দশম অধ্যায়: স্বাধীনতা ও নম্রতা
#দুই
ধরনের স্বাধীনতা- ১৫৩
আমাদের পৃথিবীতে দুধরনের স্বাধীনতা আছে:
আকাঙ্খার স্বাধীনতা এবং আকাঙ্খা হতে স্বাধীনতা।
আমাদের
আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতি কেবল প্রথমটাকে জানে: আকাঙ্খার স্বাধীনতা। এই সংস্কৃতি তাই
জাতীয় সংসদের সামনে সুউচ্চ বেদীতে এবং মানবাধিকারের আইনের মাধ্যমে এমন স্বাধীনতাকে
পূজো করে। বলা যায় যে, বেশিরভাগ পশ্চিমা গণতন্ত্রের পিছনের মতবাদ হচ্ছে তাদের জনগণের
আকাঙ্খাগুলো বুঝতে পারার স্বাধীনতাকে রক্ষা করা, যতদূর সম্ভব। এটা বলা চলে যে এমন দেশের
জনগণ খুব একটা স্বাধীন বলে অনুভব করে না।
দ্বিতীয় ধরনের স্বাধীনতা হচেছ আকাংখা
হতে স্বাধীনতা, যা কেবল কয়েকটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উদযাপন করা হয়। এতে তারা শ্রদ্ধা
জানায় সন্তুষ্টি ও শান্তিকে, যা আকাংখা থেকে মুক্ত। এটা বলা চলে যে এমন সংযমী সমাজে
লোকজন স্বাধীন বলে অনুভব করে, উদাহরণ হিসেবে আমার এই বিহারের কথা বলা যায়।
#আপনি
কোন ধরনের স্বাধীনতা পছন্দ করেন?- ১৫৩
দুজন খুব উচ্চতর আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভী
থাই ভিক্ষুকে তাদের এক ভক্তের বাড়িতে সকালের নাস্তা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
তারা দুজন সেই বাড়িতে ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করছিল। সেই রুমে ছিল একটি একুয়ারিয়াম,
যেখানে অনেক ধরনের মাছ ছিল। সেটা দেখে কনিষ্ঠ ভিক্ষু অভিযোগ করল যে, একুয়ারিয়ামে মাছ
রাখা বৌদ্ধ মতবাদের মৈত্রীর বিরোধী। এটা যেন তাদেরকে কারাগারে রেখে দেওয়া। সেই মাছটা
এমন কী করেছে, যার জন্য তাকে এই গ্লাসের দেয়ালবেষ্টিত জেলখানায় বন্দী হয়ে থাকতে হবে?
তারা থাকবে নদীতে, খালে বিলে যেখানে তারা সাঁতার কাটবে মুক্ত হয়ে, যেখানে খুশি সেখানে
যাবে। দ্বিতীয় ভিক্ষুটা কিন্তু এতে একমত হলো না। এটা সত্যি, সে মানলো যে এই মাছগুলো
তাদের আকাঙ্খা অনুযায়ী কাজ করবে এমন স্বাধীন নয়। কিন্তু এমন মাছের টাংকিতে থাকাটা তাদেরকে
অনেক বিপদ থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাদের স্বাধীনতার একটা তালিকা তৈরি করলো সে।
১. তুমি কী কোন জেলেকে কারো বাড়ির একুয়ারিয়ামে
বড়শির টোপ ফেলতে দেখেছ? না! তাই টাংকিতে থাকার প্রথম স্বাধীনতা হলো জেলেদের হাতে পড়ার
বিপদ থেকে মুক্তি। কল্পনা করো খালে বিলে থাকা একটা মাছ হলে কী অবস্থা হবে। যখন তারা
টসটসে কোন পোকা বা রসালো এবং মোটা একটা মাছিকে দেখতে পায়, তারা কখনই নিশ্চিত হতে পারে
না যে সেটা খাওয়া নিরাপদ হবে কি হবে না। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে তারা অনেকবার তাদের
অনেক বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনকে এমন সুস্বাদু পোকা প্রাণভরে খেতে দেখেছে, আর পরক্ষণেই
তারা সারাজীবনের জন্য পানির উপরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। উন্মুক্ত পানির মাছের জন্য খাওয়াটা
বিপদে পরিপূর্ণ আর প্রায়ই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এর পরিসমাপ্তি ঘটে। খাওয়াটাও হয় ভীষণ
উদ্বেগপূর্ণ। প্রত্যেকবার খাবারের বেলায় এমন উদ্বেগজনিত কারণে সকল মাছ নিশ্চিতভাবেই
দীর্ঘস্থায়ী বদহজমে ভুগে থাকে। যারা বেশি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, তারা তো নির্ঘাত উপোস
থেকেই মরে যাবে। বুনো মাছগুলো সম্ভবত মানসিক রোগী। কিন্তু টাংকির মাছগুলো এমন বিপদ
থেকে মুক্ত ও স্বাধীন।
২. বুনো মাছগুলোকে অন্যান্য বড় বড় মাছখেকো
মাছ সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হয়। বর্তমানে কয়েকটি শুকিয়ে যাচ্ছে এমন নদীতে তো রাতের বেলা
কোন অন্ধকার খাঁড়িতে যাওয়াই নিরাপদ নয়! অথচ কোন মালিকই কিন্তু তাদের টাংকিতে এমন মাছ
রাখবে না যারা একে অপরকে ধরে ধরে খায়। তাই টাংকির মাছগুলো এমন মাংসাশী মাছের বিপদ থেকে
স্বাধীন।
৩. প্রকৃতির করাল চক্রে পড়ে বুনো মাছগুলোকে
মাঝে মধ্যে পেটে কোন দানাপানি ছাড়াই থাকতে হয়। কিন্তু টাংকির মাছের জন্য এটা যেন অনেকটা
কোন হোটেলের পাশে থাকার মতো। দিনে দুবার তাদের দরজায় পৌঁছে দেওয়া হয় সুষম খাবার যা
বাসায় বসে পিৎসা ডেলিভারি পাওয়া থেকেও অনেক সুবিধাজনক, কেননা তাদের তো কোন টাকা পয়সা
দিতে হয় না। তাই টাংকির মাছগুলো বিপদ থেকে স্বাধীন।
৪. ঋতু পরিবর্তনের ফলে নদীনালা, খালবিলগুলোর
তাপমাত্রাও চরমভাবে উঠানামা করে। শীতকালে এমন ঠান্ডা পড়ে যে কোথাও হয়তো বরফে ঢেকে যায়
এসব নদী নালা। গরমকালে সেগুলো হয়তো মাছদের জন্যও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সেগুলো এমনকি শুকিয়েও
যায়। কিন্তু টাংকির মাছগুলোর জন্য আছে এসির আবহাওয়া। সেখানে পানির তাপমাত্রা থাকে সমান
এবং আরামদায়ক, সারাদিন ও সারা বছর জুড়ে। তাই গরম ও ঠান্ডার বিপদ থেকে টাংকির মাছেরা
স্বাধীন।
৫. বন্য পরিবেশে, মাছদের কোন রোগ বালাই
হলে তাদের চিকিৎসার কেউ থাকে না। কিন্তু টাংকির মাছদের আছে বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা।
তাদের কোন অসুখ বিসুখ দেখা দিলেই গৃহকর্তা ফোন করে একজন মাছের ডাক্তার ডেকে আনবে। তাদের
এমনকি কোন ক্লিনিকেও যেতে হয় না। তাই টাংকির মাছেরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিপদ থেকে মুক্ত।
দুজনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সেই দ্বিতীয় ভিক্ষুটা
এবার তার যুক্তিগুলোর একটা সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরলো। সে বললো, একুয়ারিয়ামের মাছ হওয়ার
অনেক সুবিধা। এটা সত্যি যে তারা তাদের আকাংখা অনুযায়ী স্বাধীন নয়, এখানে ওখানে ইচ্ছেমত
সাঁতার কাটতে পারে না। কিন্তু তারা অনেক বিপদ আপদ ও ঝামেলা থেকে স্বাধীন। জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুটি
আরো বললো যে মানুষের মধ্যে যারা ধার্মিক জীবন যাপন করে, তাদের অবস্থাও এরকম। সত্যি
কথা যে তারা তাদের আকাঙ্খা অনুযায়ী স্বাধীন নয়, এখানে ওখানে নিজের কামনা বাসনা চরিতার্থ
করতে পারে না। কিন্তু তারা অনেক বিপদ আপদ ও ঝামেলা থেকে স্বাধীন।
আপনি কোন ধরনের স্বাধীনতা পছন্দ করেন?
#স্বাধীন
জগত-১৫৫
আমার একজন বন্ধু ভিক্ষু কয়েক সপ্তাহ ধরে
ধ্যান প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল পার্থের নিকটে অবস্থিত একটি নতুন সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জেলখানায়।
কয়েদীদের ছোট দলটি ভিক্ষুটিকে ভালো করে চিনত ও শ্রদ্ধা করত। একবার ধ্যানের পালা শেষ
হলে তারা তাকে বৌদ্ধ বিহারের রুটিন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করল।
‘আমাদের প্রত্যেকদিন সকাল চারটায় উঠতে
হয় ঘুম থেকে।’ সে বলতে শুরু করল, ‘মাঝে মাঝে খুব ঠান্ডা লাগে কারণ আমাদের
ছোট ছোট রুম, সেখানে কোন রুম হিটার নেই। আমরা দিনে কেবল একবারই খাই, খাবার দাবার যা
কিছু পাই, সব একসাথে একটা পাত্রে মিশিয়ে খাই ঐ একবারই। বিকেলে ও রাতে আমরা কিছুই খেতে
পারি না। অবশ্যই সেখানে কোন সেক্স নেই, মদের ব্যাপার নেই, আমাদের কোন টেলিভিশন নেই,
রেডিও নেই। গান শোনার কিছু নেই। আমরা কখনোই ফিল্ম দেখি না। আর আমরা খেলাধুলাও করতে
পারি না। আমরা কথা বলি কম কম, কঠোর পরিশ্রম করি আর অবসর সময়টা ধ্যানে বসে নিঃশ্বাসের
দিকে মনোযোগ দিয়ে থাকি। আমরা মেঝেতে ঘুমাই।’
জেলের বন্দীরা আমাদের এমন কঠোর অনাড়ম্বর
সন্ন্যাস জীবনের বর্ণনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এর তুলনায় তাদের এই উচ্চ নিরাপত্তার জেলখানাটা
পাঁচতারা হোটেলের মতো মনে হলো। প্রকৃতপক্ষে তাদের একজন কয়েদী তার এই ভিক্ষু বন্ধুর
এমন দুর্দশা শুনে এমন করুণার্দ্র হয়ে উঠলো যে, সে ভুলে গেল যে সে কোথায় আছে, আর বলে
বসলো: ‘তোমার বিহারে থাকাটা তো খুবই ভয়ঙ্কর! তুমি এখানে এসে আমাদের সাথে থাকো না কেন?’
ভিক্ষুটি আমাকে পরে বলেছিল যে, এই কথা
শুনে রুমের সবাই তো হেসে খুন। সে যখন কাহিনীটা আমাকে বলেছিল আমিও এমন হেসেছিলাম। পরে
আমি একটু গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলাম।
এটা সত্যি যে সমাজের দুষ্কৃতকারীদের জন্য
বানানো সেই কঠিন জেলখানাগুলো থেকে আমার এই বিহারটা অনেক অনেক গুণ সাদামাটা, তবুও অনেকেই
স্বেচ্ছায় এখানে থাকতে আসে আর এখানে তারা সুখী। অথচ এমন সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন জেলখানা
থেকে অনেকেই পালাতে চায়। তারা সেখানে অসুখী। কেন?
কারণ আমার বিহারে সতীর্থরা এখানে আসতে
চায়, আর জেলখানায় সেখানে সতীর্থরা যেতে চায় না। পার্থক্যটা এখানেই।
আপনি যেখানে থাকতে চান না, সেখানে শত
সুযোগ সুবিধাই থাকুক না কেন, আপনার জন্য তা কারাগার। ‘কারাগার’
হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যেখানে আপনি থাকতে চান না। এটাই কারাগার শব্দের আসল অর্থ। যদি
আপনি এমন একটা চাকরি করেন, যেখানে আপনি থাকতে
চান না, তাহলে আপনি তখন কারাগারে আছেন। যদি আপনি এমন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, যা আপনি
চান না, আপনি তখন কারাগারে আছেন। যদি আপনি অসুস্থ ও পীড়িত দেহে থাকেন যা আপনি চান না,
সেটাও তখন আপনার জন্য একটা কারাগার। কারাগার হচেছ এমন একটা পরিস্থিতি যা আপনি চান না।
তো, আপনি কীভাবে জীবনের এই কারাগারগুলো
থেকে পালাবেন? সহজ। শুধু বর্তমান অবস্থার প্রতি আপনার উপলদ্ধিকে বদলে দিন ‘সেখানে থাকতে
চাই’ এমন মনোভাব দিয়ে। এমন স্যান কোয়েন্টিন অথবা তার চেয়ে একটু
ভালো হচ্ছে আমার বিহারটা, যখন আপনি সেখানে থাকতে চাইবেন, সেটা আর আপনার জন্য কারাগার
বলে মনে হবে না। আপনার চাকরি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক অথবা অসুস্থ দেহের প্রতি যে মনোভাব,
তা বদলে নিয়ে আর এরূপ অবস্থা না চাওয়ার বদলে বরং এরূপ অবস্থাকেই মেনে নিলে তখন এটাকে
আর কারাগার বলে মনে হবে না। যখন আপনি এখানে থেকে খুশি, তখন আপনি স্বাধীন।
স্বাধীনতা হচ্ছে আপনি যেখানে আছেন সেখানেই
সন্তুষ্ট থাকা। কারাগার হচ্ছে অন্য কোথাও যেতে চাওয়া। স্বাধীন জগত হচ্ছে যারা সন্তুষ্ট,
তাদের দ্বারা দেখা জগত। সত্যিকারের স্বাধীনতা হচ্ছে আকাঙ্খা হতে স্বাধীনতা, কখনই আকাঙ্খার
স্বাধীনতা নয়।
----------চলমান
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।