নবম অধ্যায়: মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক জীবন
#তখনই
আমি সুখী হব- ১৪৬
সম্ভবত আগে ভাগেই আমাদের জগে যে সবচেয়ে
মহামূল্যবান পাথরটি ভরা উচিত তা হচ্ছে অন্তরের সুখ। আমাদের ভেতরে যখন কোন সুখ থাকে
না, অন্যকে দেওয়ার মত সুখও তখন আমাদের থাকে না। তাহলে কেন বেশির ভাগ লোক সুখটাকে সবচেয়ে
কম গুরুত্ব দেয়? একেবারে জীবনের শেষ সীমায় গিয়ে তবেই পেতে চায়? (অথবা একেবারে শেষ সীমা
ছাড়িয়ে তবেই সুখ চায়, যেমনটি ঘটেছে নিচের গল্পে)
আমার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন আমি লন্ডনের
এক হাইস্কুলে ও-লেভেল [এসএসসি] পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করছিলাম। আমার বাবা মা ও শিক্ষকেরা
আমাকে সন্ধ্যাবেলা ও সাপ্তাহিক ছুটিগুলোতে খেলা বন্ধ করতে উপদেশ দিলেন। তার চেয়ে আমি
যেন বাড়িতে থাকি আর পড়াশুনার পেছনে সময়টা দিই। তারা আমাকে ব্যাখ্যা করলেন ও-লেভেল পরীক্ষাটা
কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আর তাতে যদি ভালো করি, তাহলে আমিই সুখী হব।
আমি তাদের উপদেশ অনুসরণ করলাম আর পরীক্ষাতেও
খুব ভালো করলাম। কিন্তু এটা আমাকে অতটা সুখী বানালো না, কেননা এই সাফল্যের ফলে আমাকে
এর চেয়েও কঠোরভাবে পড়াশুনা করতে হবে আরো দুবছরের জন্য, এ-লেভেল পরীক্ষার প্রস্তুতির
জন্য।
আমার বাবা মা ও শিক্ষকেরা এবার আমাকে
সন্ধ্যায় ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে মেয়েদের পিছনে ছুটতে মানা করলেন। তার চেয়ে আমি
যেন সময়টা বাড়িতে পড়াশুনা করে কাটাই। তারা আমাকে বুঝিয়ে বললেন, এ-লেভেল পরীক্ষাটা কতটা
গুরুত্বপূর্ণ, আর এমন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাতে যদি আমি ভালো করি, তাহলে আমিই নাকি খুশি
হব।
আরেকবার আমি তাদের উপদেশ মাথা পেতে নিলাম
আর পরীক্ষায়ও খুব ভালো করলাম। আরেকবার আমি খুব সুখী হতে পারলাম না। কারণ এখন আমাকে
সবচেয়ে বেশি করে পড়াশোনা করতে হবে, আরো তিনটি দীর্ঘ বছর ধরে ইউনিভার্সিটিতে একটি ডিগ্রির
জন্য।
আমার মা ও শিক্ষকেরা (বাবা তখন মারা গেছেন)
আমাকে মদের দোকান ও কলেজের পার্টি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিলেন। তার বদলে পড়াশোনায়
আরো কঠোর শ্রম দিতে বললেন। তারা আমাকে বললেন একটা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি যদি এতে ভালো করি, তাহলে আমি খুব সুখী হব।
এই পর্যায়ে এসে আমার একটু একটু সন্দেহ
হতে লাগলো।
আমি আমার সিনিয়র কয়েকজন বন্ধুকে দেখলাম
যারা খুব কঠোর পরিশ্রম করেছে আর ডিগ্রি জুটিয়েছে। এখন তারা আরো কঠোর পরিশ্রম করছে তাদের
প্রথম চাকরিতে। তারা চুড়ান্ত পরিশ্রম করে চলেছে টাকা জমা করার জন্য, যাতে সেই টাকা
দিয়ে তারা কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কিনতে পারে, যেমন ধরুন একটা গাড়ি। তারা আমাকে
বলত - ‘যখন একটা গাড়ি কেনার মতো যথেষ্ট টাকা হবে, তখন আমি সুখী হব।’
যখন তাদের যথেষ্ট টাকা হয়েছে আর গাড়িও
কিনে ফেলেছে, তাতেও তারা সুখী নয়। তখন তারা আরো পরিশ্রম করছে অন্য একটা কিছু কেনার
জন্য, যাতে তারা সুখী হবে। অথবা তারা এক জীবনসঙ্গীকে খুঁজতে গিয়ে রোমান্সের ঝড়ে হাবুডুবু
খাচ্ছে। তারা বলত, ‘যখন আমি বিয়ে করে কোথাও থিতু হব, তখনই আমি সুখী হব।‘
বিয়ে করেও তারা সুখী হয় নি। তাদেরকে আরো
পরিশ্রম করতে হয়েছে, এমনকি এক্সট্রা কাজও করতে হয়েছে, যাতে তারা কোন একটা এপার্টমেন্ট
বা ছোট একটা বাড়ি কেনার জন্য যথেষ্ট টাকা জমাতে পারে। তারা বলত, ‘যখন আমাদের নিজস্ব
একটা বাড়ি হবে, তখন আমরা সুখী হবো।’
দুঃখের বিষয়, বাড়ির লোনের জন্য মাসে মাসে
তাদের বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হত, যা তাদের সুখী করলো না। তার চেয়েও বড় কথা, এখন
তারা একটা পরিবার শুরু করতে যাচ্ছে। এখন তাদের বাচ্চা হবে। বাচ্চারা রাতে তাদেরকে ঘুম
থেকে জাগাবে। তাদের জমানো টাকার সবটুকু খরচ হয়ে যাবে বাচ্চাদের পিছনে। আর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা
বেড়ে যাবে লাফিয়ে লাফিয়ে, সীমা ছাড়িয়ে। এখন তারা যা চায় তা করার জন্য আরো অন্তত বিশ
বছর লাগবে। তাই তারা আমাকে বলত, ‘যখন ছেলেমেয়েরা বড় হবে, বাড়ি থেকে বেরোবে, কোথাও থিতু
হবে, তখনই আমরা সুখী হব।’
ছেলেমেয়েরা যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে,
বেশির ভাগ বাবা মা তখন অবসরের অপেক্ষায় থাকে। তাই তারা তাদের সুখকে আরো পিছিয়ে দেয়,
তার বদলে তারা বৃদ্ধ বয়সের জন্য টাকা জমা করতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকে। তারা বলে,
‘যখন আমি অবসরে যাব, তখনই আমি সুখী হব।’
অবসরের পরে তো বটেই, এর আগে থেকেই তারা
একটু একটু ধার্মিক হতে থাকে আর চার্চে যাওয়া শুরু করে দেয়। আপনি কি খেয়াল করেছেন, কত
জন বৃদ্ধ লোক চার্চের বেঞ্চিগুলো জুড়ে থাকে? আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করতাম কেন তারা এখন
চার্চে যাচ্ছে? তারা আমাকে বলত, ‘কারণ যখন আমি মরব, তখনই আমি সুখী হব!’
যারা একথা বিশ্বাস করে যে, ‘যখন আমি এটা
পাব, তখনই আমি সুখী হব’ তাদের সুখ কেবল ভবিষ্যতের স্বপ্ন মাত্র।
এটি যেন একটা রংধনুর মতো। মাত্র দুই তিন পা পেরোলেই ধরা ছোঁয়া যাবে এমন। অথচ সেটা
থাকে সবসময়ই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তারা তাদের জীবনে অথবা এর পরে কখনোই সুখ পাবে না।
মেক্সিকান
জেলে- ১৪৮
এক নিরিবিলি মেক্সিকান জেলেপাড়ায় ছুটি
কাটাতে গিয়েছিল এক আমেরিকান। সে এক স্থানীয় জেলেকে দেখছিল যে তার সকালে ধরা মাছগুলো
নৌকা থেকে তীরে নামিয়ে রাখছে। আমেরিকানটা ছিল আমেরিকার এক নামী দামী বিজনেস স্কুলের
সফল একজন প্রফেসর। সে বেচারা মেক্সিকান জেলেকে বিনামূল্যে কিছু উপদেশ না দিয়ে পারলো
না।
‘এই যে!’ আমেরিকানটা আলাপ শুরু করলো,
‘এত সকাল সকাল মাছ ধরা শেষ করছো যে?’
‘কারণ আমি যথেষ্ট মাছ ধরেছি, সিনর।’
জবাব দিল অমায়িক মেক্সিকান, ‘এতে আমার পরিবারের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট মাছ আছে। বাড়তি
সামান্য মাছ আমি বিক্রি করে দেব। এখন আমি আমার স্ত্রীসহ একসাথে দুপুরের খাবার খাব।
আর দুপুরে একটা ঘুম দিয়ে বিকেলে বাচ্চাদের সাথে খেলব। এরপর রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে একটু
পানশালায় যাব।
সেখানে বন্ধুদের সাথে সামান্য মদ পান
করব আর গীটার বাজাব। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট সিনর।’
‘বন্ধূ, আমার কথা শোন।’
প্রফেসর বলল, ‘তুমি যদি সাগরে বিকেল পর্যন্ত থাক, তাহলে সহজেই দ্বিগুণ মাছ ধরতে পারবে।
এই মাছগুলো বিক্রি করে টাকা জমাতে পারবে। ছয় মাস কি নয় মাসের মধ্যে তুমি সেই জমানো
টাকায় এর চেয়ে বড় ও ভালো একটা বোট কিনতে পারবে। সাথে দুএকজন লোকও ভাড়া করতে পারেবে।
তখন তুমি চারগুণ বেশি মাছ ধরতে পারবে। এ থেকে কী পরিমাণ লাভ হবে, একটু ভাবো তো! এক
কি দুই বছরের মাথায় আরেকটা মাছ ধরার বোট কিনে ফেলার মত টাকা হয়ে যাবে তোমার। সাথে আরো
লোকজন ভাড়া করতে পারবে। তুমি যদি এই ব্যবসার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করো, তাহলে ছয় কি
সাত বছরের মাথায় বিরাট একটা নৌকাবহরের মালিক হবে তুমি। একটু কল্পনা করে দেখো না!
তখন তুমি তোমার প্রধান কার্যালয়কে মেক্সিকো
সিটি অথবা লস এনজেলসে নিয়ে যাবে। সেখানে তিন চার বছর পরেই তুমি স্টক মার্কেটে তোমার
কোম্পানির শেয়ার ছাড়বে। সেই কোম্পানিতে তুমি হবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।
তোমার থাকবে মোটা অংকের বেতন, আর শেয়ারের সুবিধা।
এবার শোন! আরো কয়েক বছর বাদে তুমি তোমার কোম্পানীর শেয়ারগুলো কিনে ফেলবে ঝটপট, যা তোমাকে
ক্রোড়পতি বানিয়ে দেবে! এক্কেবারে গ্যারান্টি দিচ্ছি আমি! আমি আমেরিকার একটি বিজনেস
স্কুলের বিখ্যাত প্রফেসর। এসব ব্যাপার আমি ভালোই জানি।’
মেক্সিকান জেলে মন দিয়ে শুনল আমেরিকান
লোকটার কথা। যখন প্রফেসর তার কথা শেষ করল, তখন সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু সিনর প্রফেসর,
এত কোটি কোটি ডলার দিয়ে আমি কী করবো?’
অবাক করার মত ব্যাপার, আমেরিকান প্রফেসর
তার ব্যবসার পরিকল্পনায় এই ব্যাপারটা মাথায় রাখে নি। সে তাড়াতাড়ি ভেবে নিল কোটি কোটি
ডলার দিয়ে একজন মানুষ কী করবে।
‘এমিগো! এত টাকা হলে তুমি তখন অবসর নিতে
পারবে। জ্বি হ্যাঁ, সারা জীবনের জন্য আর কাজ করতে হবে না। তুমি ছোট একটা মনের মতো বাড়ি
কিনতে পারবে। ছবির মত সাজানো গোছানো এমন এক জেলে পল্লীতে। সকালে মাছ ধরার জন্য ছোট
একটা নৌকাও কিনতে পারবে তুমি। তোমার স্ত্রীর সাথে প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতে পারবে।
নির্ভাবনায় দুপুরর ঘুমটা সেরে নিতে পারবে। বিকেলে বাচ্চাদের সাথে দারুণ সময় কাটাতে
পারবে। আর সন্ধ্যায় খাওয়ার পরে বন্ধুদের সাথে
গিটার বাজাতে পারবে আর মদ্য পান করতে পারবে। জ্বি হ্যাঁ, এত টাকা দিয়ে হে আমার বন্ধু,
তুমি কাজ থেকে অবসর নিতে পারবে আর নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারবে।’
‘কিন্তু সিনর প্রফেসর, আমি তো এখন এগুলোই
করে থাকি।’
কেন আমরা বিশ্বাস করি যে সন্তুষ্টি খুঁজে
পাওয়ার আগে আমাদেরকে প্রথমে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে আর ধনী হতে হবে?
-----------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।