হৃদয়ের দরজা খুলে দিন (পর্ব-৫৫) একাদশ অধ্যায়

একাদশ অধ্যায়: দুঃখ আর যেতে দেওয়া


ঝরা পাতা - ১৮৭
সম্ভবত মৃত্যুর মধ্যে যে মৃত্যুকে মেনে নেওয়া সবচেয়ে কঠিন হয়, তা হচ্ছে কোন শিশুর মৃত্যু। বিভিন্ন সময়ে কোন ছোট ছেলে বা মেয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করার সুযোগ হয়েছে আমার, যাদের জীবনের অভিজ্ঞতাই খুব বেশি দিনের হয় নি। আমার কাজ হচ্ছে শোকে বিহ্বল পিতামাতাকে, সাথে অন্যান্যদেরকেও মনের দুঃখ কাটিয়ে ওঠার জন্য পথ দেখাতে সাহায্য করা, আর সেই বদ্ধমূল প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার যাতনার ভার লাঘব করা, যে প্রশ্নটি হচ্ছে, ‘কেন?’
আমি প্রায়ই নিচের গল্পটি বলি, যা অনেক বছর আগে থাইল্যান্ডে শুনেছিলাম।


একজন সাধারণ বনভিক্ষু জঙ্গলের মধ্যে এক পর্ণকুটিরে ধ্যান করছিল। এক সন্ধ্যায় প্রচন্ড বেগে ঝড় বয়ে গেল। বাতাসের গর্জন শোনাল যেন জেট বিমানের ইঞ্জিনের মতো। ভারী বৃষ্টি তার কুটিরে আছড়ে পড়ছিল। রাত যতই বাড়তে লাগল, ঝড় ততই বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। প্রথমে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা গেল। পরে বাতাসের তোড়ে শেকড়সুদ্ধ গাছ উপড়ে এল আর বজ্রপাতের শব্দের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ল।

ভিক্ষুটি শীঘ্রই বুঝতে পারল যে তার ঘাসের কুটিরটা তাকে রক্ষা করতে পারবে না। কুটিরে যদি কোন গাছ আছড়ে পড়ে, অথবা নিদেনপক্ষে কোন বড় ডাল যদি নেমে আসে, তাহলে এটি সোজা কুটিরকে চাপা দিয়ে তাকেও মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলবে।

সে সারারাত ঘুমালো না। সেই রাতে প্রায়ই সে শুনল বড় বড় গাছগুলো হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ছে সশব্দে। প্রতিবার এমন শব্দে তার হৃদয় কেঁপে উঠল।

ভোর হওয়ার কিছু আগে, যেমনটি প্রায়ই হয়, ঝড় থেমে গেল। আলো ফুটতেই ভিক্ষুটি বেরিয়ে পড়ল কুটিরের কী হাল হয়েছে দেখতে। অনেক বড় বড় ডালপালা, আর দুটো বড় আকারের গাছ একটুর জন্য কুটিরকে মিস করেছে। এত কিছুর পরেও বেঁচে থাকতে পেরে সে খুব ভাগ্যবান অনুভব করলো। হঠাৎ তার দৃষ্টি আকর্ষিত হলো উপড়ে যাওয়া গাছ এবং ছড়ানো ছিটানো ডালপালার দিকে নয়, বরং অসংখ্য পাতার দিকে, যা পুরু হয়ে ছড়িয়ে ছিল জঙ্গলের সবখানে।

সে যেমনটা ভেবেছিল, মাটিতে পড়ে থাকা বেশির ভাগ পাতাই হচ্ছে বুড়ো ও বাদামী রঙের পাতা যেগুলো পূর্ণজীবন কাটিয়েছে। সেই বাদামী পাতাগুলোর মাঝে ছিল অনেকগুলো হলদে পাতা। তার সাথে ছিল কিছু সবুজ পাতাও। সেই সবুজ পাতাগুলোর মধ্যে কয়েকটা এমন সতেজ ও উজ্জ্বল সবুজ রঙের পাতা ছিল যে সে দেখেই বুঝতে পারল এগুলো কুঁড়ি থেকে পাতা হয়েছিল ঝরে পড়ার মাত্র কয়েকঘন্টা আগে। সেই মুহুর্তে ভিক্ষুটির হৃদয়ে মৃত্যুর স্বভাব প্রকটিত হলো।

সে তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা সত্যকে পরখ করে নিতে চাইল। তাই সে উপরে গাছগুলোর
ডালপালার দিকে তাকাল। সত্যিই, গাছগুলোতে যে পাতাগুলো রয়ে গেছে, তাদের বেশির ভাগই তরুণ সতেজ সবুজ পাতা, তাদের জীবনের মধ্যগগনে। যদিও অনেক নতুন কচি সবুজ পাতা মাটিতে ঝরে পড়ে আছে, তবুও পুরনো, বুড়ো হয়ে যাওয়া কোঁকড়ানো বাদামী পাতাগুলোও ডালপালাগুলোতে টিকে আছে এখনো। ভিক্ষুটি হাসলো। সেদিন থেকে কোন শিশুর মৃত্যুই তাকে বিচলিত করে নি।

যখন আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে মৃত্যুর ঝড় বয়ে যায়, সে সাধারণত উড়িয়ে নেয়বৃদ্ধদেরকে, কুঁচকানো বাদামী পাতাগুলোকে। সেই সাথে আরো অনেক মধ্যবয়স্ক লোকদেরও নিয়ে যায়, যেমনটা গাছের হলদে পাতাগুলোর মতো। তরুণরাও মারা যায়, তাদের জীবনের প্রারম্ভেই, ঠিক সবুজ পাতাগুলোর মতো। মাঝে মাঝে মৃত্যু এসে ছোট বাচ্চাদের জীবনও কেড়ে নেয়, ঠিক যেমনটা প্রকৃতির ঝড় এসে ছিঁড়ে নেয় কুঁড়ি থেকে সদ্য গজানো পাতাগুলোকে। এটাই আমাদের মৃত্যুর অপরিহার্য চরিত্র, ঠিক যেমনটি দেখা যায় বনের মাঝে ঝড়ের চরিত্রটিতে।

একজন শিশুর মৃত্যুতে কাউকে দোষ দেওয়া বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার কিছু নেই। ঝড়কে কে দোষ দিতে পারে? আর এটিই আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহায্য করে- কেন শিশুরা মারা যায়? উত্তরটা হচ্ছে, সেই একই কারণ, যার জন্য ঝড়ে কিছু সংখ্যক সদ্যজাত সবুজ পাতা ঝরে যায়।

মৃত্যুর উত্থান পতন - ১৮৯
বোধ করি সবচেয়ে আবেগময় দৃশ্যের অবতারণা ঘটে যখন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কফিনটাকে কবরে নামানো হয় অথবা ক্রেমাটোরিয়ামে কফিনকে ভেতরে নেওয়ার জন্য যখন সুইচ টিপে দেওয়া হয়। এটা যেন প্রিয় ব্যক্তির সর্বশেষ শারীরিক চিহ্নকে শোকার্ত পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে চিরকালের জন্য। এমন মুহুর্তে প্রায়ই চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। এমন মুহুর্তগুলো আরো কঠিন হয় পার্থের কয়েকটা ক্রেমাটোরিয়ামে। সেখানে সুইচ টিপলে কফিনটি নিচে নেমে যায় যেখানে চুল্লীটি অবস্থিত। এটা অনেকটা কবর দেওয়ার মতো দেখায়। তবে একজন মৃত ব্যক্তির নিচের দিকে নেমে যাওয়াটা অবচেতন মনে অনেকটা নরকে নেমে যাওয়ার মতো লাগে! প্রিয় ব্যক্তিকে হারানো এমনিতেই যথেষ্ট কষ্টের। তার সাথে যমালয়ে নেমে যাওয়ার সাদৃশ্য যোগ হলে তা সহ্য করাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে।

অতএব আমি একবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে এমনভাবে ক্রেমাটোরিয়াম নির্মাণ করা হোক যাতে করে প্রিস্ট যখন মৃতদেহকে দাহ করার জন্য সুইচ টিপবে, কফিনটা ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাবে। একটা সাধারণ হাইড্রলিক লিফটই এই কাজটা করতে পারে। কফিনটা ছাদে পৌঁছালে ঘুরন্ত শুকনো বরফের মাঝে হারিয়ে যাবে, এরপরে এটি একটি লুকোনো দরজার মাঝ দিয়ে উপরে উঠে যাবে, তখন বাজতে থাকবে স্বর্গীয় সঙ্গীত। শোকার্তদের মাঝে তা মানসিকভাবে খুব উৎফুল্লকর একটা ছাপ ফেলবে।
তবে যারা আমার প্রস্তাব শুনেছে, তাদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছে, এতে অনুষ্ঠানের সততা চলে যাবে। বিশেষ করে সবাই যেখানে জানে যে, মৃতব্যক্তি যদি বদমাশ হয়, এমন ব্যক্তি উপরে যেতেই পারে না।

আমি তাই প্রস্তাবটা একটু রদবদল করে নিলাম। প্রস্তাব করলাম যে সবকিছু কাভার দেওয়ার জন্য তিনটা সুইচ রাখা হোক। ‘উপরে সুইচটা হচ্ছে যারা ভালো তাদের জন্য। ‘নীচে বাটনটা হচ্ছে গুন্ডাদের জন্য। ‘একপাশে বাটনটি হচ্ছে বেশিরভাগ বেওয়ারিশ লোকদের জন্য। এরপরে পশ্চিমা সমাজের গণতান্ত্রিক নীতিকে মান্য করে, আর সাথে সাথে এমন নিরস অনুষ্ঠানে একটু রস মিশিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা শোকার্তদের কাছ থেকে হাত তুলে ভোট নিতে পারি, তিনটা সুইচের মধ্যে কোনটা টিপে দেওয়া হবে! এটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহুর্ত বানিয়ে দেবে, আর এমন অনুষ্ঠানে যেতে চাওয়ার একটা ভালো কারণ হয়ে উঠবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !