বৌদ্ধধর্মে সৃষ্টিকর্তা বিশ্বাস

Good Question and Good Answer



বুদ্ধশিক্ষার অনুসারী হলে আপনাকে বুদ্ধশিক্ষা সম্পর্কে স্পষ্ট জানা থাকতে হবে। আগে ও পরে উৎপন্ন বেশিভাগ ধর্ম 'ঈশ্বর-আত্মা' বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বুদ্ধের ধর্মশিক্ষায় বিশ্বাসের কোন স্থান নেই। কারণ বিশ্বাস কোনো কিছুর সত্যতা নয়, বরং সত্যের অনুপস্থিতি হলো বিশ্বাস।

বিশ্বাসের বাতাসে নিজেদের ভাসিয়ে দেওয়া জ্ঞানের কথা নয়, বরং কোন বিশ্বাসদ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, শক্তভাবে দাঁড়িয়ে সত্যের অনুসন্ধান করা জ্ঞানের কথা।

ঈশ্বর-আত্মা বিশ্বাসের সুলভ প্রচারের ফলে বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে থাকেন, সহজে মনে হয় বিশ্বাস হলো সত্য, এমন মনে করার কারণে বুদ্ধের অনুসারী অনেকে বিচলিত হন, আবার অনেকে চুপসে থাকেন।

অথচ বুদ্ধের শিক্ষায় একজন খাঁটি শিক্ষার্থী এমন পরিস্থিতিতে বিচলিত হবেন না, কারণ তিনি জানেন, কোনো বিশ্বাসই সত্য নয়, সব বিশ্বাস কেবল অন্ধ ভক্তিতে ভাসমান।

বৌদ্ধ দর্শনে ঈশ্বর প্রসঙ্গে লেখাটা সকলে পড়ুন।

 

প্রশ্ন- বৌদ্ধরা কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?

উত্তরঃ না, বৌদ্ধেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। এর স্বপক্ষে কয়েকটি যুক্তি আছে।

আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতো বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরে বিশ্বাসের বিষয়টি মানুষের মনের ভয়-ভীতি থেকে সৃষ্ট। বুদ্ধ বলেছেন, ভয়ার্থ মানুষ তথাকথিত পবিত্র পাহাড়-পর্বতে, গুহায়, পবিত্র বৃক্ষের তলায় কিংবা দেব-দেবীর স্মৃতি মন্দিরে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন।

আদিম অধিবাসী মানুষকে ভয়াবহ বিপদজনক প্রতিকূল পরিবেশে বসবাস করতে হতো। চারপাশে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয়, ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব, শারিরীক আঘাত ও রোগের যন্ত্রণা, বিদ্যুৎ চমকানো বজ্রাঘাত এবং আগ্নেয়গিরির ভয় সংকুল পরিবেশে মানুষ নিজেকেঅসহায় বোধ করতো।

কোথাও নিরাপত্তা খুজেঁ না পেয়ে ভয়ার্থ মানুষ নিরাপত্তার আশ্রয় হিসেবে ঈশ্বর কল্পনা করেন। ঈশ্বরের কাছে বিপদের সময় সাহস, দুঃসময়ে সান্তনা এবং সুসময়ে স্বস্তি লাভ করেন। আপনি লক্ষ্য করবেন বিপদে পড়লে মানুষ বেশী ধার্মীক হয়ে উঠেন।

বিপদ সংকট উত্তরণের জন্য দেব-দেবী বা কোন অদৃশ্য শক্তির কাছে প্রার্থনা করা হয়, যাতে সেই শক্তি বিপদশুক্ত করেন। এতে বিপদগ্রস্ত মানুষের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। যাঁরা যেই দেব-দেবীতে বিশ্বাসী, তাদেঁর প্রার্থনা অভিষ্ট সেই দেব-দেবী শোনেন এবং সাড়া দেন বলে বিশ্বাস করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে, অজ্ঞতা জনিত ভয়ের কারণে ঐরূপ বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। ভয়ের কারণ বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে , হতাশার কারণ অনিয়ন্ত্রিত ভোগতৃঞ্চা প্রশমিত করতে এবং অপ্রতিরোধ্য বিষয়গুলোকে শান্ত, ধৈর্যশীল ও সাহসী হয়ে মোকাবিলা করার জন্য বুদ্ধের উপদেশ প্রণিধানযোগ্য।

ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার দ্বিতীয় কারণ হলো ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব। ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মগ্রন্থ সমূহে ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পর্কে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে উদ্ধৃত বিষয়সমূহ সঠিক, অন্যদের সঠিক নয় বলে দাবি করা হয়। কেউ ঈশ্বরকে পুরুষ, কেউ ঈশ্বরকে নারী, আবার কেউ ক্লিব হিসেবে বিশ্বাস করেন।

প্রত্যেকের নিজ নিজ বিশ্বাস সত্য, অন্যদের বিশ্বাস মিথ্যা বলে দাবি ও উপহাস করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, বিগত শত শত বছর ধরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে তর্ক বিতর্কের উর্ধে, সুনিশ্চিত ও বিজ্ঞানসম্মত কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। সেই কারণে, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত, বৌদ্ধরা বিষয়টি মুলতবি রেখে দিতে চান।

ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার তৃতীয় কারণ হলো, শুদ্ধ সার্থক জীবন যাপনে ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। অনেকে মনে করতে পারেন, বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির রহস্য উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এই রুপ কোন বিশ্বাস ছাড়াই সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। আবার কেউ মনে করেন, সুখী ও উৎকণ্ঠাহীন জীবনযাপনে ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রয়োজন। এ কথাও ঠিক বলে মনে হয় না।

শুধুমাত্র বৌদ্ধরা নন্, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন, যাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন্। তাঁরা অন্যান্যদের মত কার্যকারণের নিয়মে কর্মফল ভোগ করে জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। আবার অনেকে মনে করেন, নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চারের জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রয়োজন। কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন্, এমন অনেকে আছেন, যাঁরা আত্মবিশ্বাস ও নিজেদের কর্মোদ্যমে বাঁধা-বিপত্তি ও পঙ্গুত্বের অক্ষমতা অতিক্রম করে সফলতার চুড়াঁয় আরোহণ করেছেন।

আবার কেউ মনে করেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস আত্মমুক্তির সহায়ক। বুদ্ধ নিজের সাধনলদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, প্রতিটি মানুষ মনের কলুষ দূর করে, মৈত্রী করুণার আদেশে জীবনযাপনে প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারেন এবং আপন প্রজ্ঞা শক্তিতে অভিষ্ট লক্ষ্য অজর্ন করতে সক্ষম। বুদ্ধ মানুষের দৃষ্টিকে অলৌকিক ঈশ্বর কেন্দ্রিকতা থেকে মানবকেন্দ্রিকতায় ফিরিয়ে এসেছেন এবং আত্মশক্তি দিয়ে নিজ সমস্যা সমাধানে মানুষকে উজ্জিবীত করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে অলৌকিক কল্পনাশ্রিত শক্তি অপেক্ষা অভিজ্ঞচালক আত্মশক্তি অনেক বেশী শক্তিশালী। প্রাকৃতিক কার্যকারণে, নিজ নিজ শৃদ্ধ অশুদ্ধ জীবনাচরণগত কর্মই প্রত্যক মানুষের শুভ অশুভ কর্মফল প্রদান করে। দ্বিতীয় অদৃশ্য কোন শক্তির এখানে ভূমিকা নেই।

'অর্থব, উদ্যমহীন অশ্বকে পেছনে ফেলে সক্রিয় উদ্যোগী বেগবান অশ্ব যেমন এগিয়ে চলে, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবানরা তেমনি নিষ্ক্রয়দের মধ্যে সক্রিয়, সুপ্তদের মধ্যে জাগ্রত এবং ক্রোধীদের মধ্যে অক্রোধী হয়ে প্রগতির দিকে এগিয়ে চলে।'"

[অষ্ট্রেলিয়ার একজন প্রখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং স্বনামধন্য স্কলার শ্রাবস্তী ধম্মিকা প্রনীত পুস্তিকা A good question and good answer থেকে ডাঃ অরবিন্দু বড়ুয়া কর্তৃক অনুদিত কুশল প্রশ্নোত্তর থেকে সংগৃহীত]

মূল বইটি ডাউনলোড করতে নিচের বাটনে ক্লিক করুন


Good Question and Good Answer(download)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !