অপণ্ণক-জাতক।

ভগবান শ্রাবস্তী নগরের নিকটবর্ত্তী জেতবনস্থ মহাবিহারে অবস্থান করিবার সময় ধ্রুবসত্য শিক্ষাদানার্থ নিম্নলিখিত কথা বলিয়াছিলেন। সে উপলক্ষ্যে ইহার অবতারণা হইয়াছিল তাহা এই :

শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডদের পঞ্চশত বন্ধু বৌদ্ধশাসন গ্রহণ না করিয়া অন্যান্য গুরুর শিষ্য হইয়াছিলেন।একদিন অনাথপিণ্ডদ ইহাদিগকে সঙ্গে লইয়া জেতবনে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে প্রচুর মাল্য, গন্ধ, বিলেপন এবং তৈল, মধু, গুড়, বস্ত্র, আচ্ছাদন প্রভৃতি দ্রব্যসম্ভার ছিল। তিনি মাল্যাদি দ্বারা ভগবানের অর্চ্চনা করিলেন, ভিক্ষুসঙ্ঘকে বস্ত্র-ভৈষজ্যাদি উপহার দিলেন এবং অতি শিষ্টভাবেএকান্তে উপবেশন করিলেন। তাঁহার বন্ধুগণও তথাগতের চরণ বন্দনা করিয়া তদীয় পার্শ্বে উপবিষ্ট হইলেন এবং বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে ভগবানের লোকাতীত বিভূতি-পূর্ণচন্দ্রনিভ মুখমণ্ডল, বুদ্ধত্বব্যঞ্জক সর্ব্বসুলক্ষণ-মণ্ডিত ব্যামপ্রমাণ-প্রভাপরিবৃত ব্রহ্মকলেবর এবং তন্নিঃসৃত, স্তরে স্তরে বিন্যস্ত, পূর্ণপ্রজ্ঞাজাত রশ্মিমালা অবলোকন করিতে লাগিলেন।
অনন্তর ভগবান তাঁহাদের উপদেশার্থে মনঃশিলাসমাসীন-তরুণসিংহনিনাদসদৃশ কিংবা বর্ষাকালীন মেঘগর্জ্জন সদৃশ গুরুগম্ভীর অথচ অষ্টাঙ্গপরিশুদ্ধ এবং কমনীয় ব্রহ্মস্বরে নানাবৈচিত্র্যবিভূষিত মধুর ধর্ম্মকথা আরম্ভ করিলেন, বোধ হইতে লাগিল যেন আকাশ-গঙ্গা মর্ত্ত্যে অবতরণ করিতেছে, কিংবা বাক্যচ্ছলে রত্নদাম গ্রথিত হইতেছে।
ধর্ম্মোপদেশ শ্রবণে প্রসন্নচিত্ত হইয়া তাঁহারা আসন হইতে উত্থিত হইলেন এবং দশবলের চরণবন্দনাপূর্বক অপরাপর শরণ পরিহার করিয়া তাঁহারই শরণ লইলেন। তদবধি তাঁহারা প্রতিদিন গন্ধমাল্যাদি লইয়া অনাথপিণ্ডদের সহিত বিহারে যাইতেন, ধর্ম্মকথা শুনিতেন, দান করিতেন, শীলসমূহ পালন করিতেন এবং উপোসথদিবসে যথাশাস্ত্র সংযমী হইয়া থাকিতেন।
ইহার পর শাস্তা শ্রাবস্তী ত্যাগ করিয়া রাজগৃহে গমন করিলেন এবং তিনি প্রস্থান করিবামাত্র পঞ্চশত ব্যক্তি বৌদ্ধশরণ পরিত্যাগপূর্ব্বক স্ব স্ব পূর্ব্বশরণ প্রতিগ্রহণ করিলেন; কাজেই তাঁহারা পূর্ব্বে যাহা ছিলেন, আবার তাহাই হইলেন।
এদিকে ভগবান রাজগৃহে সাত আট মাস অবস্থিতি করিয়া জেতবনে প্রত্যাগমন করিলেন। তখন অনাথপিণ্ডদ পুনর্ব্বার সেই পঞ্চশত বন্ধুসহ শাস্তার নিকট উপনীত হইয়া গন্ধাদি দ্বারা তাঁহার অর্চ্চনাপূর্ব্বক একান্তে উপবেশন করিলেন। তাঁহার বন্ধুগণও শাস্তার চরণ বন্দনা করিয়া পূর্ব্বের মত আসনে উপবিষ্ট হইলেন। অতঃপর ইহারা কিরূপে তথাগতের ভিক্ষাচর্য্যার সময় বৌদ্ধশরণ পরিহার করিয়াছেন এবং অন্যান্য শরণের আশ্রয় লইয়া পূর্ব্বাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন, অনাথপিণ্ডদ সেই বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক নিবেদন করিলেন।
তচ্ছ্রবণে ভগবান মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হে উপাসকগণতোমরা ত্রিশরণ পরিহার করিয়া শরণান্তর গ্রহণ করিয়াছ, কথা সত্য কিভগবান যখন এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, তখন তাঁহার মুখপদ্ম-বিনিঃসৃত দিব্যগন্ধে চতুর্দ্দিক আমোদিত হইলহইবারই কথা, কারণ সে মুখমণ্ডল হইতে কোটিকল্পকাল কেবল সত্যই উচ্চারিত হইয়াছে। তাহা রত্নকরণ্ড-স্বরূপ, উদঘাটিত হইলে উপদেশ-রত্ন লাভ করিয়া ত্রিলোক কৃতার্থ হয়।
শ্রেষ্ঠীবন্ধুগণ সত্য গোপন করিতে অসমর্থ হইয়া বলিলেন
হাঁ ভদন্ত, কথা মিথ্যা নহে। তাহা শুনিয়া শাস্তা বলিলেন, উপাসকগণ, সর্ব্বনিম্নে অবীচি হইতে সর্ব্বোপরি ভবাগ্র পর্য্যন্ত নিখিল বিশ্বে এমন কেহই নাই যিনি শিলাদিগুণে বুদ্ধের তুল্যকক্ষ হইতে পারেন; তাঁহা হইতে উচ্চকক্ষ হওয়া সুদূরপরাহত। অনন্তর তিনি ধর্ম্মশাস্ত্র হইতে সূত্র আবৃত্তিপূর্ব্বক রত্নত্রয়ের গুণব্যাখ্যা করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, যে উপাসক বা উপাসিকা এবংবিধ উত্তমগুণসম্পন্ন ত্রিরত্নের শরণ লয়, নরকাদিতে জন্মিতে হয় না; সে ক্লেশকর পুনর্জন্ম হইতে অব্যাহতি পাইয়া দেবলোকে গমন করে এবং সেখানে অতুল সুখের অধিকারী হয়। অতএব তোমরা শরণ পরিহার এবং শরণান্তর গ্রহণ করিয়া বিপথগামী হইয়াছ।
যাহারা মোক্ষকামনায় এবং সর্ব্বোৎকৃষ্ট ফলপ্রাপ্তির আশায় ত্রিরত্নের শরণাগত হয়, তাহারা কখনও ক্লেশকর জন্ম ভোগ করে না, ইহা বিশদ করিবার জন্য নিম্নলিখিত গাথাগুলি শুনাইতে হয় :
বুদ্ধের শরণাগত নরকে না যায়;
নরলোক পরিহরি দেবলোক পায়।
ধর্ম্মের শরণাগত নরকে না যায়;
নরলোক পরিহরি দেবলোক পায়।
সঙ্ঘের শরণাগত নরকে না যায়;
নরলোক পরিহরি দেবলোক পায়।
ভূধর কন্দর কিংবা জনহীন বন,
শান্তি-হেতু লয় লোক সহস্র শরণ।
ত্রিরত্ন-শরণ কিন্তু সর্ব্বদুঃখহর;
লভিতে ইহারে সদা হও অগ্রসর।
শাস্তা কেবল এই উপদেশ দিয়াই নিরস্ত হইলেন না; তিনি পুনর্ব্বার বলিতে লাগিলেন, উপাসকগণ, বুদ্ধানুস্মৃতি, ধর্ম্মানুস্মৃতি সঙ্ঘানুস্মৃতি এই ত্রিবিধ কর্ম্মস্থান দ্বারা লোকে স্রোতাপত্তিমার্গ, স্রোতাপত্তিফল, সকৃদাগামীমার্গ, সকৃদাগামীফল, অনাগামীমার্গ, অনাগামীফল, অর্হত্ত্বমার্গ অর্হত্ত্বফল লাভ করে। উপাসকদিগকে এবংবিধ নানা উপদেশ দিয়া শাস্তা বলিলেন, তোমরা ঈদৃশ শরণ পরিত্যাগ করিয়া অতিনির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়াছ।
(বুদ্ধানুস্মৃতি প্রভৃতি কর্ম্মস্থান হইতে স্রোতাপত্তিমার্গ প্রভৃতি লাভ করা যাইতে পারে, ইহা নিম্নলিখিত শাস্ত্রবচনাদি দ্বারা সুস্পষ্টরূপে বুঝাইতে হইবে : ‘ভিক্ষুগণ, জগতে একটীমাত্র ধর্ম্ম আছে, যাহার অনুষ্ঠান সম্প্রসারণ দ্বারা মানুষ একান্ত নির্ব্বেদবৈরাগ্য, শান্তি, অভিজ্ঞা, সম্বুদ্ধি নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হইতে পারে। সেই একমাত্র ধর্ম্ম কি? তাহা বুদ্ধানুস্মৃতিইত্যাদি।)
ভগবান নানা প্রকারে উপাসকদিগকে এই সমস্ত উপদেশ দিয়া বলিলেন, উপাসকগণ, পূর্ব্বকালেও লোকে বিরুদ্ধযুক্তিবলে অশরণের শরণ লইয়া যক্ষসেবিত কান্তারে বিনষ্ট হইয়াছিল; কিন্তু যাঁহারা ধ্রুবসত্যের আশ্রয় লইয়া অবিরুদ্ধ পথে চলিয়াছিলেন, তাঁহারা সেই কান্তারেই স্বস্তিভাজন হইয়াছিলেন।
শাস্তা তূষ্ণীভাব অবলম্বন করিলে গৃহপতি অনাথপিণ্ডদ আসন হইতে উত্থিত হইলেন এবং ভগবানকে প্রণিপাতপূর্ব্বক তাঁহার গুণগান করিতে করিতে অঞ্জলিপুট দ্বারা ললাট স্পর্শ করিয়া বলিলেন, ‘প্রভু, এই উপাসকগণ যে ইহজন্মে উত্তমশরণ পরিহার করিয়া ভ্রমে পতিত হইয়াছেন, তাহা বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু অতীতকালে যক্ষসেবিত কান্তারে তার্কিকদিগের বিনাশ এবং সত্যপথাবলম্বীদিগের ঋদ্ধিলাভের কথা আমাদের জ্ঞানের অগোচর। সে বৃত্তান্ত কেবল আপনারই জানা আছে। এখন দয়া করিয়া আমাদিগের প্রবোধের জন্য সেই কথা বলুন-আকাশে পূর্ণচন্দ্র উদিত হইলে যেমন অন্ধকার বিদূরিত হয়, সেই অতীত কাহিনী শুনিয়া আমাদের অবিদ্যাও তদ্রূপ দূরীভূত হইবে।
ইহা শুনিয়া ভগবান কহিলেন, আমি জগতের সংশয়নিরাকরণার্থই কোটিকল্পকাল দানাদি দশপারমিতার অনুষ্ঠান দ্বারা সর্ব্বজ্ঞত্ব লাভ করিয়াছি। অতএব লোকে যেমন সাবধান হইয়া সুবর্ণনালিকায় সিংহবসা পূর্ণ করে, তোমরাও সেইরূপ এই কথা কর্ণকুহরে স্থান দাও।
এইরূপে শ্রেষ্ঠীর শ্রবণাকাঙ্ক্ষা জন্মাইয়া শাস্তা সেই ভবান্তর-প্রতিচ্ছন্ন অতীত কথা প্রকট করিলেন, হিমগর্ভ আকাশতল হইতে যেন পূর্ণচন্দ্র প্রকাশিত হইল।]
পুরাকালে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁহার সময়ে বোধিসত্ত্ব কোন বণিকের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। বোধিসত্ত্ব বড় হইয়া বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার পাঁচ গরুর গাড়ী ছিল। তিনি এই সকল গাড়ীতে মাল বোঝাই করিয়া কখনও পূর্ব্বদেশে, কখনও পশ্চিম দেশে বাণিজ্য করিতে যাইতেন। তখন বারাণসীতে আরও একজন তরুণবয়স্ক বণিক বাস করিত। এই ব্যক্তির বুদ্ধি অতি স্থূল ছিল; সে কোন অবস্থায় কিরূপ উপায় অবলম্বন করিতে হয় তাহা জানিত না।
একবার বোধিসত্ত্ব অনেক মূল্যবান দ্রব্যে গাড়ী বোঝাই করিয়া বিক্রয়ের জন্য কোন দূরদেশে যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছেন, এমন সময় শুনিতে পাইলেন, নির্ব্বোধ বণিকও পাঁচ গাড়ী লইয়া ঠিক সেই দেশেই যাইবার আয়োজন করিতেছেন। তখন বোধিসত্ত্ব বিবেচনা করিলেন, ‘আমাদের দুইজনের এক হাজার গাড়ী এক সঙ্গে এক পথে যাত্রা করিলে নানা অসুবিধা ঘটিবে। এতগুলি বোঝাই গাড়ীর চাকা লাগিয়া রাস্তা চুরমার ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া যাইবে, এক হাজার লোক দুই হাজার বলদের খাদ্য পানীয় সংগ্রহ করাও অসম্ভব হইবে। অতএব, একজন অগ্রে এবং অপরজন কিছুদিন পরে যাত্রা করিলে ভাল হয়।মনে মনে এইরূপ আন্দোলন করিয়া তিনি নির্ব্বোধ বণিককে ডাকাইলেন এবং সমস্ত বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘যখন আমাদের একসঙ্গে যাওয়া উচিত নহে, তখন ভাবিয়া দেখ, তুমি অগ্রে যাইবে, কি পশ্চাতে যাইবে।সে মনে করিল, ‘অগ্রে যাওয়াই ভাল, কারণ, রাস্তা এখনও ভাঙ্গিয়া চুরিয়া যায় নাই। কাজেই গাড়ী চালাইবার সুবিধা হইবে; বলদগুলিও বাছিয়া বাছিয়া ভাল ঘাস খাইতে পারিবে; আমাদের আহারের জন্য উৎকৃষ্ট ফলমূলাদির অভাব হইবে না; স্নান পানের জন্য নির্ম্মল জল পাওয়া যাইবে এবং আমি ইচ্ছামত মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করিতে পারিব।ইহা স্থির করিয়া সে বলিল, ‘মহাশয়, আমিই অগ্রে যাইব।
বোধিসত্ত্ব বলিলেন, বেশ কথা, তুমিই প্রথমে রওনা হও। তিনি ভাবিলেন, শেষে গেলেই সুবিধা; এই নির্ব্বোধ বণিকের গাড়ীর চাকায় অসমান পথ সমান হইবে; ইহার বলদগুলি পাকা ঘাস খাইয়া যাইবে, কিন্তু সকল ঘাসের কাণ্ড হইতে যে কচি পাতা বাহির হইবে, আমার বলদগুলি তাহাই খাইবে; আমরা আহারের জন্য টাটকা ফলমূল পাইব; কোথাও জলের অভাব হইলে, ইহারা যে সকল কূপ খনন করিয়া যাইবে, আমরা তাহাদের জল ব্যবহার করিতে পারিব; অধিকন্তু লোকের সহিত দরদস্থর করিয়া আমাকে জ্বালাতন হইতে হইবে না; ব্যক্তি যে দ্রব্যের যে মূল্য স্থির করিয়া যাইবে, আমি তাহাতেই ক্রয়-বিক্রয় করিব।
অনন্তর সেই নির্ব্বোধ বণিক পাঁচ গাড়ী বোঝাই করিয়া যাত্রা করিল এবং কয়েক দিন পরে লোকালয় ছাড়িয়া এক কান্তারের নিকট উপস্থিত হইল। এই কান্তার অতি ভীষণ স্থান। ইহা অতিক্রম করিবার সময় ষাট যোজনের মধ্যে কোথাও বিন্দুমাত্র জল পাওয়া যাইত না; অপিচ, এখানে যক্ষেরা বাস করিত। বণিকের অনুচরেরা ইহাতে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভাণ্ড জলপূর্ণ করিয়া গাড়ীতে তুলিয়া লইল। কিন্তু তাহারা যখন কান্তারের মধ্যভাগে পৌঁছিল, তখন যক্ষরাজ ভাবিল, ‘এই নির্ব্বোধ বণিককে বুঝাইতে হইবে যে জল বহিয়া লইয়া যাওয়া অনাবশ্যক। তাহা হইলে সমস্ত জল ফেলিয়া দিবে এবং যখন মানুষ গরু সকলেই পিপাসায় কাতর হইয়া পড়িবে, তখন আমরা অনায়াসে এই সকল লোকের প্রাণনাশ করিয়া মনের সাধে মাংস খাইব।
এই দুরভিসন্ধি করিয়া যক্ষরাজ মায়াবলে এক মনোহর শকট সৃষ্টি করিল। দুইটী তুষারধবল ষণ্ড উহা টানিতেছে; যক্ষরাজ বিভবশালী পুরুষের বেশে উহাতে উপবেশন করিয়া আছে। তাহার মস্তক নীল শ্বেত পদ্মের মালায় মণ্ডিত; কেশ বস্ত্র জলসিক্ত; শকটকের চক্র কর্দ্দমাক্ত। অগ্রে পশ্চাতে দশ বারজন যক্ষ অনুচরবেশে কার্ম্মুক, তীর, অসি, চর্ম্ম প্রভৃতি অস্ত্র শস্ত্র লইয়া চলিয়াছে; তাহাদেরও কেশ বস্ত্র আর্দ্র, মস্তকে নীলোৎপল শ্বেতপদ্মগুচ্ছ, মুখে মৃণালখণ্ড, চরণে কর্দ্দম।
সার্থবাহদিগের মধ্যে এই প্রথা আছে যে চলিবার সময় যখন সম্মুখ দিক্ হইতে বায়ু বাহিতে থাকে, তখন দলপতি ধূলা এড়াইবার জন্য সর্ব্বাগ্রে অবস্থিত করেন, আর যখন পশ্চাৎ হইতে বায়ু চলে, তখন তিনি সকলের পশ্চাতে থাকেন। যে সময়ের কথা হইতেছে, তখন বায়ু সম্মুখদিক হইতে বহিতেছিল। সুতরাং সেই নির্ব্বোধ বণিক দলের অগ্রে অগ্রে যাইতেছিল। তাহার নিকটবর্ত্তী হইয়া যক্ষরাজ নিজের শকটখানি এক পার্শ্বে সরাইয়া লইল এবং অতি মধুরভাবে সম্ভাষণ করিয়া জিজ্ঞাসিল, ‘মহাশয় কোথা হইতে আসিতেছেন?’ বণিকও যক্ষরাজের শকটখানিকে পথ দিবার জন্য নিজের শকট এক পার্শ্বে সরাইয়া রাখিল এবং কহিল, ‘মহাশয়, আমরা বারাণসী হইতে আসিতেছি। আপনার মস্তকে হস্তে পদ্ম দেখিতেছি; আপনার অনুচরেরা মৃণাল চর্ব্বণ করিতেছেন; আপনাদের বস্ত্র জলসিক্ত, শকট কর্দ্দমাক্ত। পথে বৃষ্টি হইয়াছে কি এবং আপনি আসিবার সময় পদ্মবনশোভিত জলাশয় দেখিতে পাইয়াছেন কি?’
যক্ষরাজ উত্তর করিল, বলেন কি মহাশয়? যে কিয়দ্দূরে নীলতরুরাজি দেখিতে পাইতেছেন, স্থান হইতে সমস্ত বনে কেবল জল। ওখানে সর্ব্বদাই বৃষ্টি হইতেছে; তড়াগাদি জলপূর্ণ রহিয়াছে; পথের দুই পার্শ্বে পদ্মপরিশোভিত শত শত সরোবর রহিয়াছে। এই বলিয়া সে শকটপরিচালকদিগের সহিত আলাপ করিতে করিতে চলিতে আরম্ভ করিল।
আপনারা কোথায় যাইবেন?’ ‘আমরা অমুক স্থানে যাইব।’ ‘ গাড়ীখানিতে কি মাল আছে?’ ‘অমুক মাল।’ ‘এই যে, শেষের গাড়ীখানি খুব বোঝাই হইয়াছে বলিয়া বোধহয়, উহাতে কি আছে?’ ‘উহাতে জল আছে।
জল আনিয়া ভালই করিয়াছিলেন, কারণ এতক্ষণ জলের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন আর জল আবশ্যক হইবে না; সম্মুখে প্রচুর জল পাওয়া যাইবে। এখন ভাণ্ডের জল ফেলিয়া দিন; তাহা হইলে বোঝা কম হইবে; গাড়ী শীঘ্র শীঘ্র চলিতে পারিবে।
তাহার পর যক্ষরাজ বলিল, আপনারা অগ্রসর হউন, আমরাও যাই; কথায় কথায় অনেক সময় গিয়াছে দেখিতেছি। অনন্তর সে কিয়দ্দূর অগ্রসর হইল এবং যেমন দেখিল, বণিকের দল দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়াছে, অমন যক্ষপুরে ফিরিয়া গেল।
এদিকে নির্ব্বোধ বণিক যক্ষরাজের পরামর্শমত জলভাণ্ডগুলি ভাঙ্গিয়া ফেলিল, পানের জন্য গণ্ডূষমাত্র জল রাখিল না। এইরূপে বোঝা কমাইয়া সে পুনর্ব্বার পথ চলিতে আরম্ভ করিল; কিন্তু বহুদূর অগ্রসর হইয়াও কুত্রাপি জলের লেশমাত্র দেখিতে পাইল না। ক্রমে সকলে পিপাসায় কাতর হইয়া পড়িল। অবশেষে সূর্য্যাস্তের পর গাড়ী থামাইয়া তাহারা বলদগুলি খুলিয়া, তাহাদিগকে দড়ি দিয়া চাকার সহিত বান্ধিয়া গাড়ীগুলি চারিদিকে সাজাইয়া স্কন্ধাবার প্রস্তুত করিল এবং নিজেরা তাহার মধ্যভাগে রহিল। কিন্তু মনুষ্য পশু কাহারও ভাগ্যে বিশ্রামসুখ ঘটিল না। বলদগুলি জল খাইতে পাইল না, মনুষ্যেরাও জলাভাবে ভাত রাঁধিতে পারিল না; সকলেই ক্ষুধায় পিপাসায় অবসন্ন হইয়া ভূতলে আশ্রয় লইল।
ইহার পর অন্ধকার হইল; যক্ষেরা নগর হইতে বাহির হইয়া মানুষ গরু সমস্ত মারিয়া ফেলিল এবং তাহাদের মাংস খাইয়া চলিয়া গেল। এইরূপে সেই বণিকের বুদ্ধির দোষে তাহার দলের সমস্ত প্রাণী বিনষ্ট হইল; তাহাদের কঙ্কালগুলি চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িয়া থাকিল। কিন্তু তাহাদের শকট বা শকটস্থ দ্রব্য যেমন ছিল, তেমনই রহিল; কেহই সেগুলিতে হাত দিল না।
বোধিসত্ত্ব নির্ব্বোধ বণিকের প্রায় দেড়মাস পরে নিজের পাঁচ গাড়ী লইয়া বারাণসী হইতে যাত্রা করিলেন এবং যথাসময়ে সেই কান্তারের নিকট গিয়া পৌঁছিলেন। তিনিই এখানে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভাণ্ড পূর্ণ করিয়া প্রচুর জল তুলিয়া লইলেন এবং ভেরী বাজাইয়া অনুচরদিগকে নিজের শিবিরে আহ্বানপূর্ব্বক বলিলেন, ‘এখন আমাদিগকে যে কান্তারের ভিতর দিয়া যাইতে হইবে, তাহার কোথাও জল পাওয়া যায় না; তাহার মধ্যে নাকি অনেক বিষবৃক্ষও আছে। অতএব তোমরা কেহই আমার অনুমতি বিনা অঞ্জলিমাত্র জল ব্যবহার করিও না আমাকে জিজ্ঞাসা না করিয়া কোন অজানা পাতা, ফুল বা ফলও মুখে দিও না।
অনুচরদিগকে এইরূপে সাবধান করিয়া বোধিসত্ত্ব এই কান্তারের ভিতর প্রবেশ করিলেন। তিনি যখন উহার মধ্যভাগে উপস্থিত হইলেন, তখন যক্ষরাজ পূর্ব্ববৎ বেশভূষা করিয়া তাঁহার সমীপবর্ত্তী হইল। বোধিসত্ত্ব তাহাকে দেখিয়াই বুঝিলেন, মনুষ্য নহে, যক্ষ। তিনি ভাবিলেন, নিরুদক মরুদেশে জল কোথা হইতে আসিবে? ব্যক্তির চক্ষু এত রক্তবর্ণ এবং মূর্ত্তি এত উগ্র কেন? কেনই বা ভূমিতে ইহার ছায়া পড়ে না?নির্ব্বোধ বণিক বেচারি নিশ্চয় ইহার কথায় ভুলিয়া জল ফেলিয়া দিয়াছে এবং অনুচরগণসহ যক্ষদিগের উদরস্থ হইয়াছে। দুরাত্মা যক্ষ জানে না, আমি কেমন বুদ্ধিমান উপায়কুশল। অনন্তর তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, দুর পাপিষ্ঠ। আমরা বণিক, আমরা স্বচক্ষে জলাশয় দেখিতে না পাইলে কখনও সঞ্চিত জল ফেলিয়া দিই না; যখন অন্য জল পাইবার উপায় দেখিব, তখন নিজের বুদ্ধিতেই বোঝা কমাইবার জন্য গাড়ীর জল ঢালিয়া ফেলিব, তোর কাছে পরামর্শ লইতে যাইব না।
উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইল দেখিয়া যক্ষরাজ কিয়দ্দূর অগ্রসর হইল এবং যখন বোধিসত্ত্বের দৃষ্টিপথ অতিক্রম করিল, তখন যক্ষপুরে ফিরিয়া গেল। তখন বোধিসত্ত্বের অনুচরেরা বলিতে লাগিল, ‘মহাশয়, লোকটা না বলিল, অদূরে যে নীলবন দেখা যাইতেছে, ওখানে সর্ব্বদা বৃষ্টি হইতেছে? দেখিলাম, উহার উহার সহচরদিগের মাথায় পদ্মের মালা, হাতে পদ্মের তোড়া, উহাদের চুল কাপড় ভিজা; উহারা মৃণাল খাইতে খাইতে যাইতেছে। অঞ্চলে যখন এত জল পাওয়া যায়, তখন বৃথা বহন করিয়া কষ্ট পাই কেন? অনুমতি দিন এখনই সমস্ত জল ঢালিয়া ফেলিয়া বোঝা হালকা করিয়া লই।
তখন বোধিসত্ত্ব গাড়ীগুলি থামাইয়া দলের সমস্ত লোক একস্থানে সমবেত করিলেন এবং জিজ্ঞাসিলেন, এই মরুভূমিতে জলাশয় আছে কথা তোমরা পূর্ব্বে কখনও শুনিয়াছ কি? তাহারা বলিল, না মহাশয়, এখানে জলাশয় নাই এবং সেই জন্য ইহার নাম নিরুদক কান্তার।
উহারা বলিল, ‘আমাদের সম্মুখে যে নীলবন দেখা যাইতেছে, ওখানে বৃষ্টি হইতেছে। আচ্ছা, বল , বৃষ্টি হইলে কত দূর হইতে জলো হাওয়া টের পাওয়া যায়?’ ‘এক যোজন দূরে বৃষ্টি হইলেও ঠাণ্ডা বাতাস গায় লাগে।’ ‘তোমরা ঠাণ্ডা বাতাস পাইয়াছ কি?’ ‘না মহাশয়, ঠাণ্ডা বাতাস পাই নাই।’ ‘যে মেঘে বৃষ্টি হয়, তাহার অগ্রভাগ কতদূর হইতে দেখিতে পাওয়া যায়?’ ‘এক যোজন দূর হইতে।’ ‘আচ্ছা, তোমরা কেহ আজ মেঘের লেশমাত্র দেখিতে পাইয়াছ কি?’ ‘না, মহাশয়।’ ‘কত দূর হইতে বিদ্যুতের আভা দেখিতে পাওয়া যায় বলিতে পার কি?’ ‘চার পাঁচ যোজন দূর হইতে।’ ‘তোমরা কেহ আজ বিদ্যুৎ দেখিতে পাইয়াছ কি?’ ‘না, মহাশয়।’ ‘কত দূর হইতে মেঘগর্জ্জন শুনিতে পাওয়া যায়?’ ‘দুই এক যোজন দূর হইতে।’ ‘তোমরা কেহ আজ মেঘগর্জ্জন শুনিয়াছ কি?’ ‘না, মহাশয়।
এখন তোমাদিগকে প্রকৃত কথা বলিতেছি। যে সকল ব্যক্তি আমাদিগকে জল ফেলিয়া দিতে পরামর্শ দিল, তাহারা মানুষ নহে, যক্ষ। তাহাদের অভিসন্ধি এই যে, জল ফেলিয়া দিলে আমরা ক্লান্ত হইয়া পড়িব; তখন তাহারা অনায়াসে আমাদিগকে নিহত করিয়া পেট পুরিয়া মাংস খাইবে। আমার আশঙ্কা হইতেছে, আমাদের অগ্রে যে যুবক বণিক আসিয়াছিল, সে উপায়কুশল নয় বলিয়া যক্ষদিগের কথায় ভুলিয়া জল ফেলিয়া দিয়াছে এবং অনুচরদিগের সহিত বিনষ্ট হইয়াছে। সম্ভবতঃ আজই আমরা তাহার সেই মালবোঝাই পাঁচ গাড়ী দেখিতে পাইব। তোমরা যত শীঘ্র পার, অগ্রসর হইতে থাক; সাবধান, বিন্দুমাত্র জলও যেন ফেলা না হয়।
তখন সকলে দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল এবং যেখানে নির্ব্বোধ বণিকের গাড়ীগুলি পড়িয়া ছিল সেইখানে উপস্থিত হইল। বোধিসত্ত্ব তথায় বিশ্রাম করিবার সঙ্কল্প করিয়া অনুচরদিগকে বলদগুলি খুলিয়া দিতে, গাড়ীগুলি মণ্ডালাকারে সাজাইয়া স্কন্ধাবার প্রস্তুত করিতে এবং শীঘ্র শীঘ্র আহারের ব্যবস্থা করিতে বলিলেন। কিয়ৎক্ষণের মধ্যে মনুষ্য গো সকলেরই ভোজন শেষ হইল, বোধিসত্ত্ব বলদগুলি স্কন্ধাবার মধ্যে রাখিয়া অনুচরদিগকে তাহাদের চতুষ্পার্শ্বে ঘিরিয়া থাকিতে বলিলেন এবং দলের কয়েকজন বাছা বাছা লোক লইয়া তরবারি-হস্তে পাহারা দিতে লাগিলেন। এইরূপে সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল।
প্রভাত হইলে বোধিসত্ত্ব যাহা কর্ত্তব্য, তাহার ব্যবস্থা করিলেন; বলদগুলিকে খাওয়াইলেন; নিজের যে সকল গাড়ী জীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, সেগুলি ত্যাগ করিয়া নির্ব্বোধ বণিকের ভাল ভাল গাড়ী বাছিয়া লইলেন, নিজের সঙ্গে যে সমস্ত অল্পমূল্য দ্রব্য ছিল, সেগুলিও ফেলিয়া দিয়া তদপেক্ষা মূল্যবান দ্রব্য তুলিয়া লইলেন। অতঃপর তিনি গন্তব্য স্থানে গিয়া দ্বিগুণ, ত্রিগুণ মূল্যে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করিয়া স্বদেশে প্রতিগমন করিলেন; তাঁহার সঙ্গীদিগের এক প্রাণীও বিনষ্ট হইল না।
কথান্তে শাস্তা বলিলেন, গৃহপতি, পূর্ব্বে তার্কিকগণ এইরূপে বিনষ্ট হইয়াছিল; কিন্তু সত্যসেবিগণ যক্ষদিগের হস্ত হইতে মুক্তিলাভপূর্ব্বক নিরাপদে গন্তব্য স্থানে উপনীত হইয়াছিলেন এবং সেখান হইতে স্বদেশে ফিরিয়া গিয়াছিলেন।
এইরূপ উপস্থিত প্রসঙ্গের সহিত অতীত কথার সম্বন্ধ প্রদর্শন করিয়া শাস্তা ধ্রুবসত্য-শিক্ষাদানার্থ অভিসম্বুদ্ধ ভাবধারণপূর্ব্বক নিম্নলিখিত গাথা আবৃত্তি করলেন :
সত্যপথ, যাহা সর্ব্ব সুখের কারণ,
করেন পণ্ডিতজন সদা প্রদর্শন।
তার্কিকের কাজ কিন্তু এর বিপরীত;
কুপথে চালায়ে করে লোকের অহিত।
অতএব বিচারিয়া বুদ্ধিমান নর,
সত্যের শরণ লয়, সর্ব্বদুঃখহর।
ধ্রুবসত্য সম্বন্ধে এবংবিধ উপদেশ দিয়া শাস্তা পুনর্ব্বার বলিতে লাগিলেন, সত্যপথে বিচরণ করিলে যে কেবল ত্রিবিধ কুশল সম্পত্তি, ষড়বিধ কামস্বর্গ এবং ব্রহ্মলোক-সম্পত্তি লাভ করা যায় তাহা নহে; তৎসঙ্গে সঙ্গে অর্হত্ত্বপ্রাপ্তি পর্যন্ত ঘটে। পক্ষান্তরে অসত্যমার্গ অবলম্বন করিলে চতুর্ব্বিধ অপায় ভোগ করিতে হয় এবং নীচকুলে জন্ম হইয়া থাকে। অতঃপর শাস্তা ষোড়শবিধ উপায়ে সত্যচতুষ্টয় ব্যাখ্যা করিলেন। তাহা শুনিয়া সেই পঞ্চশত উপাসক স্রোতাপত্তি-ফলে প্রতিষ্ঠাপিত হইলেন।
তখন দেবদত্ত ছিল সেই নির্ব্বোধ সার্থবাহ এবং তাহার শিষ্যেরা ছিল সেই সার্থবাহের অনুচরগণ। পক্ষান্তরে তখন বুদ্ধশিষ্যেরা ছিলেন সেই বুদ্ধিমান সার্থবাহের অনুচরগণ এবং আমি ছিলাম সেই বুদ্ধিমান সার্থবাহ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !