দশম অধ্যায়: স্বাধীনতা ও নম্রতা
#যখন
আমি অর্হৎ হলাম- ১৬৪
থাইল্যান্ডে আমার ভিক্ষু হওয়ার চতুর্থ
বছরে উত্তর পূর্বাঞ্চলে একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বনবিহারে দীর্ঘদিন ধরে কঠোর সাধনা করছিলাম
আমি। এক রাতে দীর্ঘক্ষণ চংক্রমণের সময়ে আমার মন অস্বাভাবিক পরিষ্কার হয়ে উঠল। গভীর
অন্তর্দৃষ্টি আসলো যেন পাহাড়ী ঝরণা ধারার মতো। যে নিগূঢ় রহস্যগুলোর আগে কোন কুল কিনারা
পাই নি, সেগুলোই আজ খুব সহজে বুঝতে পারছিলাম আমি। এরপরে একটা কিছু আসলো। এটাআমাকে উড়িয়ে
নিয়ে গেল। এটাই সেটা। অর্হত্ব।
এমন সুখ আগে কখনো পাই নি। এত সুখ, অথচ
এত শান্তি। আমি গভীর রাত পর্যন্ত ধ্যান করলাম, ঘুমালাম খুব কম, ৩টার ঘন্টা বাজার অনেক
আগেই বিহারের হলরুমে গিয়ে ধ্যান শুরু করলাম আবার। সাধারণত রাত ৩টায় থাইল্যান্ডের এমন
গরম ও ভ্যাপসা জঙ্গলে আমাকে অলসতা ও ঘুমের সাথে লড়তে হতো। কিন্তু এই সকালটা তেমন নয়।
আমার দেহটা বিনা চেষ্টাতেই খাড়া। স্মৃতি ডাক্তারদের
ক্ষুরের মত ধারাল। মনোযোগ সহজেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। অর্হৎ হওয়া এমন চমৎকার। তবে দুঃখের
বিষয় এটা বেশিক্ষণ থাকে নি।
তখনকার দিনে উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে খাবার
দাবার ছিল জঘন্য। উদাহরণস্বরূপ একবার দিনে যে একবেলা খেতাম, তাতে পেলাম আঠালো ভাতের
একটা দলা, আর তার উপরে অর্ধ সেদ্ধ মাঝারি সাইজের একটা ব্যাঙ। কোন শাকসবজি নেই, ফলমূল
নেই, শুধু ব্যাঙ-ভাত। তাই দিয়ে সারা দিন কাটাতে হবে। আমি পায়ের মাংসগুলো দিয়ে শুরু
করলাম । এরপরে ব্যাঙের ভেতরের অংশগুলো। আমার পাশেই এক ভিক্ষু ব্যাঙের আতুড়িগুলো নিয়ে
খাওয়া শুরু করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত ব্যাঙের মুত্রথলিতে চাপ পড়ল। মুত্রথলিতে তখনো মূত্র
ছিল। এতে করে ব্যাঙটা তার ভাতের উপর প্রস্রাব করে দিল। ফলে খাওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য
হলো সে।
সাধারণত আমাদের প্রতিদিনের প্রধান তরকারি
ছিল পঁচামাছের ঝোল। ছোট ছোট মাছগুলো বর্ষাকালে ধরা হয়। আর মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করে
রাখা হয় এবং সেখান থেকে সারা বছর ধরে ব্যবহার করা হয়। আমাদের বিহারের রান্নাঘর পরিষ্কার
করার সময় আমি এরকম একটা মাটির পাত্র পেয়েছিলাম। এটি শুককীটে কিলবিল করছিল। তাই আমি
এটাকে ছুঁড়ে মারতে গেলাম। সেই গ্রামের হেডম্যান, যে ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত
ও রুচিসম্পন্ন, সে আমাকে এটা ফেলে দিতে মানা করল।
‘কিন্তু এটা তো শুককীটে পরিপূর্ণ!’ আমি
বললাম।
’সেটা আরো বেশি মজাদার!’ সে জবাব দিল।
আার আমার কাছ থেকে পাত্রটা নিয়ে নিল।
পরের দিন আমরা সেই পঁচা মাছের ঝোল খেলাম
আমাদের দৈনিক একবেলা খাবারে। আমার অর্হত্বের পরের দিন অবাক হয়ে দেখলাম আঠালো ভাতের
সাথে দুই সসপ্যান ঝোল। একটাতে ছিল সেই দুর্গন্ধযুক্ত পঁচা মাছের ঝোল, আরেকটাতে শুকরের
মাংসের ঝোল। আমি ভাবলাম, আজকে আমার অর্হত্বের উদযাপন উপলক্ষে ভালো একটা খানা খাব।
আমার আগে অধ্যক্ষ সেই খাবারগুলো পছন্দ
করলেন। তিনি বড় চামচে করে তিন চামচ সেই সুস্বাদু শুকরের মাংসের ঝোল নিলেন - পেটুক।
তবে এরপরেও আমার জন্য প্রচুর থাকলো। কিন্তু সসপ্যানটা আমার কাছে দেওয়ার আগে তিনি আমার
সেই জিভে জল এনে দেওয়া শুকরের মাংসের ঝোলকে ঢেলে দিলেন পঁচা মাছের ঝোলের মধ্যে। এরপরে
তিনি সেই ঝোলটা নেড়েচেড়ে মিশিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সবই তো একই!’
আমি হতবাক। রাগে ফুঁসছি। ভীষণ রেগে গেছি।
যদি তিনি সত্যিই ভাবতেন, ‘সবই তো একই’ তাহলে কেন বড় বড় তিন চামচ শুকরের মাংসের
ঝোল নিতে গেলেন মিশিয়ে দেওয়ার আগে? ভন্ড! তারচেয়ে বড় কথা, তিনি তো এখানকারই ছেলে। বড়
হয়েছেন এমন দুর্গন্ধযুক্ত পঁচা মাছের ঝোল খেয়ে। তার তো সেটাকেই পছন্দ করা উচিত। নকল!
শুয়োর! প্রতারক!
এরপরে উপলদ্ধি আমাকে আঘাত করল। অর্হতদের
খাবার দাবারের উপরে কোন বাছবিচার থাকে না। তারা ক্রুদ্ধও হয় না আর তাদের অধ্যক্ষকে
শুয়োর বলেও ডাকে না, যদিও তা চাপা স্বরে। আমি সত্যিই খুব রেগে গিয়েছিলাম। আর তার মানে
হচ্ছে ... ওহ না! .. আমি অর্হৎ হই নি।
তৎক্ষণাৎ আমার রাগের আগুন চাপা পড়ে গেল
বিষণœতার ভারে। হতাশার ভারী কালো মেঘে ছেয়ে গেল আমার হৃদয়ের আকাশ, যা আমার অর্হত্বের
সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিল। মনমরা হয়ে আমি দুই চামচ দুর্গন্ধযুক্ত পঁচা মাছের ঝোল ও
শুয়োরের ঝোলের মিশ্রণ ঢাললাম ভাতের উপর। কী খাচ্ছি, তাতে এখন আমার আর কিচ্ছু আসে যায়
না। আমি এমন নিরাশ হয়ে গেলাম। আমি যে অর্হৎ নই, তা জেনে আমার পুরো দিনটাই মাটি হয়ে
গেল।
রাস্তার
শুয়োর - ১৬৬
শুয়োর বিষয়ে আরেকটা গল্প। একজন ধনী বিশেষজ্ঞ
ডাক্তার নতুন একটা খুব দামী ও শক্তিশালী স্পোর্টস কার কিনেছে। আপনি অবশ্যই শহরের ধীরগতিতে
চলা যানবাহনের ভিড়ে চালানোর জন্য এত দাম দিয়ে এমন শক্তিশালী গাড়ি কিনবেন না। তাই এক
রোদেলা দিনে সে শহর থেকে বেরিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরা গ্রামের দিকে রওনা দিল। স্পীড
ক্যামেরা নেই এমন জায়গায় গিয়ে সে জোরে একসিলারেটরে চাপ দিল। গর্জে উঠল তার স্পোর্টস
কার। গাড়ির ইঞ্জিন বিশাল শব্দে গর্জে উঠছে আর গ্রামের রাস্তায় সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে
তার চকচকে গাড়ি। দ্রুত গতির উল্লাসে হাসিতে ফেটে পড়ল ডাক্তার।
রোদে পোড়া একজন কৃষক কিন্তু এতটা উল্লসিত
ছিল না। স্পোর্টস কারের গর্জন ছাড়িয়ে শোনা যায় মত করে সে চিৎকার করল, ‘শুয়োর!’
ডাক্তার জানতো যে, সে যেভাবে চালাচ্ছে
তা চারপাশের পরিবেশের সাথে বেমানান। কিন্তু সে ভাবল, ‘চুলোয় যাক ব্যাটা! আমার নিজেকে
উপভোগ করার অধিকার আছে।’
তাই সে কৃষকের দিকে ফিরে চিৎকার করলো,
‘কাকে শুয়োর বলছো তুমি?’
যে কয়েক সেকেন্ড সে রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে
নিয়েছিল, এর মাঝেই তার গাড়িটা রাস্তার মাঝখানে একটা শুয়োরকে চাপা দিল।
নতুন ব্রান্ডের স্পোর্টস কার পুরো বিধ্বস্ত
হলো। আর শুয়োরটা, তাকে অনেক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হলো আর অনেক টাকা গচ্চা দিতে হলো,
তার গাড়ির সাথে সাথে।
#হরে
কৃষ্ণ- ১৬৭
আগের গল্পে ডাক্তারের অহমিকার ফলে দয়ালু
হৃদয়ের কৃষকের সতর্কবাণীকে সে ভুলভাবে বিচার করেছিল। নিচের গল্পে আমার ভিক্ষুর অহমিকার
ফলে অন্য এক দয়ালু হৃদয়ের ব্যক্তিকে আমি ভুলভাবে বিচার করেছিলাম, যা পরে আমার বেশ মনোঃকষ্টের
কারণ হয়েছিল।
আমি লন্ডনে আমার মায়ের সাথে দেখা করে
ফিরছিলাম। সে আমার সাথেই আসছিল ইয়েলিং ব্রডওয়ে রেলস্টেশনে, আমাকে টিকেটের ব্যাপারে
সাহায্য করতে। স্টেশনে যাওয়ার পথে, সেই ব্যস্ত রাজপথে আমি শুনলাম, কেউ আমাকে ঠাট্টা
করে বলছে, ‘হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!’
ন্যাড়া মাথা ও বাদামী চীবর পরা বৌদ্ধ
ভিক্ষু হওয়াতে প্রায়ই আমাকে ‘কৃষ্ণ চেতনা আন্দোলনের’ সমর্থক বলে মনে করে সবাই। অস্ট্রেলিয়ায়
অনেকবার আমাকে অভদ্র ব্যক্তিরা ‘হরে কৃষ্ণ, এই যে হরে কৃষ্ণ!’ বলে উত্যক্ত
করার চেষ্টা করেছে নিরাপদ দূরত্ব থেকে আর আমার চেহারা নকল করেছে। আমি দ্রুত খুঁজে নিলাম
‘হরে কৃষ্ণ’ বলে চিৎকার দেওয়া লোকটাকে আর সিদ্ধান্ত নিলাম একজন ভালো
বৌদ্ধ ভিক্ষুকে প্রকাশ্যে এভাবে বিদ্রুপ করাটা ঠিক নয় বলে তাকে জানিয়ে দিতে হবে।
আমার মা আমার ঠিক পিছনে ছিল। আমি সেই
জিনস, জ্যাকেট ও ন্যাড়া মাথার সেই তরুণটিকে বললাম, ‘দেখো বন্ধু, আমি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু।
আমি কোন ‘হরে কৃষ্ণ’ সমর্থক নই। তোমার এটা ভালো জানা উচিত।
তুমি শুধু আমাকেই ‘হরে কৃষ্ণ’ বলছো, তা তো ঠিক নয়!’
তরুণটি হেসে তার টাক খুলে ফেলল। ফলে টাকমাথার
আড়াল থেকে লম্বা বেণী করা চুল বেরিয়ে এল। ‘হ্যাঁ, আমি জানি তুমি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু।
আমি একজন হরে কৃষ্ণ। হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!’
সে আমাকে ঠাট্টা করছে না। সে শুধু তার
হরে কৃষ্ণই করছে। আমি খুব বিব্রত বোধ করলাম। কেন শুধু মা সাথে থাকলেই এমন জিনিস ঘটে?
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।