একাদশ অধ্যায়: দুঃখ আর যেতে দেওয়া
#কাপড়
ধোয়ার চিন্তা- ১৭৩
আজকাল
লোকজন বেশি ভাবে। যদি তারা তাদের চিন্তাগুলো একটু কমাতো, তাহলে আরেকটু সহজ হতো তাদের
জীবন।
থাইল্যান্ডে
আমাদের বৌদ্ধ বিহারে প্রত্যেক সপ্তাহে এক রাত ভিক্ষুরা মূল দেশনালয়ে সারারাত ধরে ধ্যানে
বসে থাকে, ঘুমায় না। এটি আমাদের বনভিক্ষুদের একটা ঐতিহ্য। এটি অতটা কঠিন ছিল না, কারণ
আমরা সবসময় পরদিন সকালে একটা ঘুম দিতে পারতাম।
এক
সকালে সারা রাত ধরে ধ্যানের পরে যখন আমাদের নিজ নিজ কুটিরে ফিরে গিয়ে একটু ঘুমাবার
সময় হয়ে এসেছে, এসময় অধ্যক্ষ একজন নতুন অস্ট্রেলিয়ান ভিক্ষুকে ডাকলেন। অধ্যক্ষ তাকে
এক গাদা চীবর দিয়ে সেগুলো তখনি ধুয়ে দিতে বললেন। তরুণ ভিক্ষুটির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
বিশাল এক কাপড়ের স্তুপ কাচতে হবে। আর সেটা হতে হবে বন ভিক্ষুদের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী। কুয়ো থেকে পানি তুলতে হবে। বিশাল একটি আগুন জ্বেলে সেখানে পানি গরম করতে হবে। দা দিয়ে কাঠাল গাছের কাঠ কুচি কুচি করে কাটতে হবে।
কাঠের
কুচিগুলো ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। এথেকে যে রস বের হবে তা ডিটারজেন্ট বা পরিষ্কারক
হিসেবে কাজ করবে। এরপর চীবরগুলো একটা একটা করে তক্তার উপরে হাত দিয়ে কচলাতে ও আছড়াতে
হবে আর সেই ফুটন্ত গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর চীবরগুলো রোদে শুকাতে
দিতে হবে। সময়ে সময়ে সেগুলোকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিতে হবে, যাতে রং চটে না যায়। একটা
চীবর ধোয়াও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টকর একটা ব্যাপার ছিল। আর এতগুলো চীবর ধুয়ে নিতে
নির্ঘাত আরো অনেক ঘন্টার কাজ।
বেচারা
তরুণ ভিক্ষুটি সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এমনিতেই ক্লান্তি চেপে ধরেছে তাকে। তার
জন্য আমার করুণা হলো।
আমি
ধোয়ার স্থানে তাকে একটু সাহায্য করতে গেলাম। গিয়ে শুনতে পেলাম, সে বৌদ্ধ রীতি ভুলে
গিয়ে তার জন্মগত ভাষায় শাপ শাপান্ত করছে। সে রাগে গজরাচ্ছিল এই বলে বলে যে, ‘ব্যাপারটা
খুব অন্যায় ও নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। অধ্যক্ষ কি আগামীকালের জন্যও অপেক্ষা করতে পারতেন না?
তিনি কি বোঝেন নি যে আমি সারা রাত ঘুমাই নি? আমি তো এটা করার জন্য ভিক্ষু হই নি।’
সে
ঠিক এমন বলছিল না, তবে এগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে ছাপার যোগ্য কথা।
সেই
সময়ে আমি ভিক্ষু হিসেবে কয়েক বছর হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বুঝেছিলাম যে সে কেমন বোধ করছে
আর এটাও জানতাম কীভাবে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আমি তাকে বললাম, ‘কাজটা করা
যত সহজ, সেটা নিয়ে চিন্তা করলে তা করাটা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।’
সে
চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহুর্ত নিরবে থেকে সে তার কাজে মন দিল। আমিও ঘুমাতে
গেলাম। সেদিন সে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এল, কাপড় কাচার কাজে সাহায্য করেছি বলে। সে আবিষ্কার
করেছিল যে এটা খুব সত্যি যে, কাপড় কাচতে হবে- এই চিন্তাটাই সবচেয়ে কঠিন ছিল। যখন সে
অভিযোগ অনুযোগ করা থামিয়ে কাপড় ধোয়ার কাজে মন দিল, আর কোন সমস্যা থাকল না।
জীবনে
যে কোন কিছুর সবচেয়ে কঠিন অংশটি হচ্ছে এটা নিয়ে চিন্তা করা।
#একটা
হৃদয় নাড়া দেয়া অভিজ্ঞতা - ১৭৪
আমি
এই অমূল্য শিক্ষাটা - ‘জীবনের যে কোন কিছুর সবচেয়ে কঠিন অংশটা হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা
করা’- এটা পেয়েছিলাম ভিক্ষু জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে, যখন আমি ছিলাম উত্তরপূর্ব
থাইল্যান্ডে। আজান চাহ তার বৌদ্ধ বিহারের নতুন অনুষ্ঠান হল নির্মাণ করছিলেন। অনেক ভিক্ষু
সেই কাজে সাহায্য করছিল। আজান চাহ আমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য মন্তব্য করতেন-‘ ভিক্ষুরা
একটা বা দুটো পেপসি খেয়েই সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করতে পারে, যা শহর থেকে শ্রমিক আনার
চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী।’ প্রায়ই আমি ভাবতাম- জুনিয়র ভিক্ষুরা
মিলে একটা শ্রমিক সংগঠন শুরু করলে কেমন হয়।
অনুষ্ঠান
হলটা নির্মিত হচ্ছিল ভিক্ষুদের বানানো টিলার উপরে। টিলার অনেক মাটি এদিক সেদিক স্তুপাকারে
ছিল। তাই আজান চাহ ভিক্ষুদেরকে ডেকে বললেন এই মাটিগুলোকে সরিয়ে পিছনে নিয়ে যেতে হবে।
এর পরের তিনদিন ধরে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যায় আঁধার না হওয়া পর্যন্ত আমরা একটানা কাজ
করে গেলাম। আমরা বেলচা দিয়ে মাটি কেটে ঠেলাগাড়িতে করে সেই বিরাট মাটির স্তুপকে সরিয়ে
নিলাম আজান চাহ যেখানে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক সেখানে। কাজটা শেষ হতে দেখে আমি যারপর
নাই খুশি।
পরের
দিন আজান চাহ কয়েকদিনের জন্য অন্য একটা বিহারে গেলেন। তার চলে যাওয়ার পরে উপাধ্যক্ষ
ভিক্ষুদেরকে ডাকলেন আর বললেন মাটিটা ভুল জায়গায় ফেলা হয়েছে। ওটা সরাতে হবে। আমি বিরক্ত
হলাম। তবে নালিশ করতে থাকা মনকে কোনমতে শান্ত করে আরো তিনদিন সেই কাঠফাটা গরমে কঠোর
পরিশ্রম করলাম।
দ্বিতীয়বার
সেই মাটির স্তুপ সরানো শেষ করেছি মাত্র, আজান চাহ ফিরলেন। তিনি আমাদের ভিক্ষুদেরকে
ডেকে বললেন, ‘কেন তোমরা মাটিটা সরালে সেখানে? আমি বলেছিলাম সেটা আগের জায়গাটাতে সরাতে
হবে। ওখানে সরাও এটাকে।’
আমি
রেগে নীল হয়ে গেলাম। ‘এই সিনিয়র ভিক্ষুরা কেন আগে ভাগেই নিজেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিতে
পারে না? বৌদ্ধ ধর্ম একটা সুশৃঙ্খল ধর্ম হওয়ার কথা। কিন্তু এই বিহারটা এতই বিশৃঙ্খল
যে এই সামান্য মাটিটা কোথায় রাখতে হবে, তাও ঠিক করতে পারে না। আমার উপরে এমন অন্যায়
করা তাদের উচিত নয়।’
আরো
তিনটি দীর্ঘ ক্লান্তিকর দিন পড়ে আছে আমার সামনে। আমি মাটিবোঝাই ঠেলাগাড়ি ঠেলছিলাম আর
রাগে গজগজ করছিলাম ইংরেজিতে, যাতে থাই ভিক্ষুরা বুঝতে না পারে। এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক
একটা কাজ। এর শেষ হবে কখন?
আমি
খেয়াল করতে শুরু করলাম, যত রাগছি, ততই ঠেলাগাড়িটা ভারী বোধ হচ্ছে। এক সতীর্থ ভিক্ষু
আমাকে রাগে গজগজ করতে দেখে কাছে এসে বলল, ‘তোমার সমস্যা হচ্ছে তুমি বেশি ভাব।’
সে
ছিল অত্যন্ত সঠিক। যখন আমি অভিযোগ অনুযোগ বন্ধ করলাম, ঠেলাগাড়িটা ঠেলতে বেশ হালকা বোধ
হলো। আমি আমার শিক্ষা পেয়ে গেলাম। মাটি সরানোর চিন্তাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ। মাটি
সরানোটা ছিল সহজ।
এখন
আমি সন্দেহ করি, আজান চাহ ও তার উপাধ্যক্ষ প্রথম থেকেই পরিকল্পনা করে এটি করেছিলেন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।