াগেঁয়ে লোকটীকে তল্পীতাড়া লইয়া প্রস্থান করিতে বলিলেন এবং বোধিসত্ত্বকে অর্ঘকারকের পদে প্রতিষ্ঠাপিত করিলেন। অনন্তর বোধিসত্ত্ব জীবনাবসানে কর্ম্মানুরূপ ফলভোগার্থ লোকান্তর গমন করিলেন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।