নবম অধ্যায়: মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক জীবন
#পিরামিড
শক্তি- ১৪৩
১৯৬৯ এর গ্রীষ্মকাল। আমার আঠারতম জন্মদিনের
পরে প্রথমবারের মতো গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গলে ভ্রমণে অভিজ্ঞতা উপভোগ করছিলাম আমি। আমি
ভ্রমণ করছিলাম গুয়াতেমালার য়ুকাটান উপদ্বীপে। গন্তব্য হচেছ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মায়া
সভ্যতার কিছু পিরামিড যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে।
তখনকার দিনে ভ্রমণ ছিল খুব কষ্টকর। গুয়াতেমালা
শহর থেকে টিকাল নামের সেই মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের দূরত্ব কয়েকশ কিলোমিটার। এটুকু পেরোতেই
লেগে গেল তিন চারদিন। আমি রেইনফরেস্টের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদীর উজানে পাড়ি দিলাম
তেল চিটচিটে মাছ ধরার নৌকায় করে। মালপত্র বোঝাই ট্রাকে করে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে নেমে
গেলাম কোনমতে। আর ছোট জঙ্গলের পথ পাড়ি দিলাম লক্কর ঝক্কর রিকশাতে। এটা ছিল প্রত্যন্ত
অঞ্চল, দরিদ্র এবং আদি অকৃত্রিম প্রকৃতির।
যখন আমি অবশেষে সেই পরিত্যক্ত প্রাচীন
মন্দির ও পিরামিডের বিস্তীর্ণ এলাকায় এসে হাজির হলাম, তখন আমার সাথে কোন গাইড ছিল না।
গাইড বইও ছিল না, যা আমাকে বলে দেবে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব বিশাল বিশাল পাথরের
স্থাপনার মানে কী।
আশেপাশে কেউই ছিল না। তাই আমি উঁচু পিরামিডগুলোর
একটাতে উঠতে শুরু করলাম।
চুড়ায় উঠে এই পিরামিডগুলোর মানে এবং আধ্যাত্মিক
উদ্দেশ্য হঠাৎ করেই পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে।
গত তিন দিন ধরে আমি গহীন জঙ্গলের মাঝ
দিয়ে ভ্রমণ করেছি। পথ ঘাট, নদীনালাগুলো ছিল যেন সবুজ বনের আড়ালে থাকা সুড়ঙ্গের মতো।
নতুন কোন পথ হলেই তার আকাশ তাড়াতাড়ি ঢেকে যেত ডালপালার আড়ালে। আমি আকাশ দেখি নি অনেকদিন।
দূরের জিনিস তো দেখতেই পারি নি। আমি ছিলাম জঙ্গলের মধ্যে।
পিরামিডের চুড়ায় এসে আমি জঙ্গল দিয়ে ঢেকে
থাকা সবুজের চাদরের উপরে উঠে গেলাম। আমার সামনে শুধু যে ম্যাপের মত ছড়িয়ে থাকা বিশাল
বনভূমি দৃষ্টিগোচর হলো তা নয়। বরং এখন আমি সবদিকে দেখতে পেলাম। আমার আর অসীমের মাঝে
জঙ্গল আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল না।
সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো যেন পৃথিবীর পিঠে
উঠে দাঁড়িয়েছি আমি। আমি কল্পনা করলাম সেই তরুণ মায়ান ইন্ডিয়ানদের কথা যারা জঙ্গলে জন্মেছে,
বড় হয়েছে জঙ্গলে, সারা জীবন কাটিয়েছে জঙ্গলে। আমি তাদেরকে কল্পনা করলাম কোন এক ধর্মীয়
অনুষ্ঠানে। তারা একজন বৃদ্ধ জ্ঞানী ও পবিত্র ব্যক্তির হাত ধরে প্রথমবারের মত এই পিরামিডের
চুড়ায় উঠেছে। যখন তারা গাছপালার সীমা ছাড়িয়ে উপরে উঠে এল, তাদের জংলী পৃথিবী যেন উন্মোচিত
হলো চোখের সামনে।
তাদের দৃষ্টি তখন সীমানা ছাড়িয়ে দিগন্তের
ওপারে প্রসারিত। তারা দেখত উপরে ও চারপাশে ঘিরে আছে এক মহান শূণ্যতা। পিরামিডের সেই
চুড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবী ও আকাশের মাঝখানের দরজায়, সেখানে অন্য কোন ব্যক্তি নেই, কোন বস্তু
নেই, কোন শব্দ নেই, চারদিকে শুধু অসীমতা। তাদের
মন সেই অবাক করা দৃশ্যে অনুরণিত হতো। সত্য প্রস্ফুটিত হতো আর জ্ঞানের সুবাস ছড়াতো।
তারা তাদের পৃথিবীতে নিজেদের স্থানকে বুঝে নিত। তারা তখন দেখে নিত সেই অসীমতাকে, সেই
মুক্তির শূণ্যতাকে, যা সবকিছুকে ঘিরে আছে। তাদের জীবন তখন জীবনের মানে খুঁজে পেত।
আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে আধ্যাত্মিক
পিরামিড। আমাদের নিজেদেরকে সেই পিরামিডে ওঠার জন্য সময় ও শান্তি যোগানো দরকার। কিছু
সময়ের জন্য হলেও যাতে আমরা আমাদের জীবনের জটিলতার জঙ্গলের উর্ধ্বে উঠে যেতে পারি।
তখন আমরা আমাদের চারপাশের জগতে নিজেদের
অবস্থানটা দেখতে পাব। আমাদের জীবনের গতিপথও দেখতে পারব আর চারপাশের অসীমকে বিনা বাধায়
উপলদ্ধি করতে পারব।
#মূল্যবান
পাথর- ১৪৫
কয়েক বছর আগে আমেরিকার একটি বিখ্যাত বিজনেস
স্কুলে এক প্রফেসর তার গ্রাজুয়েট ক্লাসে সামাজিক অর্থনীতির উপরে এক অসাধারণ লেকচার
দিয়েছিলেন। কোন কিছু না বলে তিনি তার টেবিলে একটি কাচের জগ রাখলেন। এরপর বের করলেন
এক ব্যাগ বড় বড় পাথর। পাথরগুলোকে তিনি একটা একটা করে জগে ঢুকাতে লাগলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত
আর কোন পাথর ঢুকানো গেল না। তিনি তার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘জগটি কি পূর্ণ?’
‘হ্যাঁ,’ তারা জবাব দিল।
প্রফেসর হেসে টেবিলের তলা থেকে দ্বিতীয়
ব্যাগটা বের করলেন, ব্যাগে ছিল নুড়ি পাথর। তিনি ছোট ছোট নুড়িগুলোকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে
ঢুকাতে লাগলেন জগের মধ্যে। সেগুলো বড় বড় পাথরগুলোর মাঝখানের ফাঁক পূর্ণ করল। দ্বিতীয়বারের
মত তিনি তার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘জগটি কি পূর্ণ?’
‘না’ তারা উত্তর দিল। তারা এবার তার মতলব
ধরতে পেরেছে।
অবশ্যই তাদের জবাব সঠিক ছিল। কারণ, প্রফেসর
এবার বের করলেন এক ব্যাগ বালি। তিনি বড় পাথর ও নুড়িগুলোর মাঝের ফাঁকগুলো বালি দিয়ে
ভরতে সক্ষম হলেন। এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘জগটি কি পূর্ণ?’
‘সম্ভবত নয়, স্যার। আপনাকে আমরা জানি
তো!’ ছাত্ররা জবাব দিল।
তাদের উত্তরে হেসে প্রফেসর এবার বের করে
আনলেন একটি ছোট পানির জগ। তিনি সেই পানি ঢাললেন পাথর , নুড়ি ও বালিতে ভরা জগের মধ্যে।
যখন পানিতে পূর্ণ হলো পাথরের জগটা, তিনি পানির জগটা নামিয়ে রেখে ক্লাসের দিকে তাকালেন।
‘তো, এ থেকে কী শিখলে তোমরা?’ তিনি তার
ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন।
‘এর মানে হচ্ছে যে আপনার কাজের তালিকায়
যতই ব্যস্ততা থাক,’ একজন ছাত্র বললো, ‘আপনি সবসময়ই তাতে কিছু না কিছু যোগ করতে পারবেন!’
বিজনেস স্কুলে কাজের কথাই তো আসবে!
কিন্তু প্রফেসর জোর দিয়ে নাকচ করে দিলেন
ছেলেটার কথা, ‘না। এটা তোমাদের দেখাচ্ছে যে যদি তোমরা বড় পাথরগুলো জগে ঢুকাতে চাও,
তাহলে সেগুলোকে আগেভাগেই ঢুকাতে হবে।’
এটা ছিল প্রায়োরিটির শিক্ষা, কাজগুলোকে
গুরুত্ব অনুসারে করার শিক্ষা।
তো, আপনার জগের বড় পাথরগুলো কী কী? আপনার
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী জিনিস চান আপনি?
দয়া করে নিশ্চিত হোন যে সবচেয়ে ‘মূল্যবান পাথরগুলো’ তালিকার প্রথমে রেখে দিয়েছেন। আর তা
নাহলে সেগুলোকে আর আপনার দিনের কাজের তালিকায় যোগ করার সুযোগই পাবেন না কখনো।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।