বৌদ্ধ কাহাকে বলে ও তাঁহার গুরু কে

The Buddha

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী  লিখিত “বৌদ্ধধর্ম” নামক গ্রন্থ থেকে ....

বৌদ্ধধর্ম যত লোকে মানে, এত লোকে আর কোনো ধর্ম মানে না। চীনের প্রায় সমস্ত লোকই বৌদ্ধ৷ জাপান, কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং সাইবিরিয়ার অধিকাংশ লোকই বৌদ্ধ। তিব্বতের সব লোক বৌদ্ধ। ভুটান, সিকিম, রামপুরবুসায়রের সব লোক বৌদ্ধ৷ নেপালের অর্ধেকেরও বেশি বৌদ্ধ। বর্মা, সায়ামং ও আনাম অবচ্ছেদাবচ্ছেদে বৌদ্ধ। সিংহলদ্বীপে অধিকাংশ বৌদ্ধ।

বৌদ্ধধর্ম না মানিলেও ভারতবর্ষের অধিকাংশ হিন্দুই বৌদ্ধদিগের অনেক আচার ব্যবহার গ্রহণ করিয়াছেন। ভারতবর্ষের মধ্যে এখনো অনেক জায়গায় বৌদ্ধ মত একটু বিকৃতভাবে চলিতেছে। চাটগাঁ, রাঙামাটির তো কথাই নাই। উহারা বর্মা আরাকানের শিষ্য। উড়িষ্যার গড়জাত মহলের মধ্যে অনেকগুলি রাজ্যে এখনো বৌদ্ধ মত চলে৷

তাহার মধ্যে বোধ নামক রাজ্য যে বৌদ্ধমতাবলম্বী তাহা নামেই প্রকাশ পাইতেছে। বৌদ্ধেরা এই সকল মহলে অনেকদিন প্রচ্ছন্নভাবে ছিলেন। সম্প্রতি তাঁহারা মহিমপন্থ নামে এক নূতন বৌদ্ধ মত চালাইয়াছেন।

বাংলায় যাহারা ধর্মঠাকুরের পূজা করে তাহারা যে বৌদ্ধ একথা এখন কেহ অস্বীকার করেন না। বিঠোবা ও বিল নারায়ণের প্রতিমূর্তি বলিয়া পূজা হয়, কিন্তু এই দুই দেবতার ভক্তেরা আপনাদিগকে বৌদ্ধ বৈষ্ণব বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে।

বাঙালিদের মধ্যে যে তন্ত্রশাস্ত্র চলিতেছে তাহাতে বৌদ্ধধর্মের গন্ধ ভরভর করে। যাহারা বলেন ৫ম মহাশূন্যে তারা ও ৬ষ্ঠ মহাশূন্যে কালিকা, তাঁহারা বৌদ্ধ ভিন্ন আর-কিছুই নহেন কারণ কোনো হিন্দু কখনো শূন্যবাদী হন নাই, হইবেন না ও ছিলেন না।

এককালে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব আরো বিস্তার হইয়াছিল। তুর্কিস্তান এককালে বৌদ্ধধর্মের আকর ছিল। সেখান হইতে সাময়েদরা এবং তুর্কিস্তানের পশ্চিমের লোকেরা বৌদ্ধধর্ম পাইয়াছিল। পারস্য এককালে বৌদ্ধধর্মপ্রধান ছিল। আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান পুরাই বৌদ্ধ ছিল। পারস্যের পশ্চিমে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব নিতান্ত কম ছিল না। কারণ রোমান কাথলিকদিগের অনেক আচার ব্যবহার, রীতিনীতি, পূজা-পদ্ধতি, বৌদ্ধদেরই মতো।

রোমান কাথলিকদের মধ্যে দুইজন ‘সেন্ট’ বা মহাপুরুষ আছেন, তাঁহাদের নাম ‘বারলাম’ ও ‘জোসেফ্‌ফ্ট৭। অনেক পণ্ডিত স্থির করিয়াছেন যে, এই দুইটি শব্দ বৌদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব শব্দের রূপান্তরমাত্র। অনেকে এই বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস লিখিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু কেহই ইহার সম্পূর্ণ ইতিহাস দিতে সক্ষম হন নাই। কারণ বৌদ্ধেরা বড়ো আপনাদের ইতিহাস লিখেন নাই। মুসলমানেরা সাত শত বৎসর ভারতবর্ষে রাজত্ব করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহারা ভারতের বৌদ্ধধর্মের নামও শুনেন নাই।

তবকতিনাশিরি ওদস্তপুরী বিহার ধ্বংস হইবার ইতিহাস দিয়াছেন। তিনি বলেন, মহম্মদি বক্তিয়ার ঐ বিহারটাকে কেল্লা বলিয়া মনে করিয়াছিলেন এবং যখন উহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া সমস্ত “দুর্গরক্ষী সৈন্য” বধ করিয়া ফেলিলেন, তখন দেখিলেন, সৈন্যদিগের চেহারা আর- এক রকম; তাহাদের সব মাথা মুড়ানো ও পরনে গেরুয়া কাপড়। তখন তিনি মনে করিলেন, ইহারা “সব মাথা মুড়ানো ব্রাহ্মণ”।

আবুল ফাজল এত বড়ো ‘আইনি আকবরি’ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহাতেও বৌদ্ধধর্মের নাম গন্ধ পাওয়া যায় না। বৌদ্ধদের ইতিহাস লিখিবার চেষ্টা হিন্দুতে করে নাই, মুসলমানেরাও করে নাই, বৌদ্ধেরাও বড়ো করে নাই; করিয়াছেন ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা, আর সেই ইউরোপীয়দিগের শিষ্য শিক্ষিত ভারতসন্তান। কিন্তু ইহাদের চেষ্টা কিরূপ হইতেছে?

শোনা যায় এককালে কোনো অন্ধনিবাসের লোকে হাতি দেখিতে ইচ্ছা করিয়াছিল। সকলেই অন্ধ, সুতরাং তাহাদের জীবন্ত হাতি দেখানো কঠিন। সেইজন্য অধ্যক্ষ অন্ধগুলিকে একটি মরা হাতির কাছে লইয়া গেলেন। কানারা হাত বুলাইয়া হাতি দেখিতে লাগিল৷ কেহ শুঁড়ে হাত বুলাইল, কেহ কানে হাত বুলাইল, কেহ দাঁতে হাত বুলাইল, কেহ মাথায় হাত বুলাইল, কেহ পিঠে হাত বুলাইল, কেহ পায়ে হাত বুলাইল, কেহ লেজে হাত বুলাইল, সকলেরই হাতি দেখা শেষ হইল। শেষে সকলে বাড়ি ফিরিয়া আসিল। সেখানে সকলে ঝগড়া করিতে লাগিল। কেহ বলিল হাতি কুলার মতো, কেহ বলিল হাতি নলের মতো, কেহ বলিল হাতি উল্টা ধামি, কেহ বলিল হাতি বড়ো উঁচু, কেহ বলিল হাতি থামের মতো, কেহ বলিল হাতি চামরের মতো৷ সকলেই বলিতে লাগিল ‘আমার মতই ঠিক’।

সুতরাং ঝগড়া চলিতেই লাগিল, কোনোরূপ মীমাংসা হইল না। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সম্বন্ধেও প্রায় সেইরূপই ঘটিয়াছে। ইউরোপীয়েরা সিংহলদ্বীপেই প্রথম বৌদ্ধধর্ম দেখেন ও সেইখানেই পালি শিখিয়া বৌদ্ধদের বই পড়িতে আরম্ভ করেন। তাঁহারা বলেন বৌদ্ধধর্ম কেবল ধর্মনীতির সমষ্টিমাত্র, উহাতে কেবল বলে ‘হিংসা করিও না’, ‘মিথ্যা কথা কহিও না’, ‘চুরি করিও না’, ‘পরস্ত্রীগমন করিও না’, ‘মদ খাইও না'।

হজ্‌স্‌ [Brian Houghton Hodgson] সাহেব নেপালে বৌদ্ধধর্ম পাইলেন। তিনি দেখিলেন, বৌদ্ধদের অনেক দর্শন গ্রন্থ আছে এবং তাহাদের দর্শন অতি গভীর। কেহ বা শুদ্ধ বিজ্ঞানবাদীমাত্র, কেহ বা তাহাও বলেন না। যে সকল দর্শনের মত আঠারো ও ঊনিশ শতে ইউরোপে প্রথম প্রকাশ হইয়াছিল, তিনি সেই সকল মত নেপালের পুথির মধ্যে পাইলেন এবং বুঝিতে পারিলেন যে, এসকল মত বৌদ্ধদের মধ্যে দুই তিন শতে চলিতেছিল।

বিশপ বিগাণ্ডেট ১০ ব্রহ্মদেশে বৌদ্ধধর্ম দেখিতে পান। তিনি দেখেন, উহার আকার অন্যরূপ। উহাতে পূজাপাঠ ইত্যাদির বেশ ব্যবস্থা আছে। তিনি দেখেন, বৌদ্ধমঠ মাত্রেই এক-একটি পাঠশালা। ছোটো ছোটো ছেলেরা পড়ে।

যিনি তিব্বত দেশের বৌদ্ধধর্ম দেখিলেন, তিনি দেখিলেন, সেখানে কালীপূজা হয়, সেখানে মন্ত্রতন্ত্র আছে, হোমজপ হয়, মানুষপূজা হয়।

চীন দেশের বৌদ্ধধর্ম আবার আর-এক রূপ। তাহারা সব মাংস খায়, সব জন্তু মারে; অথচ বৌদ্ধ।

জাপানিরা বলে ‘আমরা মহাযান অপেক্ষাও দার্শনিকমতে উপরে উঠিয়াছি।' অথচ আবার তাহাদের মধ্যে এক দল বৌদ্ধ আছে, তাহারা নানারূপ দেবদেবীর উপাসনা করে।

এইরূপে বৌদ্ধধর্ম নানা দেশে নানা মূর্তি ধারণ করিয়া রহিয়াছে; কোথাও বা উহা পূর্বপুরুষের উপাসনার সহিত মিশিয়া গিয়াছে, কোথাও বা ভূত প্রেত উপাসনার সহিত মিশিয়া গিয়াছে, কোথাও বা দেহতত্ত্ব উপাসনার সহিত মিশিয়া গিয়াছে। কোথাও কোথাও আবার খাঁটি বুদ্ধের মত চলিতেছে, কোথাও খাঁটি নাগার্জুনের মত চলিতেছে।

সুতরাং সমস্ত বৌদ্ধধর্মের একখানি পুরা ইতিহাস লেখা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপর আবার ভাষার গোল। বুদ্ধের বচনগুলি তিনি কী ভাষায় বলিয়াছিলেন জানা যায় না। তাঁহার বাড়ি ছিল কোশলের উত্তরাংশে। তিনি ধর্মপ্রচার করিয়াছিলেন কোশলে ও মগধে। এই দুই দেশের লোক বুঝিতে পারে এমন কোনো ভাষাতে তিনি ধর্মপ্রচার করিয়াছিলেন। এই দুই দেশেও আবার ভিন্ন অঞ্চলের লোকের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ছিল। তিনি সংস্কৃত ভাষায় বলেন নাই। যে সকল অতি প্রাচীন বৌদ্ধ পুস্তক পাওয়া গিয়াছে, তাহা না সংস্কৃত না মাগধী, না কোশলী; একরূপ মাঝামাঝি গোছের ভাষা।

সংস্কৃত পণ্ডিতেরা বোধ হয় ইহারই নাম দিয়াছেন ‘মিশ্র ভাষা’। একজন ইউরোপীয় পণ্ডিত ইহারই নাম দিয়াছেন Mixed Sanskrit.

‘বিমলপ্রভা নামে নয় শতের এক পুথিতে আমরা দেখিলাম যে, তৎকালে নানা ভাষায় বুদ্ধের বচন লেখা হইয়াছিল; মগধ দেশে মগধ ভাষায়, সিন্ধু দেশে সিন্ধু ভাষায়, বোট দেশে বোট ভাষায়, চীন দেশে চীন ভাষায়, মহাচীনে মহাচীন ভাষায়, পারস্য দেশে পারস্য ভাষায়, রুহ্ম দেশে রুহ্ম ভাষায়।

আমরা জানি পারস্য দেশে মগের ধর্ম চলিত ছিল, অর্থাৎ সেখানকার লোক অগ্নি উপাসক ও জরথ্রসার শিষ্য ছিল। সে দেশে যে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ছিল, একথাই শুনি নাই। তাহাদের ভাষায় যে আবার বৌদ্ধবচনগুলি লিখিত হইয়াছিল সে খবরও এই নূতন।

রুহ্ম দেশ কাহাকে বলে, জানি না, রোম হইবারই সম্ভাবনা। কারণ, ‘বিমলপ্ৰভায় বলে, উহা নীলা নদীর উত্তর। ‘বিমলপ্রভায় আরো একটি নূতন খবর পাওয়া গিয়াছে। প্রাকৃত ও অপ্রভ্রংশ ভাষায়ও বুদ্ধদিগের অনেক সংগীত লেখা হইয়াছিল, এ খবর এ পর্যন্ত অতি অল্প লোকেই জানেন।

বৌদ্ধ কাহাকে বলে, একথা লইয়া নানা মুনির নানা মত আছে। যাঁহারা সিংহলের বৌদ্ধধর্ম দেখিয়া এবং পালি পুস্তক পড়িয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাঁহারা বলেন, যাঁহারা সংসার ত্যাগ করিয়া বিহারে বাস করেন, তাঁহারাই যথার্থ বৌদ্ধ।

গৃহস্থ বৌদ্ধদের তাঁহারা বৌদ্ধ বলিতে রাজি নহেন। তাঁহারা বলেন, ‘ত্রিপিটকে’ যাহা কিছু ব্যবস্থা আছে, সবই বিহারবাসী ভিক্ষুদের জন্য। ‘বিনয়পিটকে’ যত বিধিব্যবস্থা আছে, সবই ভিক্ষুসংঘের জন্য। গৃহস্থ বৌদ্ধ উপাসক উপাসিকাদের তাহাতে স্থান নাই।

আবার কেহ কেহ বলেন, যাহারা “পঞ্চশীল” গ্রহণ করে অর্থাৎ

  • ১. প্রাণাতিপাত করিব না
  • ২. মিথ্যাকথা কহিব না
  • ৩. চুরি করিব না
  • ৪. মদ খাইব না 
  • ৫. ব্যভিচার করিব না

—এই পাঁচটি নিয়ম পালন করিবার জন্য প্রতিজ্ঞা করে, তাহারাও বৌদ্ধ। কিন্তু তাহা হইলে এক জায়গায় ঠেকিয়া যায়। যে সকল জাতি দিন রাত প্রাণীহিংসা করিয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, যথা জেলে, মালা, কৈবর্ত, শিকারি, ব্যাধ, খেট, খটিক্ প্রভৃতি জাতির বৌদ্ধধর্মে প্রবেশের অধিকার একেবারেই থাকে না।

এদিকে আবার যাহারা নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি স্থানের বৌদ্ধধর্ম দেখিয়াছেন, তাঁহারা বলেন পৃথিবীসুদ্ধই বৌদ্ধ; কারণ, যিনি বোধিসত্ত্ব হইবেন, তাঁহাকে জগৎ উদ্ধারের প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে।

লঙ্কাবাসীর মতো আপনাকে উদ্ধার করিয়াই নিশ্চিন্ত থাকিলে চলিবে না। এইজন্য নেপাল ও তিব্বতবাসীরা লঙ্কাবাসীদিগকে হীনযান বৌদ্ধ বলেন এবং আপনাদিগকে মহাযান বৌদ্ধ বলেন। এখানে ‘যান' শব্দের অর্থ লইয়া অনেক বিবাদবিসংবাদ আছে। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা কেহ কেহ উহার ইংরাজি করেন Vehicle অর্থাৎ গাড়ি ঘোড়া ইত্যাদি।

কিন্তু বাস্তবিক বৌদ্ধদিগের মধ্যে ‘যান’ শব্দের অর্থ পন্থ বা মত। আমরা যেমন এখন বলি নানকপন্থী দাদুপন্থী কবীরপন্থী, সেকালে বৌদ্ধেরা সেইরূপ বলিত শ্রাবক্যান, প্রত্যেকযান, বোধিসত্ত্বযান, মন্ত্রযান ইত্যাদি। Vehicle- এর সহিত উহার কোনো সম্পর্ক নাই।

মহাযান বৌদ্ধেরা আপনাদের বড়ো দেখাইবার জন্য আগেকার বৌদ্ধদিগকে হীনযানী বলিত, আর আপনাদিগকে বোধিসত্ত্বযান বলিত। মহাযানী বৌদ্ধেরা যদি জগৎই উদ্ধার করিতে বসিলেন, তবে জগৎ সুদ্ধই তো বৌদ্ধ হইয়া উঠিল।

তাঁহারা বলেন ‘আমরা বৈষ্ণব, শাক্ত, সৌর, গাণপত, পৌত্তলিক, রাজপূজক, ব্রাহ্মণপূজক প্রভৃতি সকলকেই উদ্ধার করিব। কিন্তু সে উদ্ধারের পথ কী, সেকথা তাঁহারা স্পষ্ট করিয়া বলেন না; এইমাত্র বলেন ‘যাহার যাহাতে ভক্তি, আমরা সেইরূপ ধারণা করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিব'। এ বিষয়ে কারণ্ডব্যূহে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে।

বুদ্ধদেব, বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “তুমি কী করিয়া জগৎ উদ্ধার করিবে? জগতে তো নানা মুনির নানা মত, লোকে তোমার কথা শুনিবে কেন?

”তখন করুণামূর্তি অবলোকিতেশ্বর বলিতেছেন, “আমি বিষ্ণুবিনেয়দিগকে বিষ্ণুরূপে উদ্ধার করিব, শিববিনেয়দিগকে শিবরূপে উদ্ধার করিব, বিনায় কবিনেয়দিগকে বিনায়করূপে উদ্ধার করিব, রাজবিনেয়দিগকে রাজরূপে উদ্ধার করিব, রাজভটবিনেয়দিগকে রাজভটরূপে উদ্ধার করিব।” এরূপে তিনি যে কত দেবতার বিনেয়দিগকে কতরূপে উদ্ধার করিবেন বলিয়াছেন, তাহা লিখিতে গেলে পুথি বাড়িয়া যায়, সেইজন্য উপরে তাহার কয়েকটিমাত্র দেওয়া হইল।

এ মতে তাহা হইলে সকলেই বৌদ্ধ। এখন যেমন থিওজফিস্ট মহাশয়েরা বলেন, “তোমরা যে ধর্মেই থাকো, যে দেবতার উপাসনাই করো, ধর্মে এবং চরিত্রে বড়ো হইবার চেষ্টা করিলেই, তোমরা থিওজফিস্ট এবং যে কেহ থিওজফিস্ট হইতে পারে।”

এও কতকটা সেইরূপ, তবে ইঁহাদের অপেক্ষা মহাযানী বৌদ্ধদের জগতের প্রতি করুণা কিছু বেশি ছিল। তাঁহারা নিজেই চেষ্টা করিয়া জগৎ উদ্ধার করিতে যাইতেন। তোমার চেষ্টা থাকুক, আর নাই থাকুক, তাঁহারা বলিতেন, “আমরা নিজগুণে তোমায় উদ্ধার করিব”।

সেইজন্য মহাযান ধর্মের সারের সার কথা “করুণা”। উঁহাদের প্রধান গ্রন্থের নাম ‘প্রজ্ঞাপারমিতা। উহার নানারূপ সংস্করণ আছে; এক সংস্করণ শত সহস্র শ্লোকে, এক সংস্করণ পঁচিশ হাজার শ্লোকে, আর এক সংস্করণ দশ হাজার শ্লোকে, এক সংস্করণ আট হাজার শ্লোকে, এক সংস্করণ সাত শত শ্লোকে, আর এক সংস্করণ, সকলের চেয়ে ছোটো, স্বল্পাক্ষরা ‘স্বল্পাক্ষরা প্রজ্ঞাপারমিতা’— উহার তিনটি পাতা মাত্র।‘

প্রজ্ঞাপারমিতা আরম্ভ করিতে হইলে কতকটা গৌরচন্দ্রিকা চাই শেষ করিতে গেলেও কতকটা আড়ম্বর চাই। এইসব বাহ্য আড়ম্বর ছাড়িয়া দিলে উহাতে একটিমাত্র কথা সার “সকল জীবে করুণা করো”। মহাযানের মর্ম গীতায় একটি শ্লোকে প্রকাশ করিয়াছেন। সে শ্লোকটি অনেকেরই অভ্যাস আছে।

যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্ৰদ্ধয়াৰ্চিতুমিচ্ছতি।
তস্য তাস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহং॥(alert-success)

গীতায় এ কথাটি ভগবানের মুখে দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু মহাযানে এই ভাবের কথা প্রত্যেক বোধিসত্ত্বের মুখে।

বোধিসত্ত্বেরা নির্বাণের অভিলাষী, তাঁহারা মানুষ। ভগবানের মুখে যেকথা শোভা পায়, মানুষের মুখে সেকথা আরো অধিক শোভা পায়। ইহাতে বুঝা যায়, তাঁহাদের করুণা কত গভীর। মহাযান মতে তাহা হইলে জীবমাত্রেই বৌদ্ধ, কিন্তু একথায় তো কাজ চলে না। ভারতবর্ষে তখন নানারূপ ধর্ম ছিল, মত ছিল, দর্শন ছিল, পন্থ ছিল, যান ছিল।

মহাযান যেন বলিলেন, সকলেই বৌদ্ধ; কিন্তু তাঁহাদের বিরুদ্ধবাদীরা সেকথা মানিবে কেন? সুতরাং বৌদ্ধ কাহাকে বলে, এ বিচারের প্রয়োজন চিরদিন ছিল, এখনো আছে। ইহার মীমাংসা কী?

বৌদ্ধেরা জাতি মানে না যে, ব্রাহ্মণাদির মতো জন্মিবামাত্রই ব্রাহ্মণ হইবে বা ক্ষত্রিয় হইবে বা শূদ্র হইবে, বৈষ্ণব হইবে বা শৈব হইবে। একে তো বৌদ্ধ গৃহস্থেরা বৌদ্ধ কিনা তাহাতেই সন্দেহ, তারপর তাহাদের ছেলে হইলে, সে ছেলে বৌদ্ধ হইবে কিনা তাহাতে আরো সন্দেহ। এখনো এ বিষয়ে কোনো ইউরোপীয় বা এদেশীয় পণ্ডিতেরা কোনো মীমাংসা করেন নাই, কিন্তু শুভাকরগুপ্তের ’আদিকৰ্ম্ম রচনা’ নামক বৌদ্ধদের স্মৃতিতে ইহার এক চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দেওয়া আছে।

তিনি বলেন, যে কেহ ত্রিশরণ গমন করিয়াছে সেই বৌদ্ধ! ত্রিশরণ শব্দের অর্থ

“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”

“ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি”

“সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি”

“দ্বিতীয়মপি বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”

“দ্বিতীয়মপি ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি”

“দ্বিতীয়মপি সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি”

“তৃতীয়মপি বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”

“তৃতীয়মপি ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি”

“তৃতীয়মপি সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি”(alert-success)

 

বোধ হয় অতি প্রাচীন কালে ত্রিশরণ গমনের জন্য কোনো পুরোহিতের প্রয়োজন হইত না, লোকে আপনারাই ত্রিশরণ গ্রহণ করিত। কিন্তু পরে পুরোহিতের নিকট ত্রিশরণ লইবার ব্যবস্থা হয়।

‘হস্তসার’ গ্রন্থে ভিক্ষুর নিকট ত্রিশরণ লইবার ব্যবস্থা আছে। যেমন খৃস্টানের পুত্র হইলেই সে খৃস্টান হয় না, তাহাকে বাপ্টাইজ করিলে তবে সে খৃস্টান হয়, সেইরূপ বৌদ্ধ পিতামাতার পুত্র হইলেও, যতক্ষণ সে ত্রিশরণ গমন না করে, ততক্ষণ তাহাকে বৌদ্ধ বলা যায় না।

বৌদ্ধদের যতগুলি ধর্মকর্ম আছে, তাহার মধ্যে যে গুলিকে তাহারা অত্যন্ত সহজ বলিয়া মনে করিত এবং সকলের আগে সম্পন্ন করিত, সেই গুলিকে আদিকর্ম বলিত৷ সেইসকল আদিকর্মের মধ্যেও আবার ত্রিশরণ গমন সকলের আদি।

‘বিমলপ্রভায়ও লেখা আছে, আগে ত্রিশরণ গমন, পরে এই জন্মেই বুদ্ধ হইবার জন্য কালচক্র মতে লৌকিক ও লোকোত্তর সিদ্ধির চেষ্টা করিতে হইবে।

রত্নত্রয়ের শরণ লইলেই যদি বৌদ্ধ হয় এবং সেরূপ শরণ লইবার জন্য যদি পুরোহিতের প্রয়োজন না থাকে, তাহা হইলে জেলে, মালা, কৈবর্তদের বৌদ্ধধর্মে প্রবেশের আর বাধা রহিল না।

‘বিনয়পিটকে’ লেখা আছে যে, যে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইবে, তাহাকে ভিক্ষু করিতে পারিবে না ও তাহাকে সংঘে লইতে পারিবে না; কিন্তু তাই বলিয়া কি সে বেচারি বৌদ্ধ হইতে পারিবে না? শুভাকরগুপ্তের ব্যবস্থায় সে অনায়াসে বৌদ্ধ বলিয়া গণ্য হইবে৷

বৌদ্ধধর্মের শুরু প্রথম অবস্থায় বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসীর ধর্ম ছিল। যে সন্ন্যাস লইবে তাহাকে একজন সন্ন্যাসীকে মুরুব্বি করিয়া সন্ন্যাসীর আখড়ায় যাইতে হইত৷ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নাম ভিক্ষু। সন্ন্যাসীর দলের নাম সংঘ। যেখানে সন্ন্যাসীরা বাস করিত তাহার নাম সংঘারাম। সংঘারামের মধ্যে প্রায়ই একটি মন্দির থাকিত, তাহার নাম বিহার। সেই মন্দিরের নাম হইতেই বৌদ্ধভিক্ষুদের আখড়াগুলিকে বিহারই বলিয়া থাকে৷

শিক্ষানবিশ একজন ভিক্ষুকে মুরুব্বি করিয়া সংঘে উপস্থিত হন। সেখানে গেলে সর্বাপেক্ষা বুড়া ভিক্ষু, যাহাকে স্থবির বা থেরা বলে, তিনি নবিশকে কতকগুলি কথা জিজ্ঞাসা শ্রাবক্যানের করেন। জিজ্ঞাসার সময় সঙ্গে আর পাঁচ জন ভিক্ষুও থাকা চাই।

স্থবির নবিশের নামধাম জিজ্ঞাসা করিয়া লইতেন। তাহার কোনো উৎকট রোগ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করিতেন, সে রাজদণ্ডে দণ্ডিত কিনা, তাহা জিজ্ঞাসা করিতেন, সে রাজার কোনো চাকরি করে কিনা তাহাও জিজ্ঞাসা করিতেন।

তিনি আরো জিজ্ঞাসা করিতেন, তাহার ভিক্ষাপাত্র আছে কিনা, তাহার চীবর আছে কিনা, অর্থাৎ, ভিক্ষু হইতে গেলে যে- সকল জিনিস দরকার, তাহা তাহার আছে কিনা। সে এসব জিনিস আছে বলিলে তিনি সংঘকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “আপনারা বলুন, এই লোককে সংঘে লওয়া যাইতে পারে কিনা। যদি আপনাদের ইহাতে কোনো আপত্তি থাকে, স্পষ্ট করিয়া বলুন, যদি না থাকে তবে চুপ করিয়া থাকুন।”

তিনি এইরূপ তিন বার বলিলে, যদি কোনো আপত্তি না উঠিত, তবে তিনি নবিশকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “তোমার উপাধ্যায় কে?” সে উপাধ্যায়ের নাম বলিলে, তাঁহার হস্তে তাহাকে সমর্পণ করিয়া দেওয়া হইত। সে উপাধ্যায়ের নিকট সন্ন্যাসীর কী কী কাজ, সব শিখিত।

এখনকার ছেলেরা যেমন মাস্টার মহাশয়দের মান্য করিয়া চলে, শিক্ষানবিশ, শ্রমণেরা, সেইরূপে আপনার উপাধ্যায়কে মান্য করিয়া চলিত৷ ক্রমে সে সব শিখিয়া লইলে, তাহাতে ও উপাধ্যায়ে কোনো প্রভেদ থাকিত না৷ সংঘে বসিলে, দু জনের সমান ভোট হইত।

বুদ্ধদেব যখন নন্দকে “প্রব্রজ্যা” দিয়াছিলেন, তখন তিনি উহাকে বৈদেহ মুনির হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলেন। বৈদেহ মুনি নন্দকে আপনার বন্ধুর মতো দেখিতেন, বন্ধুর মতো উদাহরণ তাহাকে পরামর্শ দিতেন ও শিক্ষা দিতেন।

বুদ্ধদেব মধ্যে মধ্যে বৈদেহ মুনিকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “কেমন, নন্দ বেশ শিখিতেছে তো?” বৈদেহ মুনি যেমন জানিতেন, সমস্ত খুলিয়া বলিতেন। যেখানে বৈদেহ মুনি নন্দকে কোনো বিষয় বুঝাইতে অক্ষম হইতেন, বুদ্ধদেব নিজে গিয়া তাঁহাকে উহা বুঝাইয়া দিতেন।

মহাকবি অশ্বঘোষের ‘সৌন্দরনন্দ' কাব্যে বৈদেহ মুনি ও নন্দের অনেক কথা লেখা আছে। তাহাতে বেশ দেখা যায়, বৈদেহ মুনি নন্দের উপাধ্যায় হইলেও দু জনে পরস্পর বন্ধুভাবেই বাস করিতেন, তাঁহারা পরস্পর আপনাদিগকে সমান বলিয়া মনে করিতেন।

মহাযান বৌদ্ধেরা উপাধ্যায়কে “কল্যাণমিত্র” বলিত। কল্যাণমিত্র শব্দ হইতেই বেশ বুঝা যাইতেছে যে, উভয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, সে গুরুশিষ্যের সম্পর্ক নয়, পরলোকের কল্যাণকামনায় গুরুশিষ্যের মিত্র মাত্র।

মহাযান-মতাবলম্বীরা দর্শনশাস্ত্রের খুব চর্চা করিতেন। এখানে গুরুশিষ্যে অত্যন্ত প্রভেদ হইবারই কথা, কিন্তু তাহা হইত না। সংঘে অধিকার দু জনেরই সমান থাকিত এবং উভয়ে পরস্পরের মিত্র হইতেন।

মন্ত্রযানের গুরু ক্রমে যখন এত দর্শনশাস্ত্র পড়া, এত যোগ ধ্যান করা অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হইতে লাগিল, যখন ভিক্ষুরা বিবাহ করিতে লাগিলেন, প্রকাণ্ড একদল গৃহস্থ্য-ভিক্ষু হইয়া দাঁড়াইল, তখন মন্ত্রযানের উৎপত্তি হইল। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “মন্ত্র জপ করিলেই, পাঠ, স্বাধ্যায়, তপ প্রভৃতি সকল ধর্মকর্মেরই ফল পাওয়া যাইবে।

‘প্রজ্ঞাপারমিতা' পড়িতে অনেক বৎসর লাগে, বুঝিতে আরো বেশি দিন লাগে এবং ‘প্রজ্ঞাপারমিতার ক্রিয়াকর্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে আরো বেশি দিন লাগে। এত তো তুমি পারিবে না বাপু, তুমি এই মন্ত্রটি জপ করো, তাহা হইলে সব ফল পাইবে।

”যখন বৌদ্ধধর্মের এই মত দাঁড়াইল, তখন গুরুশিষ্যের সম্পর্কটা খুব আঁটাআঁটি হইয়া গেল। তখন তিনটি কথা উঠিল 'গুরুপ্রসাদ’, ‘শিষ্যপ্রসাদ’, ‘মন্ত্রপ্রসাদ’, অর্থাৎ গুরুকে ভক্তি করিতে হইবে, শিষ্যকে স্নেহ করিতে হইবে, এবং মন্ত্রের প্রতি আস্থা থাকিবে।

যে সময় বৌদ্ধধর্মের মধ্যে মন্ত্রযান প্রবেশ করে, সে সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে গুরুশিষ্যের কিরূপ সম্বন্ধ ছিল জানা যায় না।

ব্রাহ্মণদের মধ্যে আচার্য ও শিষ্যের সম্পর্ক পিতাপুত্রের সম্পর্কের মতো। বাস্তবিকও যিনি শিক্ষা দিবেন, তিনি পিতার কার্যই করিবেন। সন্তানের শিক্ষার ভার তো পিতারই, তবে তিনি যদি না পারেন, তবে একজন প্রতিনিধির হস্তে সন্তানকে সমর্পণ করিয়া দিবেন। শিক্ষক বা আচার্য পিতার প্রতিনিধিমাত্র। আচার্যের মৃত্যুতে শিষ্যের ত্রিরাত্র অশৌচ গ্রহণ করিতে হইত। এখনো যিনি গায়ত্রী উপদেশ দেন, সেই আচার্য- গুরু মরিলে, ব্রাহ্মণকে ত্রিরাত্র অশৌচ গ্রহণ করিতে হয়। কিন্তু শিষ্য গুরুর দাস, তাঁহার যথাসর্বস্ব গুরুর, এই যে একটা উৎকট মত ভারতীয় ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে চলিতেছে, এ মতের মূলই মন্ত্রযান।

মন্ত্রযানের গুরু ও শিষ্যের মধ্যে আর সেরূপ সমান ভাবটি রহিল না, একজন বড়ো ও একজন ছোটো হইয়া গেল। বজ্রযানে গুরু আরো বড়ো হইয়া উঠিলেন। তিনি স্বয়ং বজ্রধারী। এই যানের প্রধান কথা এই যে, দেবতাদিগের এবং বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদিগের বজ্রধর নামে একজন পুরোহিত হইলেন।

পঞ্চধ্যানীবুদ্ধের উপর বজ্রসত্ত্ব নামে আর একজন বুদ্ধ হইলেন। তাঁহাকে উহারা বুদ্ধগণের পুরোহিত বলিয়া মানিয়া থাকে। বজ্রসত্ত্ব কতকটা আদিবুদ্ধ বা ঈশ্বরের স্থান অধিকার করিয়া বসিলেন। এই মতের গুরুদিগকে বজ্রাচার্য বলিত।

বজ্রাচার্যের পাঁচটি অভিষেক হইত, মুকুটাভিষেক, ঘণ্টাভিষেক, মন্ত্রাভিষেক, সুরাভিষেক ও পট্টাভিষেক। তাঁহার দেশীয় নাম গুভাজু, অর্থাৎ, তিনি গুরু, তাঁহাকে সকলে ভজনা করিবে। সুতরাং শিষ্য হইতে তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন।

মন্ত্রযানে গুরুকে শিষ্যের “প্রসাদ” খুঁজিতে হইত, বজ্রযানে তাহার কোনোই দরকার নাই।

সহজযানের গুরুর উপদেশই সব। গুরুর উপদেশ লইয়া মহাপাপ কার্য করিলেও তাহাতে মহাপুণ্য হইবে। সহজযানের একজন গ্রন্থকার বলিতেছেন যে, যে পঞ্চকাম উপভোগের দ্বারা মূর্খলোক বদ্ধ হয়, গুরুর উপদেশ লইয়া সেই পঞ্চকাম উপভোগ করিয়াই সে মুক্ত হইয়া যায়।

গুরু উবএসো অমিঅরসু হবহিণি পীঅউ জেহি।

বহু সখথ মরুস্থলিহিং তিসিএ মরিথউ তেহি॥ [বৌ-গা-দো, পৃ. ১০২](alert-success)

“গুরুর উপদেশই অমৃতরস। যে- সকল হাবারা উহা পান না করে তাহারা বহু শাস্ত্রার্থরূপ মরুস্থলীতে তৃষ্ণায় মরিয়া যায়। ”গুরুর উপদেশ ভিন্ন সহজপন্থীদের কোনো জ্ঞানই হয় না; আগম, বেদ, পুরাণ, তপ, জপ সমস্তই বৃথা; গুরুর উপদেশমাত্রই সত্য।

আগমবেঅপুরাণে পংড়িত্ত মাণ বহংতি।

পক্ক সিরিফল অলিঅ জিম বাহেরিত ভুময়ন্তি॥ [বৌ-গা-দো, পৃ. ১২৩](alert-success)

 “যাহারা আগম, বেদ ও পুরাণ পড়িয়া আপনাদের পণ্ডিত মনে করিয়া গর্ব করে তাহারা পক্ক শ্রীফলে অলির ন্যায় বাহিরে বাহিরেই ঘুরিয়া বেড়ায়।” এইরূপে যতই বৌদ্ধধর্মের পরিবর্তন হইতে লাগিল, গুরুর সম্মানও বাড়িয়া যাইতে লাগিল৷ কালচক্রযান কালচক্রানে যে গুরুর মান্য কত অধিক তাহা একটি কথাতেই প্রমাণ হইয়া যাইবে। ‘লঘুকালচক্রতন্ত্রের টীকা ‘বিমলপ্রভা’ যিনি লিখিয়াছেন, সেই পুণ্ডরীক, আপনাকে অবলোকিতেশ্বরের নির্মাণকায় বা অবতার বলিয়া মনে করিতেন। সুতরাং তিনি স্বয়ং অবলোকিতেশ্বর, আর কেহ নহেন।

কালচক্রযানের পর লামাযানের উৎপত্তি। সকল লামাই কোনো-না-কোনো বড়ো বোধিসত্ত্বের অবতার। সুতরাং তিনি সাক্ষাৎ বোধিসত্ত্ব, সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী। লামাযান ক্রমে উঠিয়া দলাইলামাযানে পরিণত হইয়াছে।

দলাইলামা অবলোকিতেশ্বরের অবতার। তিনি মরেন না, তাঁহার কায় মধ্যে মধ্যে নূতন করিয়া নির্মাণ হয়। তিনি একাকায় ত্যাগ করিয়া কায়ান্তর ধারণ করেন। বৌদ্ধধর্মে প্রথমে যে উপাধ্যায় মিত্রমাত্র ছিলেন, এক্ষণে তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের অবতার।

বৌদ্ধধর্মের এই দৃষ্টান্ত হিন্দুর সংসারেও প্রবেশ করিয়াছে। তন্ত্রমতে গুরুই পরমেশ্বর, গুরুর পাদপূজা করিতে হয়, যাহা ব্রাহ্মণের একেবারে নিষেধ, সেই গুরুর উচ্ছিষ্ট ভোজন করিতে হয়, গুরু শিষ্যের সর্বস্বের অধিকারী, যে শিষ্য ধনজন, আপন স্ত্রীপুত্র ও দেহ পর্যন্ত গুরুসেবায় নিয়োগ করিতে পারে সেই পরম ভক্ত।

বৈষ্ণবের মতেও তাই। তাহাতেও তৃপ্ত না হইয়া অনেকে এখন কর্তাভজা হইতেছেন। তাঁহারা বলেন, “গুরু সত্য, জগন্মিথ্যা, যা করাও তাই করি, যা খাওয়াও তাই খাই, যা বলাও তাই বলি।”

‘নারায়ণ’

অগ্রহায়ণ, ১৩২১

সূত্র: বৌদ্ধধর্ম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

চলমান: হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা “বৌদ্ধধর্ম”  বইটি ধারাবাহিক চলবে। সম্পূর্ণ বইটির পিডিএফ পেতে আমাদের কমেন্ট করুন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !