দশম অধ্যায়: স্বাধীনতা ও নম্রতা
নিজেকে
হাসা- ১৬০
নবীন স্কুলশিক্ষক হিসেবে আমার পাওয়া সেরা
উপদেশগুলোর একটি হচ্ছে যখন আপনি একটি ভুল করবেন আর পুরো ক্লাস আপনাকে হাসা শুরু করবে,
তখন আপনিও হাসুন। এতে করে আপনার ছাত্ররা আর কখনোই আপনাকে হাসছে না, হাসছে আপনার সাথে
সাথে।
অনেক বছর পরে, পার্থে একজন শিক্ষক ভিক্ষু
হিসেবে আমাকে হাইস্কুলগুলোতে ডাকা হতো বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। পশ্চিমা
স্কুলপড়ুয়া কিশোর কিশোরীরা আমাকে লজ্জা দিয়ে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতো। একবার বৌদ্ধ
সংস্কৃতির উপরে একটা ক্লাস শেষে আমি প্রশ্ন আহ্বান করলাম তাদের কাছ থেকে। একজন চৌদ্দ
বছরের কিশোরী তার হাত তুললো এবং জিজ্ঞেস করলো: ‘মেয়েরা কী তাহলে তোমার মধ্যে যৌন কামনা
জাগিয়ে তোলে?’
সৌভাগ্যবশত, ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা
আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে এল আর এভাবে তাদের সবাইকে লজ্জা দেওয়ার জন্য বকা দিল। আমি হাসলাম
আর পরবর্তী দেশনার বিষয়বস্তু হিসেবে মনে মনে ব্যাপারটা নোট করে নিলাম।
অন্য এক সময় আমি একটা মেইন রোড ধরে হাঁটছিলাম।
এই সময় কয়েকজন স্কুলছাত্রী এগিয়ে এল আমার দিকে।
‘হাই!’ তারা খুব বন্ধুভাবাপন্ন স্বরে
আমাকে বললো, ‘আমাদেরকে মনে আছে তোমার? কয়েকদিন আগে তুমি আমাদের স্কুলে একটা বক্তৃতা
দিতে এসেছিলে।’
‘আমি আনন্দিত ও গর্বিত যে তোমরা আমাকে
মনে রেখেছো।’ আমি উত্তর দিলাম।
’আমরা তোমাকে কখনোই ভুলবো না,’ তাদের
মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘কী করে আমরা এমন সন্ন্যাসীকে ভুলি যার নাম ‘ব্রা’!
#যে
কুকুরটি শেষ হাসি হেসেছিল- ১৬১
উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে ভিক্ষু হিসেবে
আমার প্রথম বছরটা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ বছর। আজান চাহএর বিহারের কাছেই আঞ্চলিক
শহর উবনের নিকটে একটা আমেরিকান বিমান ঘাঁটি ছিল। আজান চাহ তখন কী করে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের
সাথে ডিল করতে হয় তা বলতে গিয়ে আমাদেরকে নিচের সত্যি কাহিনীটি শোনাতেন।
এক আমেরিকান যোদ্ধা বিমান ঘাঁটি থেকে
রিক্সায় করে শহরে যাচ্ছিল। শহরের সীমানায় রাস্তার পাশে একটা মদের দোকানের সামনে রিক্সাওয়ালার
কয়েকজন বন্ধু বসেছিল অর্ধমাতাল অবস্থায়।
’এই যে!’ তারা থাই ভাষায় চিৎকার করলো,
‘তুমি এই নোংরা কুকুরটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’ এই বলে তারা আমেরিকান সৈন্যটাকে দেখিয়ে
হাসিতে ফেটে পড়ল।
রিক্সাওয়ালাটিও কিছুটা মজা করার আশায়
চিৎকার করে জবাব দিল, ‘আমি এই নোংরা কুকুরটিকে চাঁদের নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছি
যাতে সে একটা গোসল দিয়ে পরিষ্কার হতে পারে!’
রিক্সাওয়ালা ও তার মাতাল বন্ধুরা হাসলো,
সৈন্যটি অভিব্যক্তিহীন।
গন্তব্যে পৌঁছে সৈন্যটি ভাড়া নেওয়ার জন্য
হাত পাতলো। কিন্তু আমেরিকান সৈন্যটি নিরবে চলে যেতে লাগল। রিক্সাওয়ালা উত্তেজিত হয়ে
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলে উঠল, ‘হেই! স্যার! আপনি আমাকে ডলার দিন!’
বিশালদেহী আমেরিকান তখন শান্তভাবে ঘুরে
দাঁড়ালো, আর থাই ভাষায় সাবলীলভাবে বললো, ‘কুকুরদের কোন টাকা থাকে না।’
#বিদ্রুপ
এবং অর্হত্ব- ১৬২
অভিজ্ঞ ধ্যান শিক্ষকদেরকে প্রায়ই এমন
সব শিষ্যদের মোকাবেলা করতে হয় যারা মনে করে তারা অর্হৎ হয়ে গেছে। তাদের এমন দাবি সত্যি
কিনা তা যাচাই করার জন্য একটা পদ্ধতি হচ্ছে শিষ্যটাকে এমন বিদ্রুপ করা যাতে করে সে
রেগে যায়। সব বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী জানে যে, বুদ্ধ স্পষ্ট বলে গেছেন, যে রেগে যায়
সে নিশ্চিতই অর্হৎ নয়।
একজন তরুণ জাপানী ভিক্ষু, যে এই জীবনেই
নির্বাণ লাভে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সে একটা বিখ্যাত বিহারের কাছেই অবস্থিত হ্রদের মধ্যস্থিত
একটি দ্বীপে নির্জনে ধ্যান সাধনা করছিল। সে জীবনের প্রথম ভাগেই নির্বাণ পেতে চায়, যাতে
করে পরবর্তীতে অন্যান্য কাজে মনেযোগ দিতে পারে।
বিহারের তত্ত্বাধায়ক তাকে রসদপত্র দেওয়ার
জন্য সপ্তাহে একবার যেত। একবার তরুণ ভিক্ষুটি একটি নোট লিখে দিল যে, তার কিছু দামী
কাগজ, একটা পালক ও কিছু ভালো মানের কালি লাগবে। সে শীঘ্রই তার নির্জনবাসের তিন বছর
পূর্ণ করতে যাচ্ছে। আর সে তার গুরুকে জানিয়ে দিতে চায় কতদূর এগিয়েছে সে তার সাধনায়।
পরের সপ্তাহে কাগজ, পালক ও কালি এসে গেল।
পরের কয়েকটা দিন অনেক ধ্যান ও গভীর চিন্তাভাবনা শেষে দামী কাগজের উপর সুন্দর ডিজাইনের
হাতের লেখায় সে নিচের ছোট্ট কবিতাটি লিখল:
‘বিবেকবান তরুণ ভিক্ষু,
তিন বছর ধরে একাকী ধ্যানরত;
তাকে আর টলাতে পারবে না,
চারি মহাবায়ুও।’
সে
ভাবল, এই কথাগুলো পড়লে এবং এমন যতœ নিয়ে লেখা স্টাইল দেখলে নিশ্চিতই তার বিজ্ঞ বুড়ো
অধ্যক্ষ বুঝতে পাবে যে তার শিষ্য এখন অর্হৎ। সে আলতো করে কাগজটা গুটিয়ে নিল। ফিতে নিয়ে
যতœ করে এটাকে বাঁধল আর এটাকে তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে অধ্যক্ষের কাছে পাঠানোর জন্য
অপেক্ষা করতে লাগল।
এর পরবর্তী দিনগুলোতে সে কল্পনা করতে
লাগলো, এমন নিখুঁতভাবে লেখা বুদ্ধিদীপ্ত কবিতা পড়ে তার অধ্যক্ষ কীরূপ আনন্দ পাবে। সে
কল্পনার চোখে দেখতে পেল, এটিকে একটি দামী ফ্রেমে বাঁধাই করে বিহারের প্রধান কক্ষে টাঙিয়ে
রাখা হয়েছে। কোন সন্দেহ নেই, এবার তারা তাকে কোন বিখ্যাত শহরের অধ্যক্ষ বানাতে চাইবে।
পরের বার তত্ত্বাবধায়ক যখন তার সাপ্তাহিক রসদ পৌঁছে দিতে আসলো, তরুণ ভিক্ষুটি তখন তার
জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল। তত্ত্বাবধায়ক তার হাতে তুলে দিল আরেকটা রোল করা কাগজ,
সে যে কাগজটা পাঠিয়েছে তার মতোই কিন্তু অন্য রঙের ফিতা দিয়ে বাঁধা। ‘অধ্যক্ষের কাছ
থেকে’ তত্ত্বাবধায়ক তীক্ষ্ণ সুরে বললো।
ভিক্ষুটি উত্তেজিত হয়ে ফিতেটি ছিড়ে কাগজটি
বিছিয়ে নিল। তার চোখগুলো কাগজটি পড়তে পড়তে চাঁদের মতো চওড়া হয়ে উঠলো আর মুখটা ফ্যাকাশে
হয়ে গেল। এটা তার নিজেরই পাঠানো কাগজ, যেখানে তার এত সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা লাইনের
পাশে অধ্যক্ষ লাল কালিতে অবহেলাভরে লিখে দিয়েছেন, ‘পাদ!’ দ্বিতীয় লাইনের পাশেও আরেকটা
জঘন্য লাল কালির ‘পাদ!’ তৃতিীয় লাইনেও আছে এমন ‘পাদ!’ এমনটা আছে চতুর্থ লাইনের পাশেও।
যথেষ্ট হয়েছে! এই জরাজীর্ণ বুড়ো অধ্যক্ষ
এমন বোকা যে তার নাকের ডগায় লেখা থাকা নির্বাণকেও সে চিনল না। আর সে এমন অমার্জিত ও
অসভ্য যে এত সুন্দর একটা শিল্পকে অশ্লীল আঁকিবুকি
করে নষ্ট করে দিল। অধ্যক্ষ উচ্ছৃঙ্খল ছেলের মত আচরণ করছে, ভিক্ষুর মত নয়। এটা শিল্পের
অপমান, ঐতিহ্যের অপমান, সত্যের অপমান।
তরুণ ভিক্ষুর চোখ রাগে ছোট হয়ে এল। তার
মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। সে ফোঁস ফোস করে তত্ত্বাবধায়ককে বললো, ‘আমাকে অধ্যক্ষের কাছে
নিয়ে যাও! এক্ষুনি!’
তিনবছরের মধ্যে এই প্রথম তরুণ ভিক্ষুটি
তার দ্বীপাশ্রমের বাইরে পা দিল। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সে অধ্যক্ষের রুমে ঝড়ো হাওয়ার বেগে
প্রবেশ করল, কাগজটা টেবিলের উপর বিছাল এবং এর ব্যাখ্যা দাবি করল।
অভিজ্ঞ অধ্যক্ষ ধীরে সুস্থে কাগজটা তুলে
নিল, গলা খাঁকারি দিল এবং কবিতাটা পড়ল:
বিবেকবান তরুণ ভিক্ষু,
তিন বছর ধরে একাকী ধ্যানরত,
তাকে আর টলাতে পারবে না,
চারি মহাবায়ুও।
এরপর
সে কাগজটা নামিয়ে রাখল আর তরুণ ভিক্ষুটির দিকে চেয়ে বলল, ‘হুম! তো, তরুণ ভিক্ষু! চারি
মহাবায়ুও তোমাকে নড়াতে পারে না। অথচ চারটা ছোট্ট পাদ তোমাকে হ্রদের এপারে উড়িয়ে নিয়ে
এল!’
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।