অষ্টম অধ্যায়: মন ও বাস্তবতা
অন্ধ
বিশ্বাস- ১৩৫
বুড়ো হলে আমাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে
আসে, শ্রবণ শক্তি কমে যায়, চুল পড়ে যায়, নকল দাঁত বাঁধাই করতে হয়, পা দুর্বল হয়ে যায়,
হাত কাঁপে থরথর করে। কিন্তু আমাদের শরীরের একটা অংশ মনে হয় প্রতি বছর আরো শক্তিশালী
হয়ে ওঠে। আর সেটা হচ্ছে আমাদের বাচাল মুখ। এজন্যই আমাদের বেশিরভাগ কথাপ্রিয় নাগরিক
বুড়ো বয়সে রাজনীতিবিদ হিসেবে বেশ নাম করতে পারে।
অনেক শতাব্দী আগে এক রাজা তার মন্ত্রীদের
নিয়ে মহা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন। তারা এত তর্কাতর্কি করত যে কোন সিদ্ধান্তই বলতে গেলে
নেওয়ার সময় হতো না। মন্ত্রীরা সেই চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই দাবী করত যে
তারা একাই সঠিক। আর বাকিরা সবাই ভুল। সে যাই হোক, যখন এই বুদ্ধিমান রাজা একটি বিশেষ
উৎসবের আয়োজন করলেন, তখন সবাই একদিনের জন্য এতে যোগ দিতে রাজি হলো।
সেই বর্ণাঢ্য উৎসবটা বিশাল এক স্টেডিয়ামে
অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সেখানে নাচ ছিল, গান ছিল, দড়িবাজি ছিল, ভাঁড় ছিল, সঙ্গীত ছিল, আরো
কত কী ছিল। অতঃপর সেই লোকে লোকারণ্য স্টেডিয়ামে, মন্ত্রীরা যেখানে সবচেয়ে ভালো আসনে
বসা, সেখানে রাজা তার রাজকীয় হাতিটাকে নিয়ে স্টেডিয়ামের মাঝখানে চলে এলেন। হাতির পেছনে
এলো সাতজন অন্ধ, যারা এই শহরে জন্মান্ধ বলে পরিচিত।
রাজা প্রথম অন্ধের হাত ধরে তাকে হাতির
শুঁড় কেমন তা অনুভব করতে সাহায্য করলেন আর বললেন এটা একটা হাতি। এরপরে তিনি দ্বিতীয়
অন্ধকে হাতির দাঁত কেমন তা অনুভব করতে সাহায্য করলেন। তৃতীয়জনকে হাতির কান, চতুর্থজনকে
মাথা, পঞ্চমজনকে শরীর, ষষ্ঠজনকে পা, সপ্তমজনকে লেজ। প্রত্যেককে তিনি বলে দিলেন যে এটা
একটা হাতি। এরপরে তিনি প্রথম অন্ধের কাছে গিয়ে তাকে বড় করে বলতে বললেন হাতি কেমন।
‘আমার বিশেষ বিবেচনা ও বিশেষজ্ঞ মত অনুযায়ী’,
প্রথম অন্ধ ব্যক্তি শুঁড়কে অনুভব করে বললো, ‘আমি পরম নিশ্চয়তার সাথে এই ঘোষণা দিই যে
‘হা’ হচ্ছে এক প্রজাতির সাপ, জেনাস পাইথন এশিয়াটিকস।’
‘কী বাজে বকছ!’ দ্বিতীয় অন্ধ অবাক হয়ে
বলে উঠল। সে হাতির দাঁত অনুভব করে বলল, ‘একটা ‘হাতি’ এমন শক্ত যে তা সাপ হতেই পারে না। আসলে
প্রকৃত সত্য হচ্ছে – আর আমি কখনোই ভুল বলি না- যে এটি একটি কৃষকের লাঙ্গল।’
‘কী হাস্যকর কথাবার্তা বলছ!’ ব্যঙ্গ করে
বললো তৃতীয় অন্ধ। সে হাতির কান অনুভব করে বললো, ‘হাতি হচ্ছে তাল পাতার পাখা।’
‘তোমরা হাবাগোবার দল!’ চতুর্থ অন্ধ হেসে
উঠল। সে মাথাটা অনুভব করে বললো, ‘আসলে হাতি হচ্ছে একটি বড় পানির টাংকি।’
‘অসম্ভব! চরম অসম্ভব!’ হৈচৈ করে উঠল পঞ্চম
অন্ধ। সে হাতির শরীর অনুভব করে বললো, ‘হাতি হচ্ছে একটি বিরাট পাথর।’
‘গরুর
গোবর!’ ষষ্ঠ অন্ধ চীৎকার করে উঠল। সে হাতির পা অনুভব করে বললো, ‘হাতি হচ্ছে একটি গাছের
গুঁড়ি।’
‘ওরে চুনোপুঁটির দল!’ অবজ্ঞায় মুখ বাঁকাল
সপ্তম অন্ধ। হাতির লেজটা অনুভব করে সে বললো, ‘আমি তোমাদেরকে বলছি, হাতি আসলে কী। এটি
এক ধরনের ঝাড়–। আমি জানি। আমি এটা নিজেই অনুভব করছি!’
‘জঘন্য! এটা একটা সাপ।’
‘হতেই পারে না! এটা টাংকি।’ ‘কোন গতি রাখলে না দেখছি! এটা একটা...
’ এভাবে অন্ধরা এমন উত্তপ্ত বাকবিতন্ডা শুরু করলো যে শুধু তাদের হৈচৈয়ের শব্দ শোনা
গেল। কথার সাথে সাথে তাদের হাতও চললো। যদিও কার গায়ে লাগছে সে ব্যাাপারে তারা নিশ্চিত
নয়, কিন্তু এমন গরম সময়ে সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তারা তাদের মতবাদের জন্য লড়াই
করছিল, তাদের সততা ও পরম সত্যের পক্ষে লড়াই করছিল। সেটা ছিল তাদের ব্যক্তিগত সত্য।
রাজার সৈন্যরা যখন আহত অন্ধ যোদ্ধাদের
পৃথক করে নিয়ে যাচ্ছিল, স্টেডিয়ামের লোকজন তখন লজ্জায় চুপ হয়ে যাওয়া মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে
ব্যঙ্গ করছিল। তারা প্রত্যেকেই ভালো করে বুঝতে পেরেছিল এই ঘটনার আড়ালে রাজা কী শিক্ষা
দিতে চেয়েছেন।
আমাদের প্রত্যেকেই পুরো সত্যের ভগ্নাংশ
মাত্র জানতে পারি। যখন আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞান নিয়ে সেই সত্যকেই পরম সত্য হিসেবে আঁকড়ে
ধরি, আমরা তখন হয়ে যাই সেই অন্ধদের মতো, যারা হাতির একটা অংশ অনুভব করেই স্থির সিদ্ধান্তে
এসেছিল যে তাদের আংশিক অভিজ্ঞতাই হচেছ আসল সত্যি, বাকিগুলো ভুল।
অন্ধ
বিশ্বাসের বদলে আমরা আলোচনায় বসতে পারি। কল্পনা করুন তো, রেজাল্টটা কেমন হবে যখন সেই
সাতজন অন্ধ তাদের পরস্পরের তথ্যকে ভুল বলে প্রত্যাখান না করে বরং তাদের অভিজ্ঞতাগুলো
একসাথে একত্র করলো। তারা এই সিদ্ধান্তে আসবে যে হাতি হচ্ছে বিশাল পাথরের মত একটা কিছু
যা চারটি গাছের গুঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাথরের পিছনে একটা ঝাড়–,
সামনের দিকে একটা বড় পানির টাংকি, টাংকির দুপাশে দুটো তালপাতার পাখা, তার নিচে দুদিকে
দুটো লাঙল আর মাঝখানে লম্বা একটা অজগর সাপ।
যে কখনো হাতি দেখে নি, তার জন্য হাতির
এমন বর্ণনা মোটামুটি খারাপ হবে না।
------------------অষ্টম অধ্যায় শেষ--------------
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।