হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-৪৭) দশম অধ্যায়

দশম অধ্যায়: স্বাধীনতা ও নম্রতা



#এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাথে রাতের ভোজ- ১৫৭
আমার বিহারের কঠিন কঠোর জীবনের কথা বিবেচনা করে আমি এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্থানীয় গ্রপের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে খুব সতর্ক। তাই বিশ্ব মানবাধিকার সনদের পঞ্চশতম পূর্তি উপলক্ষে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আয়োজিত  একটি ডিনারের আমন্ত্রণে আমি তাদেরকে নিচের চিঠিটা লিখলাম।
প্রিয় জুলিয়া, প্রচার সম্পাদক,
৩০শে মে, শনিবারের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষনাপত্রের পঞ্চাশতম পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত রাতের ভোজসভায় আমন্ত্রণের জন্য তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। এমন অনুষ্ঠানে যোগ দানের আমন্ত্রণ পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত।
তবে কথা হলো, আমি থেরবাদী মতাদর্শের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু, যে মতাদর্শে খুব কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত, এই নিয়ম আমাকে দুপুর হতে পরের দিন ভোর হওয়া পর্যন্ত সময়টাতে খেতে নিষেধ করে। হায়! এজন্যই ডিনারে আমি নেই! মদের বিষয়েও না- না। আর এটা সব ধরনের মদের বেলায় প্রযোজ্য। তোমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলে আমাকে খালি একটা প্লেট ও খালি একটা গ্লাস নিয়ে বসে থাকতে হবে, যেখানে চারপাশের সবাই তৃপ্তির সাথে খানাপিনায় ব্যস্ত থাকবে। আমি নিশ্চিত, এমন খানাপিনা নিশ্চয়ই মুখরোচক হবে। সবাই খাবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব, তা হবে আমার উপর এক ধরনের নির্যাতন, যা তোমরা, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশাল নিশ্চয়ই সহ্য করবে না।
তাছাড়া, বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে আমি টাকা পয়সা গ্রহণও করতে পারি না, রাখতেও পারি না। আমি দারিদ্র্য সীমার এত নীচে বাস করি যে, অনেক সরকারী পরিসংখ্যান আমি লেজে গোবরে করে ফেলি! তাই সেই ডিনারের পয়সা দেওয়ার আমার কোন উপায় নেই, আর তা আমি খেতেও পারবো না কোনমতে।
আমি আরো বলতে যাচ্ছিলাম, এমন অনুষ্ঠানে পোশাক পরিচ্ছদের যে একটা নিয়ম আছে, ড্রেস কোড আছে, তাতেও আমার মতো একজন ভিক্ষুর সমস্যায় পড়ে যেতে হবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমি অনেক বলে ফেলেছি। তাই বিনীতভাবে এই বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে, আমি ডিনারে উপস্থিত থাকতে পারবো না।
দারিদ্র্যের মাঝে সুখে থাকা, তোমারই,
ব্রাহম্

#একজন ভিক্ষুর পোশাকের নিয়ম – ১৫৮#
আমার মতাদর্শের ভিক্ষুরা বাদামী চীবর পরে। আর আমাদের এটা বাদে আর কিছু নেই। কয়েক বছর আগে, আমাকে কয়েকদিনের জন্য একটি অস্ট্রেলিয়ান হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমি আমার প্যান্ট এনেছি কিনা। আমি বললাম যে ভিক্ষুরা প্যান্ট পরে না। তারা হয় এই চীবর পরবে আর না হলে কিছুই পরবে না! তাই তারা আমাকে চীবর পরতে দিল।
সমস্যা হচ্ছে যে ভিক্ষুদের ড্রেসটা আসলেই একটা ড্রেসের মতো দেখায়।
এক রবিবার বিকেলে পার্থ শহরের উপকণ্ঠে আমি আমাদের বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজের মালপত্রগুলো তুলছিলাম আমাদের বিহারের গাড়িতে। কাছের এক বাড়ি থেকে তের বছর বয়সের এক অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে আমার সাথে কথা বলতে এলো। সে এর আগে কখনোই কোন বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখে নি।
আমার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আমার পুরো আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলো পরম অবজ্ঞার সাথে। তারপর সে বিরক্তভরা কণ্ঠে আমাকে বিদ্রুপ করা শুরু করলো: ‘তুমি তো মেয়েদের পোশাক পরেছো! কী জঘন্য! ওয়াক!’
সে এমনভাবে কথাগুলো বললো যে আমি না হেসে পারলাম না। আমার গুরু আজান চাহর কথা মনে পড়ল। তিনি তার শিষ্যদেরকে উপদেশ দিতেন কী করে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের প্রতি সাড়া দিতে হয়। ‘যদি কেউ তোমাকে কুকুর বলে, তাতে রাগ করো না। তার বদলে তোমার পিছনে নীচের দিকে তাকাও। যদি সেখানে কোন লেজ দেখতে না পাও, তার মানে হচ্ছে তুমি কুকুর নও। সমস্যা খতম।
মাঝে মাঝে আমি জনসমক্ষে চীবর পরার জন্য প্রশংসাও পাই। একবার যদিও এটা আমাকে বেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
আমার তখন শহরে কাজ ছিল। আমার ড্রাইভার (ভিক্ষুদের গাড়ি চালানো নিষেধ) আমাদের বিহারের গাড়িটাকে একটা বহুতল গাড়ি পার্কিং এ রাখল। সে ঘোষণা করলো যে তাকে এখুনি টয়লেটে যেতে হবে। কিন্তু গাড়ি পার্কিংয়ের টয়লেটগুলো নোংরা মনে করাতে সে নিকটস্থ সিনেমা হলের টয়লেট ব্যবহার করতে চায়। অতএব, সে যখন ভেতরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ব্যস্ত, আমি তখন সিনেমা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি ব্যস্ত সড়কের উপর আমার ভিক্ষু ড্রেস পরে।
এক তরুণ আমার কাছে এসে মিষ্টি করে হাসল, আর বললো আমার সময় আছে কিনা। আমার মতো ভিক্ষুরা খুব সহজ সরল হয়। আমি জীবনের বেশিরভাগ সময় বৌদ্ধ বিহারে কাটিয়েছি। তাছাড়া ভিক্ষুরা কোন ঘড়ি পরে না। তাই আমাকে নম্রভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হলো যে আমার সময় জানা নেই। সে ভ্রুকুটি করে হাঁটতে শুরু করলো।
কয়েক কদম যাওয়ার পরেই হঠাৎ আমার উপলদ্ধি হলো তরুণটি কী বুঝাতে চেয়েছে:তোমার কী সময় আছে?’ এটা সম্ভবত যে কোন বইয়ের সবচেয়ে পুরনো ডেটিংয়ে আমন্ত্রণের কথা। আমি পরে জেনেছিলাম যে, আমি যে জায়গাতে দাঁড়িয়েছিলাম, তা হচ্ছে পার্থে সমকামী পুরুষদের দেখা করার জনপ্রিয় জায়গাগুলোর একটি!
সেই সমকামী তরুণটি ফিরে এসে আরেকবার আমাকে নিরীক্ষণ করে বললো, তার শ্রেষ্ঠ মেরিলিন মনরোর কন্ঠে: ‘ওহ, তোমাকে কিন্তু এমন পোশাকে সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে!’
আমি স্বীকার করছি যে ঐ সময় আমি ঘামতে শুরু করেছিলাম। তখনই সিনেমা হলের ভেতর থেকে আমার ড্রাইভার এসে আমাকে উদ্ধার করলো। তখন থেকে আমরা গাড়ি পার্কিংয়ের টয়লেটগুলো ব্যবহার করি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !