একাদশ অধ্যায়: দুঃখ আর যেতে দেওয়া
এক
ব্যক্তি ও তার চার স্ত্রী - ১৯০
জীবনে
সফল এক ব্যক্তির চার স্ত্রী ছিল। জীবনের শেষ সময়ে এসে সে তার শয্যাপাশে চতুর্থ স্ত্রীকে
ডাকল, সবচেয়ে নতুন ও তরুণী স্ত্রীকে। ‘প্রিয়তমা,’ সে তার সুন্দর ফিগারের দেহে হাত বুলিয়ে
বলল, ‘এক কী দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার পরে, আমি তোমাকে ছাড়া একা হয়ে যাব। তুমি
কি আমার সাথে আসবে?’
‘কোনমতেই
না!’ ঘোষণা করে দিল সেই লাস্যময়ী সুন্দরী, ‘আমাকে অবশ্যই পিছনে থাকতে হবে। তোমার শেষকৃত্য
অনুষ্ঠানে আমি তোমার প্রশংসার জয়গান গাইব। কিন্তু এর বেশি কিছু করতে পারবো না।’
এই বলে সে গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
তরুণী
স্ত্রীর এমন শীতল প্রত্যাখান লোকটির হৃদয়ে যেন একটি ছুরি বসিয়ে দিল। সে তার সব মনোযোগ
ঢেলে দিয়েছিল তার এই সবচেয়ে তরুণী স্ত্রীকে। সে তাকে নিয়ে এমন গর্বিত ছিল যে যেকোন
গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে সে তাকে সাথে করে নিয়ে গেছে। এই সুন্দরী স্ত্রী তাকে বৃদ্ধ
বয়সে দারুণ মর্যাদা এনে দিয়েছে। এটা জেনে সে অবাক যে, তার স্ত্রী তাকে ভালোবাসে না,
যেমনটা কিন্তু সে তাকে ভালোবাসত।
এখনো
তার আরো তিনজন স্ত্রী আছে। তাই সে তৃতীয় স্ত্রীকে ডাকল যাকে সে মধ্যবয়সে বিয়ে করেছিল।
এই তৃতীয় স্ত্রীর হাত ধরার জন্য তাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। তার জীবনে এত আনন্দের উৎস
তো তার এই তৃতীয় স্ত্রী। তাই সে তাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তার এই স্ত্রী এমন আকর্ষণীয়
ছিল যে অনেকেই তাকে পেতে চাইত। কিন্তু সে সবসময় তার স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। সে
তার স্বামীকে দিয়েছিল নিরাপত্তাবোধ।
’মিষ্টি
সোনা আমার,’ সে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এক কি দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার পরে, আমি
তোমাকে ছাড়া একা হয়ে যাব। তুমি কি আমার সাথে আসবে?’
‘কিছুতেই
নয়!’ এই সুন্দরী মহিলা ব্যবসায়ীসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিল, ‘এমন জিনিস কখনোইকরা হয় নি।
আমি তোমাকে জমকালো একটা শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করে দেব। কিন্তু এর পরে আমি তোমার সন্তানদের
নিয়ে চলে যাব।’
তৃতীয়
স্ত্রীর এমন অবিশ্বস্ততা তার অন্তঃস্থলকে নাড়া দিল। সে তাকে চলে যেতে বলে দ্বিতীয় স্ত্রীকে
ডেকে পাঠাল।
সে
বড় হয়েছে এই দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে। এই স্ত্রীটি যদিও তেমন আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু যে কোন
সমস্যায় সাহায্য করার জন্য আশেপাশে ছিল সে সবসময়। আর যেকোন সমস্যায় অমূল্য উপদেশ দিত
সে। সে ছিল তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।
‘ভালোবাসাময়ী,’
সে বিশ্বাসের সাথে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এক কি দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার
পরে, আমি তোমাকে ছাড়া একা হয়ে যাব। তুমি কি আমার সাথে আসবে?’
‘আমি
দুঃখিত,’ সে ক্ষমার সুরে বললো, ‘আমি তোমার সাথে যেতে পারবো না। তোমার কবর পর্যন্ত যেতে
পারি, কিন্তু এর বেশি নয়।’
বৃদ্ধ
লোকটি ভেঙে পড়লো। সে তার প্রথম স্ত্রীকে ডাকলো, যাকে সে মনে হয় চিরকাল ধরে চেনে। সে
সম্প্রতি তাকে অবহেলা করেছে। বিশেষত মন ভোলানো সেই তৃতীয় স্ত্রীর দেখা পেয়ে আর সবদিক
দিয়ে সেরা তার চতুর্থ স্ত্রীকে পেয়ে। কিন্তু তার এই প্রথম স্ত্রীই তার জন্য সত্যিকারের
গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে আড়াল থেকে কাজ করে গেছে। সে সত্যিই লজ্জা পেল যখন সে তার এই স্ত্রীকে
অগোছালো ও শীর্ণ দেহে আসতে দেখল।
‘প্রিয়তমা,’
মিনতি ঝরল লোকটার কণ্ঠে, ‘এক কি দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার পরে, আমি তোমাকে ছাড়া
একা হয়ে যাব। তুমি কি আমার সাথে আসবে?’
‘অবশ্যই
আমি তোমার সাথে যাব।’ সে নির্বিকার স্বরে জবাব দিল, ‘আমি জন্ম
থেকে জন্মান্তরে তোমার সাথে যাব সবসময়।’
প্রথম
স্ত্রীকে বলা হয় কর্ম। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হলো পরিবার। তৃতীয় স্ত্রী ছিল ধনসম্পদ।
চতুর্থ স্ত্রী ছিল যশখ্যাতি।
প্লিজ,
গল্পটা আরেকবার পড়–ন। এখন যেহেতু আপনি চারটি স্ত্রীকে জানেন।
কোন স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি যত্ন নেওয়া দরকার? আপনার মৃত্যু হলে কে আপনার সাথে যাবে?
ধাক্কা
খাওয়া - ১৯২
থাইল্যান্ডে
আমার প্রথম বছরে আমাদেরকে ছোট একটা ট্রাকে করে এক বিহার থেকে আরেক বিহারে নিয়ে যাওয়া
হতো। সিনিয়র ভিক্ষুরা সামনে ড্রাইভারের পাশে ভালো সীটে বসতো। আমরা জুনিয়র ভিক্ষুরা
বসতাম ট্রাকের পিছনে, কাঠের বেঞ্চের উপরে। বেঞ্চের উপরে ছিল নীচু লোহার ফ্রেম। তার
উপরে তেরপল দিয়ে ঢাকা দেওয়া, ধুলো ও বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য।
রাস্তাগুলো
ছিল সব কাঁচা, অযত্ন অবহেলায় বেহাল দশা। যখন চাকাগুলো খাদে পড়তো, ট্রাকটা নিচে নামতো
আর পিছনে ভিক্ষুরা উপরে উঠে যেতো। ঠুস! অনেকবার আমার মাথাটা এই শক্ত লোহার ফ্রেমে ধাক্কা
খেয়েছে। অধিকন্তু ন্যাড়া মাথার ভিক্ষু হওয়ায় আঘাতের ধাক্কা কমাবার জন্য মাথায় কোন কিছু
দেওয়ারও উপায় ছিল না।
প্রতিবার
মাথায় ধাক্কা লাগলে আমি গালাগালি শুরু করতাম- অবশ্যই ইংরেজিতে, যাতে থাই ভিক্ষুরা বুঝতে
না পারে। কিন্তু থাই ভিক্ষুরা তাদের মাথায় ধাক্কা লাগলে খালি হাসতো। আমি ভেবে কুল কিনারা
পেতাম না, মাথায় এমন ব্যথা পেলে হাসি আসে কীভাবে? আমি মনে মনে ভাবতাম, এই থাই ভিক্ষুরা
ইতিমধ্যেই মাথায় এতবেশি আঘাত পেয়েছে যে তাদের মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে।
আমি
যেহেতু একজন বিজ্ঞানী ছিলাম, তাই আমি একটা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি হাসার
সংকল্প করলাম থাই ভিক্ষুদের মতো। এর পরের বার মাথায় বাড়ি লাগলেই হাসব, দেখব কেমন লাগে।
আপনি কি জানেন, আমি কী আবিষ্কার করেছিলাম?
আমি
দেখেছিলাম যে মাথায় আঘাত পেলে আপনি যদি হাসেন, তাহলে ব্যথা অনেক কম হয়।
হাসির
ফলে আপনার রক্ত¯্রােতে এন্ডোরফিনস নিঃসৃত হয় যা প্রাকৃতিক
ব্যথানাশক। এটি আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও সুদৃঢ় করে এবং ইনফেকশন হওয়া থেকে রক্ষা
করে। তাই ব্যথা পেলে হাসাটা বেশ কাজের। যদি আপনি এখনো আমার কথা বিশ্বাস না করেন, তাহলে
পরের বার মাথায় বাড়ি খেলে হাসার চেষ্টা করুন।
অভিজ্ঞতা
আমাকে শিখিয়েছে যে যখন জীবন ব্যথাময় হয়, তখন যদি আপনি এর মজার দিকগুলো খুঁজে নিয়ে হাসতে
পারেন, তাহলে ব্যথা অনেক কম হয়।
গুবরে
পোকা ও তার আকর্ষণীয় গোবরের স্তুপ - ১৯৩
কিছু
কিছু লোক ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে চায় না। যদি তাদের নিজস্ব কোন উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যাপার
না থাকে, তাহলে তারা টেলিভিশনের কাল্পনিক চরিত্রগুলোর ঝামেলাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে
থাকে। অনেকে উদ্বেগকে প্রেরণাদায়ী মনে করে। মনে করে, যা কষ্টের, তাই ভালো। তাই মজার।
তারা সুখী হতে চায় না, কারণ তারা তাদের দুঃখের বোঝাগুলো নিয়ে খুব বেশি সংশ্লিষ্ট।
দুজন
বন্ধু সারা জীবন ধরে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। মৃত্যুর পরে তাদের একজন স্বর্গে দেবতা হিসেবে,
আরেকজন গোবরের স্তুপে গুবরে পোকা হিসেবে জন্ম নিল। দেবতা শীঘ্রই তার বন্ধুর অভাব বোধ
করতে লাগল আর মনে মনে ভাবল কোথায় সে জন্মেছে। সে যে স্বর্গে জন্মেছে, সেখানে কোথাও
তার বন্ধুকে খুঁজে পেল না। তাই সে অন্যান্য স্বর্গেও দিব্যদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কিন্তু
তার বন্ধুর দেখা সেখানেও মিলল না। এবারে সে মানবজগতে মানুষদের মাঝে খুঁজে দেখল তার
দিব্যদৃষ্টি দিয়ে, কিন্তু সেখানেও তাকে সে খুঁজে পেল না। নিশ্চয়ই তার বন্ধু পশুপাখির
জগতে জন্ম নেয় নি। কিন্তু সে তবুও নিশ্চিত হতে চাইল। তবে সেখানেও তার আগের জন্মের বন্ধুর
খোঁজ মিলল না। তাই এবার সেই দেবতা বুকে হেঁটে চলা কীট পতঙ্গের জগতে তার দিব্যদৃষ্টি
নিক্ষেপ করল। আর অবাক করা ব্যাপার। তার বন্ধুকে সে খুঁজে পেল দুর্গন্ধযুক্ত এক গোবরের
স্তুপের মধ্যে গুবরে পোকা রূপে!
বন্ধুত্বের
বাঁধন এত শক্ত যে মরণের পরেও তা টিকে থাকে। দেবতা তার পুরনো বন্ধুকে এমন দুর্ভাগ্যজনক
জন্মের কবল থেকে উদ্ধার করবে বলে মন স্থির করলো।
তাই
সে স্বর্গ থেকে নেমে এসে দুর্গন্ধযুক্ত গোবরের স্তুপের সামনে এসে ডাক দিল, ‘এই যে,
গুবরে পোকা! আমাকে মনে আছে? আমরা অতীত জন্মে দুজন ভিক্ষু ছিলাম আর তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে
ভালো বন্ধু। আমি যেখানে সুন্দর স্বর্গে জন্ম নিয়েছি, সেখানে তোমার জন্ম হয়েছে পেট উল্টে
আসা এই দুর্গন্ধযুক্ত গোবরের স্তুপে। তবে চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আমার সাথে করে
স্বর্গে নিয়ে যাব। এসো, হে বন্ধু!’
‘একটু
দাঁড়াও!’ পোকাটা বললো, ‘তুমি যে এই স্বর্গলোক সম্পর্কে কিচির মিচির করে জানাচ্ছো, সেখানে
এত মজার কী আছে? আমি এখানে পুষ্টিকর গরুর গোবরের সুগন্ধের মধ্যে ভালোই আছি। তোমাকে
অনেক ধন্যবাদ।’
’তুমি
বুঝছ না।’ দেবতা এবার তাকে স্বর্গের সুখ ও আনন্দজনক বিষয়গুলো তাকে
বুঝিয়ে বললো।
‘উপরে সেখানে কি তাহলে গোবর আছে?’ পোকাটা
মূল বিষয়ে এল।
‘অবশ্যই নয়!’ নাক সিঁটকালো দেবতা।
‘তাহলে আমি যাচ্ছি না!’ পোকাটা দৃঢ় গলায়
বললো। ‘দূর হও এখান থেকে!’ এই বলে সে হামাগুড়ি দিয়ে গোবরের স্তুপের মাঝে ঢুকে গেল।
দেবতা
ভাবলো যে পোকাটাকে ধরে স্বর্গে নিয়ে গিয়ে দেখালে তবেই সে বুঝবে। তাই দেবতা নাক কুঁচকে
তার কোমল হাতটা সেই জঘন্য গোবরের স্তুপে ঢুকিয়ে পোকাটাকে হাতড়াল। সে তাকে খুঁজে পেয়ে
টেনে বের করে আনতে লাগল।
‘হেই!
আমাকে একা থাকতে দাও!’ পোকাটা চেঁচিয়ে উঠলো। ‘বাঁচাও! আমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! আমাকে
অপহরণ করা হচ্ছে। বাঁচাও!!’ ছ্ট্টো পিচ্ছিল পোকাটি দেহ বাঁকিয়ে মুচড়ে নিজেকে দেবতার
কবল থেকে মুক্ত করলো আর গোবরের স্তুপে ঝাঁপ দিয়ে লুকালো।
দয়ালু
দেবতা আবার তার আঙুলগুলোকে দুর্গন্ধে ভরা সেই গোবরের স্তুপে ঢুকিয়ে দিল। পোকাটিকে খুঁজে
পেল আর আরেকবার তাকে টেনে বের করার চেষ্টা চালালো। দেবতা প্রায় তাকে বের করে এনেছিল।
কিন্তু পোকাটি নরম গোবরে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, আর যেতে ইচ্ছুক ছিল না মোটেও। তাই এটি
দ্বিতীয়বারের মতো পালালো এবং গোবরের আরো গভীরে গিয়ে লুকালো। গুণে গুণে একশ আটবার দেবতা
বেচারা পোকাটাকে সেই জঘন্য গোবরের স্তুপ থেকে বের করার চেষ্টা করলো। কিন্তু পোকাটা
তার সেই প্রিয় গোবরের প্রতি এমন আসক্ত ছিল যে সে প্রতিবারই দেহ মুচড়ে নিজেকে মুক্ত
করে নিয়ে আবার গোবরের মধ্যে ঢুকে গেল!
তাই
অবশেষে দেবতাকে হাল ছেড়ে দিয়ে স্বর্গে ফিরে যেতে হলো আর বোকা পোকাটাকে তার প্রিয় গোবরের
স্তুপে রেখে যেতে হলো।
এভাবেই এই বইয়ে একশ আটটি গল্পের পরিসমাপ্তি
ঘটলো।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।