বণ্ণুপথ-জাতক।

শাস্তা শ্রাবস্তী নগরে অবস্থানকালে জনৈক হীনবীর্য্য ভিক্ষুকে উপলক্ষ করিয়া এই কথা বলিয়াছিলেন। শুনা যায় তথাগত যখন শ্রাবস্তী নগরে অবস্থিতি করিতেছিলেন, তখন তাঁহার ধর্ম্মদেশনা শ্রবণ করিয়া তত্রত্য এক কুলপুত্রেরপ্রতীতি জন্মে যে, কামনাই দুঃখের নিদান। অতএব তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিলেন, অভিসম্পদা-লাভার্থ পঞ্চবর্ষকাল জেতবনে অবস্থিতি করিয়া ক্লান্ত পরিশ্রমে মাতৃকাদ্বয় আয়ত্ত করিলেন, কি কি উপায়ে বিদর্শনা লাভ করা যায় তাহা শুনিলেন এবং শাস্তার নিকট ইচ্ছানুরূপ কর্ম্মস্থান গ্রহণ করিয়া অরণ্যে প্রস্থানপূর্ব্বক তাহার আভাস বা লক্ষণমাত্রও লাভ করিতে পারিলেন না। তখন তিনি ভাবিতে লাগিলেনশাস্তা চতুর্ব্বিধ মনুষ্যের কথা বলিয়াছেন; আমি বোধহয় তন্মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা অধম। সম্ভবতঃ এজন্মে আমার ভাগ্যে মার্গপ্রাপ্তি ফলপ্রাপ্তি ঘটিয়া উঠিবে না। অতএব অরণ্যে বাস করিয়া কি লাভ? আমি শাস্তার নিকট ফিরিয়া যাই; তাঁহার অলৌকিক তেজোবিশিষ্ট বুদ্ধদেহ অবলোকন করিয়া নয়ন সার্থক হইবে; মধুর ধর্ম্মকথা শুনিয়া কর্ণ তৃপ্ত হইবে। এই সঙ্কল্প করিয়া উক্ত ভিক্ষু জেতবনে প্রতিগমন করিলেন।

একদিন তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ বলিলেন, ভাই, তুমি না শাস্তার নিকট হইতে কর্ম্মস্থান লইয়া শ্রমণধর্ম্ম আচরণ করিবার নিমিত্ত বনে গিয়াছিলে? কিন্তু এখন দেখিতেছি বিহারে ফিরিয়া ভিক্ষুদিগের সহিত সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করিতেছ। তুমি কি প্রব্রজ্যার চরম লক্ষ অর্হত্ত্ব-ফল লাভ করিয়াছ? তিনি উত্তর করিলেন, ভ্রাতৃগণ, আমি মার্গ ফল কিছুই লাভ করিতে পারি নাই। আমি দেখিলাম, আমার ভাগ্যে সিদ্ধিলাভ ঘটিবে না। সেইজন্য নিরুদ্যম হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি। তুমি যখন দৃঢ়বীর্য্য শাস্তার শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়াছ, তখন নিরুদ্যম হইয়া ভাল কর নাই। চল, তোমায় শাস্তার নিকট লইয়া যাই। ইহা বলিয়া তাঁহারা নিরুৎসাহ ভিক্ষুকে শাস্তার নিকট লইয়া গেলেন।

শাস্তা জিজ্ঞাসিলেনভিক্ষুগণ, তোমরা এই ব্যক্তিকে ইহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখানে আনিলে কেন? কি করিয়াছেভিক্ষুরা বলিলেন, ভদন্ত, ইনি এতাদৃশ নির্ব্বাণপ্রদ শাসনে প্রব্রজ্যাগ্রহণ করিয়াও শ্রমণধর্ম্ম আচরণ করিবার সময় নিরুদ্যম হইয়া বিহারে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। তখন শাস্তা জিজ্ঞাসা করিলেন,  কিহে ভিক্ষু, তুমি সত্যই কি ভগ্নোৎসাহ হইয়াছ?’ ভিক্ষু উত্তর করিলেন, হাঁ ভদন্ত, আমি সত্য সত্যই ভগ্নোৎসাহ হইয়াছি। কি কথা? কোথায় ঈদৃশ শাসনে প্রব্রজ্যা লইয়া তুমি নিষ্কাম, সন্তুষ্ট, নির্জনবাসী দৃঢ়োৎসাহ হইবে, না তুমি হীনবীর্য্য হইয়া পড়িলে! তুমি পূর্ব্বে বিলক্ষণ বীর্য্যবান ছিলে! তোমারই বীর্য্যপ্রভাবে একদা মরুকান্তারে পঞ্চশত শকটের গো মনুষ্যগণ পানীয় পাইয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছিল। তবে এখন তোমার দশা ঘটিল কেনশাস্তার এই কথা শুনিবামাত্র উক্ত ভিক্ষুর হৃদয়ে আবার উৎসাহের সঞ্চার হইল।

শাস্তার কথা শুনিয়া ভিক্ষুরা বলিলেন, ভদন্ত, এই ভিক্ষুর বর্ত্তমান নিরুৎসাহভাব আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি; কিন্তু পূর্ব্বে কেবল ইহারই বীর্য্যবলে মরুকান্তারে মনুষ্যদিগের পানীয়প্রাপ্তির কথা আমাদের জ্ঞানাতীত; আপনি সর্ব্বজ্ঞ বলিয়া তাহা কেবল আপনারই পরিজ্ঞাত আছে। দয়া করিয়া আমাদিগকে সেই বৃত্তান্ত বলুন। বলিতেছি শুন; ইহা বলিয়া ভিক্ষুদিগের শ্রবণাকাঙ্ক্ষা উৎপাদনপূর্ব্বক ভগবান তখন ভাবান্তর প্রতিচ্ছন্ন সেই অতীত কথার প্রকটন করিলেন :

পুরাকালে বারাণসীনগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁহার সময়ে বোধিসত্ত্ব এক বণিকের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। বোধিসত্ত্ব বয়ঃপ্রাপ্তির পর পঞ্চশত শকট লইয়া নানা স্থানে বাণিজ্য করিয়া বেড়াইতেন।

একদা বোধিসত্ত্ব ষষ্ঠিযোজন বিস্তীর্ণ এক মরুকান্তারে প্রবেশ করিয়াছিলেন। সেখানকার বালুকা এত সূক্ষ্ম ছিল যে, মুষ্টি মধ্যে রাখিতে চেষ্টা করিলে তাহা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়া পড়িয়া যাইত। সূর্যেদয়ের পর এই বালুকারাশি প্রজ্বলিত অঙ্গারের ন্যায় উত্তপ্ত হইয়া উঠিত। তখন কাহার সাধ্য উহার উপর দিয়া যাতায়াত করে? এই ভীষণ মরুদেশ অতিক্রম করিবার সময় পথিকেরা রাত্রিকালে পথ চলিত, দিবাভাগে বিশ্রাম করিত। তাহারা জল, তেল, চাউল জ্বালাইবার কাঠ প্রভৃতি উপকরণ সঙ্গে লইয়া যাইত। যখন সূর্য্যোদয় হইত, তখন তাহারা বলদগুলি খুলিয়া দিত; গাড়ীগুলি মণ্ডলাকারে রাখিয়া মধ্যভাগে সামিয়ানা খাটাইত এবং সকাল সকাল আহার শেষ করিয়া ছায়ায় থাকিয়া দিনমান কাটাইত। অনন্তর যখন সূর্য্যাস্ত হইত, তখন তাহারা আবার শীঘ্র শীঘ্র আহার করিয়া ভূতল শীতল হইবামাত্র পথ চলিতে আরম্ভ করিত। নাবিকেরা যেমন সমুদ্রগমনকালে নক্ষত্র দেখিয়া দিগনির্ণয় করে, এই মরুভূমিতেও সেইরূপ পথিকদিগকে নক্ষত্র দেখিয়া পথ নির্দ্ধারণ করিতে হইত। তাহাদিগের সঙ্গে এক একজন স্থল-নিয়ামক থাকিত। উহারা নক্ষত্র দেখিয়া গন্তব্য পথ নির্দ্দেশ করিয়া দিত।

বোধিসত্ত্ব যেদিন উক্ত কান্তারের ঊনষাট যোজন অতিক্রম করিয়া গেলেন, সেইদিন মনে করিলেনআজকার রাত্রিতেই আমরা মরুভূমির বাহিরে গিয়া পৌঁছিব। ইহা ভাবিয়া তিনি সায়মাশের পর জল, কাঠ প্রভৃতি অনেক দ্রব্য অনাবশ্যক বোধে ফেলিয়া দিতে বলিলেন এবং এইরূপে বোঝা কমাইয়া গন্তব্য স্থানাভিমুখে যাত্রা করিলেন। যে গাড়ীখানি সর্ব্বাগ্রে চলিল, স্থল-নিয়ামক তাহাতে আসন গ্রহণ করিল এবং কোন দিকে গাড়ী চালাইতে হইবে, নক্ষত্র দেখিয়া বলিয়া দিতে লাগিল।

নিয়ামকটী দীর্ঘকাল সুনিদ্রা ভোগ করে নাই। আজ কিয়দ্দূর চলিবার পর সে নিদ্রাভিভূত হইয়া পড়িল, কাজেই বলদগুলা যখন বিপরীত মুখে চলিতে আরম্ভ করিল, তখন তাহা লক্ষ করিতে পারিল না। গাড়ীগুলি সারারাত এইরূপে উল্টা পথে চলিল। অনন্তর অর্বণোদয়ের প্রাক্কালে নিয়ামকের নিদ্রাভঙ্গ হইলে সে নক্ষত্র দেখিয়া গাড়ী ফিরাও, গাড়ী ফিরাও বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। কিন্তু সমস্ত গাড়ী ফিরাইয়া পুনর্ব্বার শ্রেণীবদ্ধ করিতে না করিতেই সূর্য্য দেখা দিলেন; সকলে সভয়ে দেখিল, তাহারা সায়ংকালে যে স্থান হইতে যাত্রা করিয়াছিল, ঠিক সেইস্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছে। তখন হায়, সর্ব্বনাশ হইল; আমাদের সঙ্গে জল নাই, কাঠ নাই, আজ কি উপায়ে জীবন ধারণ করিব?-এইরূপ বিলাপ করিতে করিতে তাহারা বলদগুলি খুলিয়া দিয়া এবং নিতান্ত হতাশ হইয়া যে যাহার গাড়ীর তলে শুইয়া পড়িল।

বোধিসত্ত্ব ভাবিলেন, আমি নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া থাকিলে ইহাদের এক প্রাণীরও জীবন রক্ষা হইবে না। ভোরের সময় ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় একবার চারিদিকে ঘুরিয়া দেখি, কোথাও জল পাওয়া যায় কি না। অনন্তর তিনি ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে করিতে একস্থানে একগুচ্ছ কুশ দেখিতে পাইলেন। ইহাতে তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন স্থানের নিম্নে নিশ্চয় জল আছে; নচেৎ মরুক্ষেত্রে কখনও কুশ জন্মিতে পারে না। তখন তিনি অনুচরদিগকে কোদাল দিয়া স্থান খনন করিতে বলিলেন। তাহারা খনন করিতে প্রবৃত্ত হইল, কিন্তু যখন ষাট হাত নিম্নেও জল পাওয়া গেল না, অপিচ পাষাণে কোদাল লাগিয়া ঠং ঠং করিয়া উঠিল, তখন তাহারা নিতান্ত নিরুদ্যম হইয়া পড়িল। কিন্তু বোধিসত্ত্ব আশা ছাড়িলেন না। তিনি কূপমধ্যে অবতরণ করিয়া পাষাণের উপর কাণ পাতিলেন এবং নিম্নে জলপ্রবাহের শব্দ শুনিতে পাইলেন। তখন তিনি উপরে উঠিয়া নিজের বালক ভৃত্যকে বলিলেন, তুমি নিরুদ্যম হইলে সকলেই মারা যাইবে। তুমি সাহসে ভর করিয়া এই বড় হাতুড়িটা লইয়া নিচে নাম এবং পাথরে ঘা মার।

বালক ভৃত্যটী বিলক্ষণ উৎসাহবান ছিল। অন্য সকলে উদ্যমহীন হইয়াছে দেখিয়াও সে নিরুদ্যম হইল না। সে দ্বিরুক্তি না করিয়া প্রভুর আদেশ পালন করিল; অমনি পাষাণ বিদীর্ণ হইয়া গেল। তখন অবরুদ্ধ জলরাশি তালাপ্রমাণ-স্তম্ভাকারে ঊর্ধ্বে উত্থিত হইল এবং সকলে মহানন্দে স্নান করিতে লাগিল। সঙ্গে যে সকল প্রয়োজনাতিরিক্ত ধুরা প্রভৃতি ছিল, সেইগুলি চিরিয়া তাহারা জ্বালানি কাঠের যোগাড় করিয়া লইল এবং ভাত রান্ধিয়া খাইল। শেষে গরুগুলিকে খাওয়াইয়া এবং কূপপার্শ্বে একটা ধ্বজা তুলিয়া তাহারা সন্ধ্যার পর অভীষ্ট দেশাভিমুখে যাত্রা করিল। সেখানে তাহারা দ্বিগুণ, চতুর্গুণ মূল্যে পণ্য বিক্রয় করিয়া স্বদেশে ফিরিয়া গেল এবং আয়ুঃশেষ হইলে স্ব স্ব কর্ম্মফলভোগার্থ দেহত্যাগ করিল। বোধিসত্ত্বও দানাদি পুণ্য কর্ম্মে জীবন যাপন করিয়া দেহত্যাগান্তে কর্ম্মানুরূপ ফলভোগ করিতে গেলেন।

কথা শেষ হইলে সম্যকসম্বুদ্ধ অভিসম্বুদ্ধ-ভাব ধারণপূর্ব্বক এই গাথা পাঠ করিলেন :
সুগভীর কূপ করিল খনন অক্লান্ত বণিকদল,
তাই তারা পে ভীম মরুস্থলে প্রচুর শীতল জল।
সেইরূপ জে, জ্ঞানীজন যত বিচরণে ভূমণ্ডলে,
হৃদয়ের শান্তি লভেন তাঁহারা অধ্যবসায়ের বলে।
অনন্তর শাস্তা আর্য্যসত্যচতুষ্টয় ব্যাখ্যা করিলেন। তচ্ছ্রবণে সেই হীনবীর্য্য ভিক্ষু চরম ফল অর্থাৎ অর্হত্ত্ব লাভ করিল।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !